ডা. মো. আহাদ হোসেন

  ০৮ জুলাই, ২০২১

অস্টিওপোরোসিস বা হাড়ক্ষয়

হাড়ক্ষয় হচ্ছে, শরীরের হাড়ের এমন একটি অবস্থা যাতে হাড়ের ঘনত্ব কমে যায় এবং ভেতরের গঠন দুর্বল হয়ে যায়; যা পরে হাড় ভেঙে যাওয়ার মতো পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে। বিশ্বে প্রায় ২০০ মিলিয়ন লোক এই হাড়ক্ষয় বা অস্টিওপোরোসিস নামক সমস্যায় আক্রান্ত। অস্টিওপোরোসিস সোসাইটির তথ্য অনুযায়ী প্রতি পাঁচজনে একজন পুরুষ এবং প্রতি তিনজনে একজন মহিলা এই হাড়ক্ষয় বা অস্টিওপোরোসিস সমস্যায় আক্রান্ত হন। এই হাড়ক্ষয়ে ভেঙে যাওয়ার পূর্ব পর্যন্ত কোনো লক্ষণ নেই। তাই এই সমস্যাটি খুবই বিপজ্জনক এবং আমাদের সুস্থ থাকার জন্য একটি বড় অন্তরায়। তাই এর সম্পর্কে সঠিক তথ্য জানার এবং এর থেকে বেঁচে থাকার জন্য চেষ্টা করা আমাদের উচিত।

অস্টিওপোরোসিস বা হাড়ক্ষয়ের লক্ষণসমূহ :

১. কোমরসহ শরীরের বিভিন্ন অঙ্গে ব্যথা হওয়া

২. একটি নির্দিষ্ট সময় পরে শরীরের বৃদ্ধি বন্ধ হয়ে যাওয়া

৩. শরীর কুঁজো হয়ে যাওয়া

৪. শরীরের কিছু কিছু অঙ্গের হার হঠাৎ যেকোনো কারণে ভেঙে যাওয়া।

অস্টিওপোরোসিস বা হাড়ক্ষয়ের কারণ :

বিভিন্ন কারণে আমরা হাড়ক্ষয় বা অস্টিওপোরোসিস সমস্যায় আক্রান্ত হতে পারি। যেমন

বয়স ও লিঙ্গভেদ : আমাদের বয়স যত বাড়তে থাকে ততই অস্টিওপোরোসিস বা হাড়ক্ষয়ের প্রবণতা বাড়তে থাকে। আবার মহিলাদের ক্ষেত্রে হাড়ক্ষয়ের প্রবণতা বেশি থাকে ৪০ বছরের ওপরে।

সেক্স হরমোনের প্রভাব : সেক্স হরমোন কমে গেলে আমাদের শরীরের হাড় দুর্বল হয়ে যায়। আবার পুরুষের ক্ষেত্রে প্রোস্টেট ক্যানসারের চিকিৎসা টেস্টোস্টেরন-এর উৎপাদন কমিয়ে দেয় এবং মহিলাদের স্তন ক্যানসারের চিকিৎসা তাদের ক্ষেত্রে ইস্ট্রোজেনের পরিমাণ কমিয়ে দেয়। এসব কারণে সেক্স হরমোনের তারতম্য হলে অস্টিওপোরোসিস বা হাড়ক্ষয়ে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।

অন্যান্য হরমোনের প্রভাব : সেক্স হরমোন ছাড়াও আমাদের শরীরে যদি কোনো কারণে থাইরয়েডগ্রন্থির নিঃসরণ অত্যাধিক রকম বেড়ে যায়, সে ক্ষেত্রেও হাড়ক্ষয়ের প্রবণতা বেড়ে যায়। এ ছাড়াও যদি কোনো কারণে প্যারাথাইরয়েড ও অ্যাড্রেনাল গ্রন্থির নিঃসরণ বেড়ে যায়, তাহলেও হাড়ক্ষয়ের প্রবণতা বেড়ে যেতে পারে।

খাদ্যাভ্যাস : আমাদের খাদ্যাভ্যাসে যদি ক্যালসিয়াম সমৃদ্ধ খাবারের ঘাটতি থেকে যায় দীর্ঘদিন। তাহলে হাড়ক্ষয়ের ঝুঁকি বেড়ে যায়। যারা সাধারণত রেস্ট্রিক্টেড ডায়েট করেন তাদের ক্ষেত্রে এই প্রবণতা বেশি থাকে। আবার কিছু কিছু ক্ষেত্রে বিভিন্ন রোগের কারণেও খাবারের রেস্ট্রিকশন হয়ে থাকে। যেমন ইরিটেবল বাওয়েল সিনড্রোম বা আইবিএস। এই রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিদের বিভিন্ন ধরনের খাবারের শোষণ কম হয়, যে কারণে তাদের ক্যালসিয়ামের ঘাটতি থেকে যায়। দীর্ঘদিন এই প্রক্রিয়া চলতে থাকলে তা হাড়ক্ষয়ের একটি অন্যতম কারণ হয়ে দাঁড়ায়। আবার কিছু কিছু ক্ষেত্রে খাদ্যনালির অপারেশনজনিত কারণে ক্যালসিয়ামের শোষণ কমে গিয়ে এর ঘাটতি ও হাড়ক্ষয় বাড়িয়ে দিতে পারে।

