নিজস্ব প্রতিবেদক

  ০৩ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫

অবরোধ বিক্ষোভে জনভোগান্তি

নানা দাবি-বিক্ষোভে প্রায় প্রতিদিনই উত্তাল থাকছে রাজধানী ঢাকা। এসব কর্মসূচির কারণে রাস্তাঘাট বন্ধ হয়ে ভোগান্তিতে পড়ছেন মানুষ। গতকাল রবিবারও রাজধানীর তিনটি স্থানে সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ আন্দোলন করেছেন বিশ্বদ্যিালয়ের দাবিতে তিতুমীর সরকারি কলেজের শিক্ষার্থীরা, পুনর্বাসনের দাবিতে জুলাই আন্দোলনে আহতরা এবং স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার পদত্যাগ দাবিতে ইনকিলাব মঞ্চের নেতাকর্মীরা। এতে সড়কে থেমে থেমে চলেছে যানবাহন। যানবাহনের ধীরগতিতে যানজটে স্থবির হয়ে পড়ে এ তিলোত্তমা নগরী। এতে সপ্তাহের প্রথম কর্মদিবসে ঘরে ফেরা মানুষজন ভোগান্তিতে পড়েন।

শিক্ষা উপদেষ্টার বক্তব্য প্রত্যাখ্যান করে তিতুমীর শিক্ষার্থীদের হুঁশিয়ারি : রাজধানীর সরকারি তিতুমীর কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয় করাসহ ৭ দফা দাবিতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির শিক্ষার্থীরা রবিবার টানা চতুর্থ দিনের মতো সড়ক অবরোধ করেছেন। বাঁশ ফেলে তারা সড়ক অবরোধ করেন। এতে সড়কে যান চলাচল বন্ধ হয়ে মহাখালী, নাবিস্কো, তিব্বতসহ আশপাশের এলাকায় যানজট ছড়িয়ে পড়ে। এদিকে তিতুমীর কলেজকে বিশেষ সুবিধা দেওয়ার সুযোগ নেই- শিক্ষা উপদেষ্টার এমন কথা তীব্র প্রতিবাদ করেছেন আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা। তারা আলটিমেটাম দিয়ে কখনো বিশ্ববিদ্যালয় হয় না- শিক্ষা উপদেষ্টার এমন বক্তব্য প্রত্যাখ্যান করে কঠোর আন্দোলনের হুঁশিয়ারি দিয়েছেন আন্দোলনতর শিক্ষার্থীরা। রবিবার বিকেলে গণমাধ্যমকে এসব কথা জানান তিতুমীর কলেজের আন্দোলনরত রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী আবদুল হামিদ। তিনি বলেন, উপদেষ্টার আজকের (রবিবার) বক্তব্য সম্পূর্ণ দ্বিচারিতা এবং আগের কথার সঙ্গে সাংঘর্ষিক। শিক্ষা উপদেষ্টার বক্তব্য প্রত্যাখ্যান করে সামনে আরো কঠোর আন্দোলন করা হবে।

এদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বীকৃতির দাবিতে টানা পঞ্চম দিনের মতো অনশন করছেন তিতুমীর কলেজের একদল শিক্ষার্থী। এরই মধ্যে রানা আহমেদ নামে অনশনরত এক শিক্ষার্থীকে সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে পাঠানো হয়। আরো অনশন কর্মসূচি পালন করা শিক্ষার্থীদের মধ্যে তিনজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক বলে জানান চিকিৎসক। দুপুরে তিতুমীর কলেজের সামনে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে এ তথ্য জানান সরকারি কর্মচারী হাসপাতালের মেডিকেল অফিসার ডা. রাসেল আহমেদ। তিনি বলেন, অনশনরত শিক্ষার্থীদের শরীরে পানিশূন্যতার কারণে তাদের ব্লাডপ্রেসার কমে যাচ্ছে। এদের মধ্যে তিনজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক। তাদের দ্রুত হাসপাতালে ভর্তি করতে হবে। এখানে তাদের আর চিকিৎসা দেওয়া সম্ভব না। তাদের যদি দ্রুত হাসপাতালে না নেওয়া হয়, তাহলে তাদের শরীরে শর্টটার্ম এবং লংটার্মে বড় ধরনের শারীরিক সমস্যা সৃষ্টি হতে পারে জানিয়ে তিনি বলেন, পানিশূন্যতার কারণে তাদের মধ্যে ডিহাইড্রেশনের সৃষ্টি হয়েছে। এর ফলে তাদের কিডনির কর্মক্ষমতা কমে যাচ্ছে। তাদের অবস্থা অবনতি দিকে যাচ্ছে।

