টঙ্গী (গাজীপুর) প্রতিনিধি
আমিন-ধ্বনিতে মুখর ইজতেমা ময়দান
ড্রোন আতঙ্কে হুড়াহুড়ি আহত ৪১

বিশ্ব মুসলিম উম্মাহর আত্মশুদ্ধি, দুনিয়া ও আখিরাতের শান্তি এবং দেশের কল্যাণ কামনার মধ্য দিয়ে শেষ হলো ৫৮তম বিশ্ব ইজতেমার প্রথম পর্ব। গতকাল রবিবার সকাল ৯টার কিছু পরই মাওলানা জুবায়ের আহমদের পরিচালনায় হৃদয়স্পর্শী আখেরি মোনাজাতে মুখর হয়ে ওঠে তুরাগতীর।
এদিকে আখেরি মোনাজাত চলাকালে একটি ড্রোন বিকট শব্দে ময়দানে আছড়ে পড়লে আতঙ্কে হুড়াহুড়িতে আহত হয়েছেন প্রায় অর্ধশত মানুষ। তাদের প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে। বিশ্ব ইজতেমার প্রথম পর্বের প্রথম দফায় অসুস্থ হয়ে গত শনিবার রাতে আরো এক মুসল্লি মারা গেছেন। এ নিয়ে ইজতেমা ময়দানে ৬ মুসল্লির মৃত্যু হয়েছে। প্রথমে আরবি, উর্দু ও পরে বাংলা ভাষায় মোনাজাত করা হয়। দুনিয়া ও আখিরাতের রহমত প্রার্থনায় লাখো মুসল্লি দুই হাত তুলে আল্লাহর দরবারে কান্নায় ভেঙে পড়েন। যেন এক আধ্যাত্মিক পরিবেশের সৃষ্টি হয়। পুরো ময়দানজুড়ে তখন শুধুই ‘আমিন, আল্লাহুম্মা আমিন’ ধ্বনি।
প্রায় ২৬ মিনিট ধরে এ মোনাজাতে মাওলানা জুবায়ের প্রথম ১৩ মিনিট কোরআনের বিভিন্ন আয়াতের দোয়া উচ্চারণ করেন, পরে ১৩ মিনিট বাংলা ভাষায় মোনাজাত করেন। দেশ-বিদেশ থেকে লাখ লাখ মানুষ টেলিভিশন ও মোবাইল ফোনের মাধ্যমে সরাসরি এ মোনাজাতে শরিক হন। রাজধানীসহ আশপাশের এলাকার মানুষ বিমানবন্দর, উত্তরা, কামারপাড়া সড়ক ও মহাসড়কের বিভিন্ন স্থানে দাঁড়িয়ে হাত তোলেন আখেরি মোনাজাতে। ইজতেমার এ মাহফিলে শরিক হতে গত বৃহস্পতিবার থেকেই ধর্মপ্রাণ মুসল্লি টঙ্গীমুখী হতে থাকেন। শনিবার সকাল থেকেই তাদের আগমন আরো বাড়তে থাকে। ট্রাক, বাস, মিনিবাস, প্রাইভেট কার; এমনকি পায়ে হেঁটেও অসংখ্য মানুষ ছুটে আসেন আল্লাহর রহমতের আশায়।
গতকাল রবিবার ভোরের আলো ফোটার আগেই ইজতেমা ময়দান কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে যায়। জায়গা না পেয়ে হাজার হাজার মানুষ আশপাশের রাস্তা, অলিগলি, বিভিন্ন ভবনের ছাদ; এমনকি তুরাগ নদীতে নৌকার ওপর বসেও মোনাজাতে অংশ নেন। যেদিকে চোখ যায়, সেদিকেই শুধু টুপি-পাঞ্জাবি পরা ধর্মপ্রাণ মানুষের ঢল। আখেরি মোনাজাতকে কেন্দ্র করে সরকারি-বেসরকারি বহু প্রতিষ্ঠান ছুটি ঘোষণা করে, আবার কোনো কোনো প্রতিষ্ঠান কর্মীদের মোনাজাতে অংশগ্রহণের স্বাধীনতা দেয়। মোনাজাত শেষ হতেই লাখ লাখ মুসল্লির নিজ গন্তব্যে ফেরার পথে কামারপাড়া সড়ক, ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক, টঙ্গী-কালীগঞ্জ সড়কসহ আশপাশের এলাকায় সৃষ্টি হয় কিছুটা জনযট ও যানজট। কিন্তু এসব কষ্ট ভুলিয়ে দেয় ইজতেমার পবিত্র পরিবেশ ও আল্লাহর কাছে পাওয়া আত্মশুদ্ধির অনুভূতি।
ভিআইপির অংশগ্রহণ : এবারের ইজতেমার আসরে বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের আমীর ও হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা মামুনুল হক এবং বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহ্বায়ক হাসনাত আবদুল্লাহ অংশ নেন। এছাড়া আজাদ কাশ্মীর আইনসভা পরিষদের সদস্য পীর মজহার সাঈদ শাহও অংশ নেন। এদিকে ৫৮তম বিশ্ব ইজতেমার প্রথম পর্বে প্রথম ধাপে বিশ্বের ৭৬টি দেশ থেকে প্রায় ৩ হাজার ৫০ মেহমান ইজতেমায় অংশ নেন।
