নিজস্ব প্রতিবেদক
ভাষা আন্দোলন ও বাঙালির জাতীয় চেতনা

ভাষা আন্দোলন কীভাবে সৃষ্টি করেছিল বাঙালির জাতীয় চেতনা। নতুন রাষ্ট্র পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় ভাষা কী হবে, তা নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়ে গিয়েছিল ভারত ভাগের আগেই। অবাঙালি মুসলিম রাজনীতিবিদ ও অধ্যাপক-বুদ্ধিজীবীরা বলছিলেন উর্দু ভাষার কথা; অন্যদিকে ড. মুহাম্মদ শহিদুল্লাহ ও এনামুল হকের মতো বাঙালি বুদ্ধিজীবীরা এর প্রতিবাদ করছিলেন।
ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটি বই লিখেছেন বাংলাদেশের বামপন্থি রাজনীতিবিদ এবং লেখক বদরুদ্দীন উমর। ‘পূর্ব বাঙলার ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতি’ নামে এ বইয়ে বদরুদ্দীন উমর বিস্তারিত বর্ণনা করেছেন, সেসময় কীভাবে ছোট-বড় অনেক রাজনৈতিক দল, বিভিন্ন ছাত্র ও নাগরিক সংগঠন, আর শিক্ষক-অধ্যাপক-চিন্তাবিদরা বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার ব্যাপারে কথা বলতে শুরু করেছিলেন। সে সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু ছাত্র ও অধ্যাপক মিলে ১৯৪৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসেই তমদ্দুন মজলিস নামে একটি সংগঠন সৃষ্টি করেন, যারা শুরু থেকেই রাষ্ট্রভাষা প্রশ্নে নানারকম সভা-সমিতি-আলোচনার আয়োজন করে।
গঠিত হয়েছিল একটি ‘রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদও।’
এর নেতারা ১৯৪৮ সালের ১ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তানের শিক্ষমন্ত্রী ফজলুর রহমানের সঙ্গে এক বৈঠক করে ডাকটিকিট-মুদ্রা ইত্যাদিতে বাংলা না থাকা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছিলেন। ফজলুর রহমান তাদের আশ্বাস দেন যে এগুলো ঘটেছে ‘নিতান্ত ভুলবশত’। ঢাকায় ১৯৪৭-এর ৫ ডিসেম্বর বর্ধমান হাউসে (বর্তমান বাংলা একাডেমি ভবন) বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লিগের ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠকে প্রস্তাব নেওয়া হয় যে, উর্দুকে পূর্ব বাংলার সরকারি ভাষা করা হবে না। এ বৈঠকের সময় বাংলাকে পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে ভবনের সামনে বিক্ষোভও করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ও শিক্ষকরা। ফলে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার মাত্র ৬-৭ মাস পর জিন্নাহ যখন ঢাকায় আসেন, তখনই রাষ্ট্রভাষা প্রশ্নে পূর্ব পাকিস্তানের শিক্ষিত সমাজ রীতিমতো উদ্বিগ্ন এবং ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছিলেন।
উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার কথাবার্তা শুরু হওয়ার সঙ্গেই পূর্ববঙ্গের ছাত্র, শিক্ষিত মধ্যবিত্ত সমাজ, বুদ্ধিজীবী আর রাজনীতিবিদরা বুঝেছিলেন যে, এটা বাঙালিদের জন্য চরম বিপর্যয় ডেকে আনবে। তারা বুঝলেন, এর ফলে পাকিস্তানে উর্দুভাষীদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হবে, বাঙালিরা সরকার ও সামরিক বাহিনীতে চাকরি-বাকরির সুযোগের ক্ষেত্রে উর্দু-জানা জনগোষ্ঠীর তুলনায় পিছিয়ে পড়বে। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হওয়ার ফলে বাঙালি মুসলমানদের উন্নয়ন ও সামাজিক বিকাশের স্বপ্ন সৃষ্টি হয়েছিল, তা চরমভাবে ব্যাহত হবে। অথচ পাকিস্তানের বাস্তবতা ছিল এই যে, সে দেশের পূর্বাংশে এবং গোটা দেশ মিলিয়েও সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ভাষাই ছিল বাংলা। পশ্চিম পাকিস্তানে ৪০ শতাংশের কিছু বেশি লোকের ভাষা ছিল পাঞ্জাবি, আর মাত্র চার শতাংশের ভাষা ছিল উর্দু।
সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ভাষা হয়েও বাংলা ভাষা পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হবে না এটা পূর্ববঙ্গের ছাত্র ও শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর মধ্যে প্রচণ্ড ক্ষোভ সৃষ্টি করেছিল। ‘একদিকে ভাষা ও আত্মপরিচয়ের আবেগ তো আছেই তা ছাড়াও এর একটা অর্থনৈতিক দিক আছে’, বলছিলেন কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও বিশ্লেষক রওনক জাহান। তার কথায়, তখন চাকরির সুযোগ বলতে সরকারি চাকরিই ছিল। কিন্তু উর্দু রাষ্ট্রভাষা হলে সরকারি চাকরি বা সেনাবাহিনীতে চাকরি পেতে বাঙালিদের উর্দু শিখতে হবে, উর্দুভাষীদের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে হবে- ফলে তাদের ডিসঅ্যাডভান্টেজ হয়ে যায়। ফলে ছাত্রদের জন্য এটা ছিল ভবিষ্যতের প্রশ্ন। পাকিস্তানের দুই অংশের মধ্যে বৈষম্য ক্রমেই স্পষ্ট হতে থাকে।
অর্থনীতি, বাজেট বরাদ্দ, সরকারি চাকরির সুযোগ, রাজস্ব ও কর- এরকম সব ক্ষেত্রে পশ্চিম পাকিস্তানের প্রাধান্য আর পূর্ব পাকিস্তানকে বঞ্চিত করার বিষয়টি রাজনীতিতে প্রধান ইস্যু হয়ে ওঠে। রওনক জাহান বলছেন, বাঙালিরা যে আলাদা, এ আত্মপরিচয় এবং পশ্চিম পাকিস্তানের অংশ হয়ে যে থাকা হবে না এ অনুভূতিটা প্রথম থেকেই ধীরে ধীরে বেড়েছে। ছিল ভাষাভিত্তিক আত্মপরিচয়। অমর্ত্য সেন বলেছেন, মানুষের অনেক রকম আইডেনটিটি আছে। আমরা মুসলমান সেটা হয়তো ৪৭ সালের আগে জোরালো ছিল। কিন্তু ৪৭-এর পর আমাদের ভাষাভিত্তিক পরিচয়টাই প্রধান হয়ে ওঠে। সূত্র : ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস।
"