মিরপুরে সড়কে জুলাই আন্দোলনে আহতদের সড়ক অবরোধ, ঠায় দাঁড়িয়ে যানবাহন : ছোট লরি নিয়ে শ্যামলীতে দাঁড়িয়ে ছিলেন চালক আবুল মিয়া। ৩ ঘণ্টা একই স্থানে দাঁড়িয়ে, কখন জটলা খুলবে সেই নিশ্চয়তা নেই। শুধু শিবলু নয়, অনেক চালক ঠায় দাঁড়িয়ে। কারণ গণঅভ্যুত্থানে আহতরা অসুস্থ শরীর নিয়ে রাজধানীর মিরপুর শিশুমেলাসংলগ্ন সড়কে অবস্থান নেন। ফলে মিরপুর, ধানমন্ডি, ফার্মগেট, আসাদগেট ও আগারগাঁও সড়কে ছড়িয়ে পড়েছে জটলা। ৩ ঘণ্টা ধরে একই জায়গায় দাঁড়িয়ে ছিল যানবাহন। এতে চরম ভোগান্তিতে পড়েন সাধারণ মানুষ। রবিবার সকালে শিশুমেলার সামনে তিন রাস্তার মোড়ে আহতরা তাদের দাবি আদায়ে অবস্থান নেন। এর আগে থেকেই জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানের (পঙ্গু হাসপাতাল) সামনের রাস্তায় অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ করেন তারা। ফলে ভোগান্তি শুরু হয় সড়কে। এমনকি রিকশাও চলাচল করতে পারেন। গাবতলী-যাত্রাবাড়ীগামী ৮ নম্বর পরিবহনের চালক শহিদুল ইসলাম বলেন, ২ ঘণ্টা ধরে দাঁড়িয়ে। কখন জ্যাম ছুটবে পুলিশও বলতে পারে না। আজ মনে হয় গ্যাসের দামও উঠবে না।

সরেজমিন দেখা যায়, অনেকের হাতে স্যালাইনে ভাঙা পায়ে ব্যান্ডেজ ও ক্রাচে ভর করে সড়কে অবস্থান নিয়েছেন। আন্দোলনকারীদের ‘দালালি না বিপ্লব, বিপ্লব বিপ্লব’, ‘আস্থা নাই রে আস্থা নাই’, ‘দালালিতে আস্থা নাই’ ‘চিকিৎসা চাই হয় মৃত্যু না হয় মুক্তি’ বৈষম্যবিরোধী এমন নানা স্লোগানও দিতে শোনা যায়। আহতদের দাবি, তাদের রক্তের বিনিময়ে দেশ থেকে স্বৈরাচার বিদায় নিয়েছে। তারা কেউ পুলিশের গুলি খেয়েছে, কেউ টিয়ার শেলে অন্ধ হয়েছে। আবার কেউ পা হারিয়ে পঙ্গুত্ববরণ করেছে। তাদের কারণে যেই স্বাধীনতা সরকার ভোগ করছে, সেই তাদেরই চিকিৎসা থেকে শুরু করে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতিতে অবহেলা করা হচ্ছে।

জাহিদ হাসান নামে আহত এক শিক্ষক বলেন, ‘আমি বনশ্রীতে আন্দোলন করেছি। আমরাই হাসিনা সরকারকে দেশ থেকে বিতাড়িত করেছি। আন্দোলনের ছয়-সাত মাস আমাদের নিয়ে নাটক হয়েছে। আমরা বেঁচে আছি ঠিকই, কিন্তু মাঝে মাঝে মনে হয়, আমরা মরে গেলেই ভালো হতো। আমরা আজ দাবি নিয়ে বসিনি, অধিকার আদায়ে বসেছি। তাদের মধ্যে কেউ রাজনৈতিক দল করছে। কেউ কেউ উপদেষ্টা হয়ে সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত অফিস করছে। কিন্তু আমাদের নিয়ে তাদের কথা বলার সময় নেই। এটা খুবই দুঃখজনক। নিজের ও আহত ভাইদের অধিকার পূরণ করতে হলে যদি রাজপথে জীবন দিতে হয়, তাও দেব। আমরা স্বাধীনতা রক্ষা করেছি। তাহলে আমরা কেন মানবেতর জীবনযাপন করবো। তারা আহতদের ক্যাটাগরি করেছে। আন্দোলনের সময় তো কোনো ক্যাটাগরি ছিল না। তারা যে কী করছে সেটাই বুঝতে পারছি না।’

