বিশেষ প্রতিবেদক
রমজানে নিত্যপণ্যের জোগানে ব্যাপক প্রস্তুতি

চলতি মাস শেষে শুরু হবে মুসলমানদের পবিত্র রমজান মাস। রমজান মাসে ইফতার ও সাহরির জন্য মানুষ কিছু বাড়তি খাবার ক্রয় করে থাকেন। এজন্য চাহিদা বাড়ে ভোজ্যতেল, চিনি, খেজুরসহ নানা পণ্যের। তবে এবার ব্যবসায়ীরা আগাম মজুদ ও প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছেন। যাতে ভোক্তার চাহিদার যথাযথ জোগান দিতে পারেন। ব্যবসায়ীরা রমজান ঘিরে এরই মধ্যে প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছেন।
ব্যবসায়ীরা জানান, গত জানুয়ারি মাসে বিপুল পরিমাণ নিত্যপণ্য আমদানি করেছেন তারা। এ আমদানি পণ্যের পরিমাণ রমজানে নিত্যপণ্যের চাহিদা পূরণ করতে সক্ষম বলে জানান ব্যবসায়ীরা। আমদানি বাড়ানো ও মূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখতে অন্তর্বর্তী সরকার ভোজ্যতেল, চিনি, পেঁয়াজ, আলু, খেজুরসহ বিভিন্ন পণ্যে শুল্ক ছাড় দিয়েছিল। পাশাপাশি ঋণপত্র খুলতে এখন মার্কিন ডলারের সংকটও অনেকটা কেটেছে। সব মিলিয়ে আমদানিতে উৎসাহ বেড়েছে। আমদানিকারকরা বলছেন, ফেব্রুয়ারিজুড়ে আরো নিত্যপণ্য আমদানি হবে। ফলে সরবরাহ বাড়বে। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর বড় কয়েকটি শিল্প গ্রুপের আমদানি কমে যাওয়ায় বাজারে সরবরাহে প্রভাব পড়ার আশঙ্কা ছিল। এখন দেখা যাচ্ছে, পুরোনো আমদানিকারকদের কেউ কেউ নতুন করে সক্রিয় হয়েছেন। নতুন নতুন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান নিত্যপণ্য আমদানিতে যুক্ত হয়েছে। ফলে কোনো সমস্যা হয়নি।
তেল ও চিনি : বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনের (বিটিটিসি) হিসাবে, রোজায় বাজারে ভোজ্যতেলের চাহিদা থাকে প্রায় ৩ লাখ টন। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) ও চট্টগ্রাম কাস্টমসের তথ্যে দেখা যায়, জানুয়ারি মাসের প্রথম ২৯ দিনে সয়াবিন ও পাম তেল আমদানি হয়েছে প্রায় ৪ লাখ টন। আবার সয়াবিন তেল তৈরির কাঁচামাল সয়াবিনবীজ আমদানি হয়েছে ৩ লাখ টন। এ বীজ মাড়াই করে পাওয়া যাবে প্রায় অর্ধলাখ টন সয়াবিন তেল, অর্থাৎ রোজার চাহিদার চেয়ে বাজারে সরবরাহ বেশি থাকবে। রোজায় চিনির চাহিদাও ৩ লাখ টনের মতো। বিগত ১৫ মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ পরিমাণ অপরিশোধিত চিনি আমদানি হয়েছে জানুয়ারি মাসে, ১ লাখ ৫৩ হাজার টন। বন্দরে এসে ভিড়েছে আরো প্রায় ১ লাখ টন চিনিসহ জাহাজ। বিশ্ববাজারে পণ্যটির দাম কমছে। ফেব্রুয়ারিতেও চিনি আমদানি হবে।
