বদরুল আলম মজুমদার

  ০২ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫

শিক্ষার্থী ও বিএনপির মধ্যে মিল-অমিল

জুলাই অভ্যুত্থানের প্রস্তাবিত ঘোষণাপত্র প্রকাশ করেছে বিএনপি। প্রস্তাবিত জুলাই অভ্যুত্থানের খসড়া নিয়ে মিত্র দলগুলোর মতামত নিচ্ছে বিএনপি। গত দুদিনে ১২ দলীয় জোট ও এলডিপির সঙ্গে কথা বলেছেন দলটির নেতারা। অধিকাংশ রাজনৈতিক দলের সম্মতিতে খসড়া প্রস্তাবটি নিয়ে ছাত্রদের জুলাই ঘোষণা পত্রের সঙ্গে সমন্বয় করা। তবে ছাত্রদের দেওয়া জুলাই বিপ্লবের ঘোষণা সঙ্গে বিএনপির প্রস্তাবের বিস্তর ফারাক লক্ষ করা গেছে।

বিশেষ করে ৭২-এর সংবিধান প্রশ্নে বিএনপির অনড় অবস্থান ঘোষণাপত্রের আসল উদ্দেশ্য ব্যাহত হতে পারে বলে মনে করছেন শিক্ষার্থী প্রতিনিধিরা। ছাত্রদের দেওয়া ঘোষণার মূল কথা ৭২-এর সংবিধানের বাতিল করা। অথচ বিএনপি সংবিধান পরিবর্তনের জন্য সংসদকে ক্ষমতা দেওয়ার কথা বলছে। যদিও এ ধরনের ঘোষণাপত্রের প্রয়োজনীয়তা ও এর আইনগত দিক নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে বিএনপির। কিন্তু দলটির একাধিক সিনিয়র নেতা জানান, গণঅভ্যুত্থানের পক্ষের শক্তির ঐক্য ধরে রাখার বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে তারা ঘোষণাপত্রের জন্য প্রস্তাব দিচ্ছেন। বিএনপি তাদের প্রস্তাবে ১৬ দফা তুলে ধরেছে। অন্যদিকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটি নিজস্ব ঘোষণাপত্রের একটি খসড়া পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, ছাত্রদের খসড়ায় শুধু ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টের ৩৬ দিনের আন্দোলন ও গণঅভ্যুত্থান প্রাধান্য পেয়েছে। এতে রাজনৈতিক দলগুলোর অবদানের কথা সেভাবে আসেনি বলে বিএনপি ও এর মিত্র দলগুলোর নেতাদের অনেকে মনে করেন। পতিত শেখ হাসিনার শাসনের বিরুদ্ধে বিগত ১৬ বছরের আন্দোলন ও নির্যাতিত হওয়ার ঘটনাপ্রবাহ এবং শেষ পর্যন্ত গণঅভ্যুত্থানে রাজনৈতিক দলগুলোর অবদানকে প্রাধান্য দিয়েছে বিএনপি তাদের প্রস্তাবে। শুধু ’২৪-এর গণঅভ্যুত্থানের মধ্যেই থাকেনি বিএনপি। স্বাধীন বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক সব আন্দোলন ও ঐতিহাসিক বিভিন্ন পরিবর্তনও জায়গা পেয়েছে বিএনপির প্রস্তাবে। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ প্রসঙ্গও তাদের প্রস্তাবে রাখা হয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহ উদ্দিন আহমদ বলেন, স্বৈরাচারী আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে যুগপৎ আন্দোলনের শরিকদের সঙ্গে তারা দলের প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা করছেন। শরিকদের মতামত পর্যালোচনা করে ঘোষণাপত্রের প্রস্তাব চূড়ান্ত করা হবে।