রফিক মিয়া নামে এক ভুক্তভোগী জানান, আমার অবস্থা গুরুতর। আমাদের রাষ্ট্রের স্বীকৃতি দিতে হবে। এর আগে তারা অনেকবার এসেছে, আমাদের সঙ্গে কথা বলেছে কিন্তু কথা অনুযায়ী কাজ হয়নি। আমাদের পুনর্বাসন করতে হবে। এছাড়া আমরা যারা আহত হয়ে বিছানায় কাতরাচ্ছি তাদের দ্রুত চিকিৎসার জন্য বিদেশ পাঠাতে হবে। আমাদের কথা শুনতে হবে। আমরা দেশের স্বার্থে জনগণের স্বার্থে কাজ করেছি। এখন এ অবস্থায় রাষ্ট্র আমাদের দেখার কথা। কিন্তু রাষ্ট্র দেখছে না বলেই আমরা পথে নেমে এসেছি। তারা এখনো জুলাই ফাউন্ডেশনের টাকা দেওয়া শেষ করতে পারেনি। এদিকে আমাদের পরিবার অচল হয়ে গেছে। সরকারের পক্ষ থেকে আমাদের জন্য কিছুই করা হয়নি। তারা এগুলো কবে করবে। আমরা মরে যাওয়ার পরে করবে নাকি বলে প্রশ্ন রাখেন তিনি। আগস্টের আহত যোদ্ধা কায়কোবাদ বলেন, প্রকৃত চিকিৎসা দিচ্ছে না। আমাদের স্বীকৃতি দেয় না। আশ্বাস দেয় না। আমাদের আন্দোলনে মুলা ঝোলানোর মতো অবস্থা হচ্ছে।

আন্দোলনের ফলে শিশুমেলা থেকে আগারগাঁও লিংক রোডে যান চলাচল বন্ধ। সেইসঙ্গে আশপাশের এলাকায়ও তীব্র যানজট সৃষ্টি হয়েছে। সড়কে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভের কারণে যান চলাচল বন্ধ। সৃষ্টি হয়েছে তীব্র যানজট। পুলিশের সহকারী কমিশনার (পেট্রোল, মোহাম্মদপুর) তারিকুল ইসলাম বলেন, সকাল সাড়ে ১০টা থেকে আহতরা সুচিকিৎসার দাবিতে সড়কে অবস্থান নিয়েছেন। এর আগে নিটোরের সামনে অবস্থান নিলেও এখন তারা মিরপুর সড়কে অবস্থান নিয়েছেন। ফলে শ্যামলী, কল্যাণপুর, আসাদগেটসহ সংশ্লিষ্ট সড়কে তীব্র যানজটের সৃষ্টি হয়েছে।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় অভিমুখে ইনকিলাব মঞ্চের মিছিলে পুলিশের বাধা : জুলাই গণহত্যার বিচারের ব্যর্থতার দায় নিয়ে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার পদত্যাগ এবং আগামী ২০ ফেব্রুয়ারির মধ্যে জুলাই হত্যাকাণ্ডের বিচারের পরিপূর্ণ রূপরেখা প্রকাশসহ চার দফা দাবিতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ঘেরাও কর্মসূচি দিয়েছে ইনকিলাব মঞ্চ। গতকাল বিকেল ৩টায় রাজু ভাস্কর্য় থেকে বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে সচিবালয়ের দিকে রওনা হয় ইনকিলাব মঞ্চের নেতাকর্মীরা। পরে শিক্ষাভবনের সামনে তাদের আটকে দেয় পুলিশ। এতে শিক্ষা ভবনের সামনের সড়কে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়।

সমাবেশে ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র শরীফ উসমান হাদি বলেন, আইন উপদেষ্টা পোস্ট দিচ্ছেন, বিচার করতে হবে। আপনার কাছে প্রশ্ন, কারা বিচার করবে? যখন উপদেষ্টা ছিলেন না তখন বলতেন, এটা করব সেটা করব। গত ছয় মাসে কোন জিনিসটা করেছেন? তিনি আরো বলেন, বাংলাদেশের আনাচে-কানাচে যত আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীরা আছে, অতিদ্রুত তাদের গ্রেপ্তার করতে হবে। আমরা দেখছি, বিসিএস কর্মকর্তা আওয়ামী লীগের লিফলেট বিতরণ করছেন। আপনারা কী করেন? ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র আরো বলেন, আমরা আর কোনো সেনাবাহিনী, নৌবাহিনীর বিরুদ্ধে দাঁড়াব না। এখন সময় সুশীল সরকারের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর। চট্টগ্রামের নেভির দাওয়াতে কীভাবে আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসীরা উপস্থিত থাকে? বিক্ষোভ মিছিলে নেতাকর্মীদের ‘জাগো জাগো জনতা, প্রশ্ন কর ক্ষমতা’, ‘কত টাকা খাইছে নেভি, জবাব দে তাড়াতাড়ি’, ‘প্রশাসন শুদ্ধ কর, পুলিশের বিচার কর’ ইত্যাদি স্লোগান দিতে দেখা যায়।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close