শায়লা নাসরিন

  ২৫ মার্চ, ২০২১

দ্রুত নয়, বরং ওজন কমান ধীরে ধীরে

স্বাস্থ্যের ভিত্তি হচ্ছে পুষ্টি, শরীর সুস্থ রাখতে হলে সঠিক পুষ্টি অত্যন্ত গুরত্বপূর্ণ। আমরা প্রত্যেকেই চাই জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত সুস্থ থাকতে, কর্মোদ্দীপনা বাড়াতে এবং দীর্ঘদিন বেঁচে থাকতে। অসুস্থ দেহে কখনোই সুষ্ঠু চিন্তার বিকাশ ঘটে না, এজন্য দরকার শরীরের প্রয়োজন অনুযায়ী নিয়মিত সুষম খাদ্য গ্রহণ করা।

বর্তমানে বাংলাদেশে ওজনাধিক্য বড় সমস্যা হয়ে দেখা দিয়েছে। সাধারণত শরীরের স্বাভাবিক ওজনের তুলনায় ১০ ভাগ বেশি হলে তাকে আমরা ওজনাধিক্য বলি। খাবার সম্পর্কিত ভুল তথ্যের কারণে, অনেকে না খেয়ে ওজন কমানোর চেষ্টা করেন। আবার বয়স, পেশা এবং লিঙ্গ অনুসারে কোন খাবার কতটুকু খাওয়া প্রয়োজন, তা অনেকেরই জানা নেই। ওজন বাড়ার কারণগুলো হচ্ছেÑ দীর্ঘ সময় টিভি, কম্পিউটারে সামনে বসা, অনিয়মিত খাদ্যাভ্যাস, মোবাইল ফোনে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বেশি ব্যস্ত থাকার কারণে কায়িক পরিশ্রম কম হয়। এ ছাড়া হাঁটার জায়গা অপ্রতুল হওয়ায় পর্যাপ্তা হাঁটার সুযোগ কম। আবার অনেকের মধ্যে এমন প্রবণতা আছে সারা দিন না খেয়ে দিনে দু-একবার খায়, যার ফলে খাবারের পরিমাণ বেশি হয়।

আরেকটি অন্যতম কারণ হচ্ছে, জাঙ্কফুড এবং ফাস্টফুট জাতীয় খাদ্য যেমন : বোতলজাত খাবার, চিপস, সালাদে ড্রেসিং, কোমলপানীয়, কিউব স্যুপ, ক্রিম স্যুপ, ক্যান্ডি, গ্রিল, বার্গার, বেকারির খাবার, চাইনিজ, আইসক্রিম, চকলেট, বিরিয়ানি, হালিম, তেহারি, কাঁচা লবণ, টেস্টিংসলট পোলাও, মিষ্টি ও মিষ্টি জাতীয় খাবার, বাইরের শরবতসহ, কোক, জুস, চকলেট মিল্ক ইত্যাদি। এ ধরনের খাদ্যে মাত্রাতিরিক্ত তেল, চর্বি, মসলা ও লবণ থাকায় দ্রুত ওজন বাড়ে। তখন শরীরের বিভিন্ন খাদ্য উপাদানের ঘাটতি দেখা দেয়। সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে, অতিরিক্ত ফাস্টফুড কোমলপানীয় ও চাইনিজ খাবারে ডিপ্রেশন বাড়ে। কারণ এই খাবারগুলো যেমন ব্রেনের সেরোটিন ডোপামিন নিঃসরণ স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় কমিয়ে দেয়, তেমনি মানসিকভাবে অস্থির করে তোলে।

অন্যদিকে, প্রয়োজন ছাড়া বেশি রাত জাগার ফলে ক্ষুধা লাগে। তখন খাবারের পরিমাণও বাড়ে, এতে দ্রুত ওজন বাড়ে। তরুণ-তরুণীরা সৌন্দর্যপ্রিয়। তাই বিভিন্ন মাধ্যম থেকে জেনে ওজন কমানোর চেষ্টা করেন। তখন প্রোটিনজাতীয় খাদ্য বাদ দিয়ে শুধু সবজি, ফল, খেয়ে ওজন কমানোর চেষ্টা করেন। কিন্তু মনে রাখতে হবে, সুষম খাবার না খেলে ধীরে ধীরে শরীরে নানা ধরনের জটিলতা দেখা দেবে। এতে হিতে বিপরীত হওয়ারই সম্ভাবনা থাকে।