বিএনপির প্রস্তাবে যা আছে : প্রস্তাবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার কথা বলা হয়েছে। উল্লেখ আছে বিভিন্ন গণতান্ত্রিক আন্দোলনের কথা। বিগত ১৬ বছর বিএনপিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের আন্দোলন ও তাদের ওপর নিপীড়নের কথা এসেছে। শেখ হাসিনা জবরদস্তিমূলক শাসন ও একনায়কতন্ত্র চালিয়েছিলেন বলেও উল্লেখ করা হয়েছে। বিএনপির প্রস্তাবে বলা হয়েছে, স্বৈরাচারী আওয়ামী লীগ সরকার দুর্নীতি ও মাফিয়া শাসন প্রতিষ্ঠা করে আন্তর্জাতিকভাবে দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করেছে। বিগত তিনটি বিতর্কিত ও সাজানো সংসদ নির্বাচনের কথা এসেছে। সরকারি চাকরিতে নিয়োগে কোটা ব্যবস্থার মাধ্যমে বৈষম্য সৃষ্টি এবং এর বিরুদ্ধে ছাত্রদের আন্দোলন, সেই আন্দোলনে স্বৈরাচারী শাসনের নিপীড়ন, গণহত্যা ও গণঅভ্যুত্থানের কথাও এসেছে।

বিএনপি তাদের প্রস্তাবের শেষ দফায় নির্বাচনের কথা এসেছে। বলা হয়েছে, জনগণের আকাঙ্ক্ষা অনুযায়ী বৈষম্যহীন সমাজের অভিপ্রায় থেকে ন্যূনতম সময়ের মধ্যে একটি নির্বাচিত সরকার প্রতিষ্ঠা করা প্রয়োজন। ছাত্র-জনতার ৩৬ দিনের আন্দোলনে গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগের শাসনের পতন হয়েছে। কিন্তু এর পেছনে রাজনৈতিক দলগুলোর আন্দোলনের দীর্ঘ প্রেক্ষাপট রয়েছে, সেই প্রেক্ষাপটকে এড়িয়ে যাওয়া উচিত নয় বলে মনে করে বিএনপি। দলটির নেতারা বলছেন, বিগত ১৬ বছরে বিএনপিসহ বিভিন্ন দল স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন-সংগ্রামে গুম-খুন, মামলা, জেল-জুলুমসহ নানা নির্যাতন-নিপীড়নের শিকার হয়েছে। দলের তৃণমূলের নেতাকর্মী থেকে শুরু করে শীর্ষনেতা কেউই রেহাই পাননি।

ছাত্রদের জুলাই বিপ্লবের ঘোষণাপত্রের খসড়ায় যা আছে : ছাত্রদের দেওয়া জুলাই বিপ্লবের ঘোষণাপত্রের খসড়ায় বলা আছে, যেহেতু বাংলাদেশের মানুষ ঔপনিবেশিক শাসন থেকে মুক্তির জন্য ১৯৪৭ সাল যুদ্ধ করেছে, যেহেতু পাকিস্তান ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের সঙ্গে বৈষম্যমূলক আচরণ করেছে, যেহেতু ১৯৭২ এর সংবিধান আমাদের জাতির আশা-আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়ন করতে পারেনি, যেহেতু মার্শাল ল’ এবং সাংবিধানিক সংশোধনীগুলো ক্রমান্বয়ে রাষ্ট্রকে দুর্বলতম করেছে।