ওষুধ সেবনের মাধ্যমে হাড়ক্ষয় : বিভিন্ন কারণে আমরা ওষুধ খেয়ে থাকি। এদের মধ্যে যদি স্টেরয়েড জাতীয় ওষুধ দীর্ঘদিন আমাদের খেতে হয়, তাহলে এর কারণে হাড়ক্ষয়ের ঝুঁকি বেড়ে যায়। এ ছাড়াও ক্যানসার-জাতীয় রোগের কারণে আমরা যে ওষধ খেয়ে থাকি, সেগুলো হাড়ক্ষয়ের জন্য দায়ী হতে পারে।

বিভিন্ন রোগের কারণে হাড়ক্ষয় : বিভিন্ন রোগের কারণেও আমরা হাড়ক্ষয় বা অস্টিওপোরোসিস-এ আক্রান্ত হতে পারি। এদের মধ্যে অন্যতম অন্ত্রের সমস্যা সিলিয়াক ডিজিজ ও ইরিটেবল বাওয়েল সিনড্রোম আইবিএস, লিভার ও কিডনি সমস্যাজনিত রোগ, ক্যানসার জাতীয় সমস্যা, মাল্টিপল মায়োলোমা, রিউম্যাটয়েড আর্থ্রাইটিস ও লুপাস জাতীয় রোগ।

কিছু বদ-অভ্যাস : আমাদের জীবনযাপন পদ্ধতির কিছু অভ্যাস, যা ক্ষয়ের জন্য দায়ী হতে পারে। এদের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে যারা অধিক সময় বসে কাজ করে হাঁটাহাঁটি বা ওজন বহনের কাজ করেন না বললেই চলে, যারা অধিক পরিমাণে অ্যালকোহল বা অন্যান্য ড্রিংকস পান করেন, যারা অধিক ধূমপান করেন।

অস্টিওপোরোসিস হাড়ক্ষয় প্রতিরোধের উপায় :

১. সুষম খাবার ও ক্যালসিয়াম সমৃদ্ধ খাবার গ্রহণ হাড়ক্ষয় প্রতিরোধে সাহায্য করতে পারে। কার্বোহাইড্রেট জাতীয় খাবার কম খেয়ে ফাইবার জাতীয় খাবার যেমন শাকসবজি ভাতের পরিবর্তে রুটি, দুধ ও দুধ-জাতীয় খাবার, সামুদ্রিক মাছ ও ডিম ক্যালসিয়াম সমৃদ্ধ খাবারগুলোর মধ্যে অন্যতম।

২. যারা নিয়মিত এক্সারসাইজ করেন, তারা হঠাৎ করে দীর্ঘদিন এক্সারসাইজ বন্ধ না রাখা।

৩. নিয়মিত এক্সারসাইজ করা।

৪. ধূমপান পরিহার করা।

৫. অ্যালকোহল জাতীয় পানীয় পরিহার করা।

৬. মাত্রাতিরিক্ত কফি সেবন না করা।

৭. ভিটামিন ডি-এর ঘাটতি পূরণ করা। ভিটামিন ডি সমৃদ্ধ খাবারগুলোর মধ্যে অন্যতম সামুদ্রিক মাছ,

মাশরুম, ডিম।

৮. যারা অস্টিওপোরোসিস বা হাড়ক্ষয়ের ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় থাকেন, তারা চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ভিটামিন ডি সাপ্লিমেন্ট গ্রহণ করতে পারেন।

পরিশেষে বলা যায, হাড়ক্ষয় অস্টিওপোরোসিস একবার শুরু হলে এর চিকিৎসা পদ্ধতিতে খুব বেশি পরিবর্তন করা সম্ভব নয়। তাই প্রতিরোধের মাধ্যমে হাড়ক্ষয় থেকে বেঁচে থাকার একমাত্র উপায়। বয়সকালীন এই হাড়ক্ষয়জনিত সমস্যা থেকে মুক্ত থাকতে এখনই সিদ্ধান্ত নিন এবং সুস্থ থাকুন।

লেখক : কনসালট্যান্ট ও পেইন ফিজিশিয়ান

কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল

ঢাকা

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close