ওজন কমানোর আগে কিছু রুটিন টেস্ট করে জেনে নিতে হবে শারীরিক অবস্থা সম্পর্কে। রক্তে সুগারের মাত্রা, কোলেস্টেরল, ক্রিয়েটিনিন, ইউরিক অ্যাসিড ইত্যাদি টেস্ট করে নিশ্চিত হয়ে, সেই অনুযায়ী পরামর্শ নিতে হবে ডাক্তার বা পুষ্টিবিদদের। মাসে ১-২ কেজি ওজন কমানোর পরিকল্পনা করতে হবে। প্রথমে উচ্চতা ও ওজন নিয়ে শরীরের পুষ্টিগত অবস্থা জানতে হবে। বিএমআই বা বডিমাস ইনডেক্স বা হিপ টু ওয়েস্ট রেসিওর মাধ্যমে পুষ্টিগত অবস্থা নিরূপণ করা যায়। প্রত্যেকটি মানুষ অন্যজন হতে ভিন্ন। সে কারণে তাদের বয়স, রুচি, সামর্থ্য খাদ্যের ধরন আলাদা হবে। বিভিন্ন জিম বা বিউটি পার্লার থেকে গণডায়েট চার্ট ফলো করা বা অনুসরণ করা ঠিক না। বিভিন্ন বয়সের পেশা, দৈনদিন শারীরিক পরিশমের মাত্রা এবং শরীরের চাহিদার দিকে লক্ষ রেখে খাদ্য পরিকল্পনা করতে হবে।

ওজন অনেক সময় নিয়ে ধীরে ধীরে বাড়ে। তাই একটু ধৈর্য ধরে সঠিক পদ্ধতিতে সময় নিয়ে ওজন কমাতে হবে। তবে যারা ওজন কমাতে চান তেল, মিষ্টি, লবণ পরিমিত পরিমাণে খেতে হবে। প্রতিদিন নিয়ম করে হাঁটতে হবে। অল্প অল্প করে বারবার খেতে হবে। লক্ষ রাখতে হবে, কত সময় পরপর খাবেন, খাদ্যের ধরন কেমন হবে, কী পরিমাণে খাচ্ছেন। প্রতিদিন খাবারে ৬টা উপাদান উপস্থিত থাকতে হবে। যেমন : কার্বোহাইড্রেট, প্রোটিন, ফ্যাট, ভিটামিন, মিনারেলস ও পানি। সকালের নাশতাকে গুরুত্ব দিতে হবে, কারণ সারারাত না খেয়ে থাকার ফলে সকালের খাবার না খেলে অ্যাসিডিটি দেখা দেবে, দীর্ঘক্ষণ না খেলে খাবারের প্রবণতা বাড়বে। ফলে একবারে বেশি খাওয়ার জন্য ক্যালরি গ্রহণ বেশি হয়। সকালের নাশতার তিন ঘণ্টা পর হালকা নাশতা খেতে হবে। দুপুরের খাবার সময়মতো খেতে হবে, ভাত, মাছ, মাংস, ছোট মাছ, কলিজা, সামুদ্রিক মাছ, শাক-সবজি, ডাল, সালাদ, লেবু থাকবে দুপুরের খাবারে। বিকালে হালকা নাশতা থাকবে। সন্ধ্যার পরপর ভারী খাবার খেয়ে নিতে হবে। কারণ রাতের খাবার আগে খেলে বেশ কিছুক্ষণ জেগে থাকা হয়, হাঁটাচলা হয়, যার কারণে মোটা বা পেট বড় হওয়ার সম্ভাবনা কমে যায়। তবে লক্ষ রাখতে হবে, যেসব খাদ্যে গ্লাইসেমিক ইনডেক্স কম অর্থাৎ ক্যালরির পরিমাণ কম সেসব খাবার বেছে বেছে খেতে হবে।

জেনে রাখবেন, ওজন কমানোর জন্য খুব বেশি কিছু করতে হবে না। শুধু আপনার জীবনযাপন পদ্ধতির সামান্য পরিবর্তন দরকার। সুস্থ থাকতে হলে জীবনে শৃঙ্খলা আনতে হবে। সকালে ঘুম থেকে ওঠা, পজিটিভ চিন্তা করা, খাদ্য সম্পর্কে সঠিক ধারণা নেওয়া, প্রতিদিন নির্দিষ্ট সময়ে হাঁটা এবং পরিকল্পিত খাদ্য ও শৃঙ্খলাই পারে আপনার বাড়তি ওজন ঝরিয়ে ফেলতে।

এমফিল পিএইচডি ফেলো (ডিইউ)

বিভাগীয় প্রধান খাদ্য ও পুষ্টি বিভাগ

শিশু-মাতৃ স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট

মাতুয়াইল, ঢাকা-১৩৬২

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close