আহত-নিহত : বিশ্ব ইজতেমার প্রথম পর্বে প্রথম ধাপে ৬ মুসল্লির মৃত্যুর তথ্য নিশ্চিত করেছেন আয়োজক কমিটির মিডিয়া সমন্বয়কারী হাবিবুল্লাহ রায়হান। নিহতদের জানাজা ইজতেমা ময়দানে সম্পন্ন করে স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়। গতকাল রবিবার দুপুর ১২টায় ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া থানার মসজিদপাড়া গ্রামের অহিদ হোসেন (৫০) মারা যান। শনিবার রাতে ভোলার চরফ্যাশনের হাজী আবদুল গফুর (৭৫) ও বিকেলে হবিগঞ্জের রামনগর ইউনিয়নের রমিজ আলী (৬০) ইন্তেকাল করেন। শুক্রবার রাতে হবিগঞ্জের বাহুবলের ইয়াকুব আলী (৬০), বিকেলে শেরপুরের ছাবেত আলী (৭০) এবং সকালে খুলনার আবদুল কুদ্দুস গাজী (৬০) মারা যান। অন্যদিকে রবিবার সকাল ১০টা ৪৫ মিনিটে ইজতেমার ৪ নম্বর গেটের ভেতরে চায়ের কেটলির গরম পানিতে ঝলসে যান জুয়েল (২৫), যিনি বগুড়ার সোনাতলা থানার আলিদা বাগান গ্রামের আমজাদ সরকারের ছেলে। তাকে প্রথমে টঙ্গীর হাসপাতালে নেওয়া হয়, পরে উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে।
ইজতেমা ময়দানে আছড়ে পড়ল ড্রোন, হুড়াহুড়িতে আহত ৪১ : আখেরি মোনাজাত চলাকালে একটি ড্রোন বিকট শব্দে ময়দানে আছড়ে পড়লে আতঙ্কে হুড়াহুড়িতে আহত হন প্রায় অর্ধশত মানুষ। রবিবার সকালে এ ঘটনায় আহত অন্তত ৪১ জন টঙ্গীর শহীদ আহসানউল্লাহ মাস্টার জেনারেল হাসপাতালে প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়েছেন। হাসপাতালের জরুরি বিভাগের চিকিৎসক মো. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘যতটুকু জানতে পেরেছি, ইজতেমা ময়দানের মোনাজাতের চিত্র ধারণ করার কাজে কোনো এক সাংবাদিকের ব্যবহার করা একটি ড্রোন ময়দানে আছড়ে পড়ে। তাতে আতঙ্কিত হয়ে ছোটাছুটি করতে গিয়ে অনেকে আহত হন।’
আখেরি মোনাজাত চলাকালে সকাল ৯টা ২৫ মিনিটে ইজতেমা ময়দানের বিদেশি নিবাসের পূর্বপাশে টিনের ছাউনিতে ড্রোনটি আছড়ে পড়লে বিকট শব্দ হয়। মূলত ওই শব্দের কারণেই আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। সেখানে অবস্থানরত মো. হাসান নামে একজন বলেন, ‘মাওলানা মোহাম্মদ জুবায়ের তখন আখেরি মোনাজাত পরিচালনা করছিলেন। মোনাজাতের শেষ দিকে কয়েক মিনিট আগে ওপর থেকে কিছু একটা এসে পড়ল। ‘হঠাৎ বিকট শব্দ। কিছু বুঝে উঠতে না পেরে সেখানে থাকা লোকজন আতঙ্কিত হয়ে ছোটাছুটি শুরু করে দেন। পরে শব্দের উৎস খুঁজতে গিয়ে দেখা যায়, টিনের চালে একটা ড্রোন এসেছে পড়েছে।’
গাজীপুর মহানগর পুলিশের টঙ্গী জোনের সহকারী কমিশনার মোহাম্মদ মেহেদী হাসান জানান, খবর পেয়ে পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়েছিল। কিন্তু তার আগেই কেউ ড্রোনটি নিয়ে গেছে। ‘সেটা কীভাবে সেখানে পড়েছে, আর কারাইবা নিয়ে গেল, তা জানার চেষ্টা করছি। তবে ড্রোনটি পুলিশ কিংবা কোন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নয় বলে জানতে পেরেছি। আমরা ঘটনাটি অনুসন্ধান করছি।’ টঙ্গী পূর্ব থানার ওসি মো. ফরিদুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, ‘একটি ড্রোন আকাশে উড়ছিল সম্ভবত ড্রোনটির চার্জ শেষ হয়ে যাওয়ায় সেটি ইজতেমা ময়দানের একটি কামরার টিনের ছাউনিতে আছড়ে পড়ে। তাতে মুসল্লিরা অনেকেই আতঙ্কিত হয়ে পড়েন।’
হুড়াহুড়িতে আহত যারা হাসপাতালে প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়েছেন, তাদের একটি তালিকা দিয়েছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। তারা হলেন- আবুল কালাম (৫৫), আলামিন (৩২), আজাদ (৩০), ওবায়দুল্লাহ (৩২), রাতুল (১৮), আবদুল করিম (২৮) সাইফুল ইসলাম (৩৮), জাফর উদ্দিন (৩১) জয়নাল (২৪), মকবুল হোসেন (৬৪) সোহাগ (৬০), মোশারফ (৩০), কোরবান আলী (২৫), সাইফুল ইসলাম (৩৫), সালামত (১৮), মুস্তাকিন (৩৩), কবির হোসেন (৩০), মুবিন (১৮), আয়নাল হক (২২), মামুন হোসেন (২১), মো. বাসেদ (১৩), খোকন (৪৩), জুয়েল (২৫), কবির হোসেন (৪৬), নাজিম উদ্দিন (৪১), জবরুল (৩১), জয়নাল (৫৪), কাওছারুল আলম (২৮), রায়হান (২৭), জহরুল (২৮), আলী নেওয়াজ (৩৮), আফতাব উদ্দিন (৪৭) মো. আমান (২৮), আনোয়ার (৪৫), সোহেল (৩৫), ফজল হক (৪৫) ও মুজাফফর আলী (৪৪)।
"