খসড়ায় আরো উল্লেখ রয়েছে, যেহেতু বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামকে ফ্যাসিস্ট শাসন কায়েম করার ক্ষেত্রে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে; পিলখানা, শাপলা চত্বর গণহত্যা, বিচার বিভাগীয় হত্যা, সংখ্যালঘুদের অধিকার নিয়ে ছিনিমিনি খেলা হয়েছে; ছাত্র-জনতা এ বৈষম্যের বিরুদ্ধে ফুঁসে উঠেছে; রাজাকারের নাতি হিসেবে আখ্যায়িত করে তাদের ব্যক্তিত্ব ও মর্যাদা ভূলুণ্ঠিত করা হয়েছে; আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ফ্যাসিস্ট শাসন দীর্ঘস্থায়ী কারার ক্ষেত্রে বেপরোয়া ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে; ছাত্ররা ৯ দফা দাবি উপস্থাপন করেছিল, ইন্টারনেট বন্ধ করে কারফিউ জারি করে ছাত্র-জনতার উচ্চকিত কণ্ঠ স্তিমিত করার চেষ্টা হয়েছিল; ছাত্র-জনতা অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দিয়েছিল; সব শ্রেণি-পেশার, ধর্ম-বর্ণ, সাংস্কৃতিক গোষ্ঠী, ডান-বাম নির্বিশেষ ফ্যাসিজমের বিরুদ্ধে অকল্পনীয় ঐক্য গড়ে তুলেছে, সেহেতু ছাত্র-জনতা ব্যাপক জনসমর্থন লাভ করেছে এবং সহস্রাধিক জীবন বিসর্জন দিয়েছে। সেইসঙ্গে আজও শত শত ছাত্র-জনতা মৃত্যু যন্ত্রণায় কাতর, সেজন্য আমরা নিজেদের স্বাধীন সার্বভৌম জনগণ হিসেবে ঘোষণা করলাম।

এরই পরিপ্রেক্ষিতে... * আমরা পার্লামেন্ট বিলুপ্তি চাই। * হাসিনা সরকারের সময় নিযুক্ত কর্মকর্তা কর্মচারীদের রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব পালন থেকে বিরত রাখতে চাই। * আমরা ড. ইউনূসের নেতৃত্বে একটা অন্তর্বর্তী সরকার চাই। * মিলিটারি শাসন ও ১/১১ এর পুনরাবৃত্তি যাতে না ঘটে, সেজন্য বেগম খালেদা জিয়ার ত্বরিত মুক্তি কামনা করছি। * আমরা ৭২-এর সংবিধান সংস্কার বা বাতিল চাই। * আমরা সব প্রতিষ্ঠানের সংস্কার চাই। * আমরা গুম, খুন ও গণহত্যার সুবিচার চাই। * অর্থ পাচার, পাচারকৃত অর্থ উদ্ধার এবং পাচারকারী ব্যক্তিদের শাস্তি চাই। * আমরা নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত চাই। ৭২-এর বন্দোবস্ত বাতিল চাই। * ১/১১-এর বন্দোবস্ত বাতিল চাই। * আমরা একটি গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র (উবসড়পৎধঃরপ জবঢ়ঁনষরপ) চাই, আমরা বৈষম্য চাই না।

এ ঘোষণা ৫ আগস্ট ২০২৪ থেকে কার্যকর হবে বলেও জুলাই বিপ্লবের ঘোষণাপত্রের খসড়ায় উল্লেখ রয়েছে। বিএনপি তাদের প্রস্তাবের খসড়া গণতন্ত্র মঞ্চ, ১২ দলীয় জোট, লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টিসহ (এলডিপি) মিত্র দল ও জোটগুলোকে দিয়েছে। বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক ও গণতন্ত্র মঞ্চের অন্যতম নেতা সাইফুল হক বলেন, তারা অল্প সময়ের মধ্যে জোটে বিএনপির প্রস্তাবের ওপর আলোচনা করে তাদের মতামত জানাবেন।

উল্লেখ্য, গত বছর ৩১ ডিসেম্বর কেন্দ্রীয় শহিদ মিনারে ‘জুলাই বিপ্লবের ঘোষণাপত্র’ দেওয়ার পূর্বঘোষিত কর্মসূচি ছিল বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটির। তবে এর আগের দিন রাতে অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের ঘোষণাপত্র তৈরি করা হবে বলে ঘোষণা দেওয়া হয়। এরপর ‘জুলাই বিপ্লবের ঘোষণাপত্র’ না দিয়ে সরকারের উদ্যোগকে ‘সময়োপযোগী’ আখ্যা দিয়ে একে সাধুবাদ জানায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। পরে এ নিয়ে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনের যুক্ত রাজনৈতিক দল ও স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে বৈঠক করেন।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close