খেজুর ও ছোলা : ট্যারিফ কমিশনের হিসাবে, রোজায় খেজুরের চাহিদা ৬০ হাজার টন। জানুয়ারিতে এসেছে ২২ হাজার টন। বড় চালান আসবে ফেব্রুয়ারিতে। খেজুর আমদানিকারক ফারুক ট্রেড ইন্টারন্যাশনালের মালিক ফারুক আহমেদ বলেন, সরকার শুল্কছাড় দিয়েছে। এতে প্রতি কেজিতে সর্বনিম্ন ৩০ টাকা, সর্বোচ্চ ১২২ টাকা শুল্ক-কর কমেছে। ব্যবসায়ীরা জানুয়ারি থেকে পুরোদমে আমদানি শুরু করেছেন। রোজা শুরুর আগে ফেব্রুয়ারিতে আরো খেজুর আসবে। খেজুর আমদানিকারক ফারুক ট্রেড ইন্টারন্যাশনালের মালিক ফারুক আহমেদ জানান, সরকার খেজুরে শুল্কছাড় দিয়েছে। এতে প্রতি কেজি খেজুরে সর্বনিম্ন ৩০ টাকা, সর্বোচ্চ ১২২ টাকা শুল্ককর কমেছে।
ব্যবসায়ীরা জানুয়ারি থেকে পুরোদমে আমদানি শুরু করেছেন। রোজা শুরুর আগে ফেব্রুয়ারিতে আরো খেজুর আসবে। ব্যবসায়ীদের হিসাবে, রোজায় ১ লাখ টন মটর ডালের চাহিদা রয়েছে। জানুয়ারিতে আমদানি হয়েছে ১ লাখ ৮ হাজার টন। রোজায় ১ লাখ টনের মতো ছোলার চাহিদা রয়েছে। জানুয়ারিতে ছোলা আমদানি হয়েছে ৯৩ হাজার টন। ডিসেম্বরে এসেছিল আরো ১৫ হাজার টন। ১ লাখ টন চাহিদার বিপরীতে জানুয়ারিতে মসুর ডাল এসেছে ৬২ হাজার টন। গত বুধবার ২৫ হাজার টন মসুর ডাল নিয়ে বন্দরে ভিড়েছে একটি জাহাজ। ফেব্রুয়ারিতেও আমদানি হবে বলে জানান ব্যবসায়ীরা। রোজায় মটর ডালের চাহিদাও বেশি থাকে। রমজানে কয়েকটি নিত্যপণ্য সম্পর্কে জানা গেছে।
পেঁয়াজ ও আলু : এনবিআরের হিসাবে, গত ১ থেকে ২৯ জানুয়ারি আমদানি হওয়া পেঁয়াজ, ছোলা, মটর ও মসুর ডাল, ভোজ্যতেল পাম ও সয়াবিনের কাঁচামাল, চিনি, গম ও খেজুরের মোট দাম ১০০ কোটি মার্কিন ডলার, যা গত বছরের একই সময়ের তুলনায় প্রায় ৭৪ শতাংশ বেশি। আমদানির পরিমাণ মোট ১৬ লাখ ২৪ হাজার টন। দেশে পেঁয়াজের উৎপাদন মৌসুম হওয়ায় তুলনামূলক পেঁয়াজ আমদানি কম। দাম অনেকটাই কমেছে। বাজারে কমদামে বিক্রি হচ্ছে এ পণ্যটি। এদিকে আলুর দামেও নিম্নগামী। বাজারে ২০ টাকায় মিলছে আলু। রমজানেও আলুর দাম কম থাকবে বলে জানান ব্যবসায়ীরা। রোজায় নিত্যপণ্যের প্রায় ৮৮ শতাংশ আসছে মূলত চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে। বন্দরে গতকাল শনিবার ৩২টি জাহাজ ছিল। এসব জাহাজে এসেছে ১২ লাখ ৬৭ হাজার টন পণ্য। এসব পণ্যের বড় অংশই খালাস হয়েছে, বাকিটা খালাস হচ্ছে। এর আগে পণ্য খালাস করে কিছু জাহাজ চলেও গেছে।
প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের চেয়ারম্যান ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা আহসান খান চৌধুরী জানান, প্রাণ গ্রুপ পর্যায়ক্রমে নিত্যপ্রয়োজনীয় সব পণ্যই আমদানি শুরু করবে। আমাদের লক্ষ্য হলো ভোক্তারা যাতে প্রতিযোগিতামূলক দামে পণ্য হাতে পায়। চট্টগ্রামের স্মাইল ফুড প্রোডাক্টস একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, তারা এখন গম ও ভোজ্যতেল আমদানি করছেন। ভবিষ্যতে চিনি পরিশোধন করবেন। একটি চিনি পরিশোধন কারখানা অধিগ্রহণ পর্যায়ে রয়েছে।
আগে নাসা গ্রুপ ও মদিনা গ্রুপ খেজুর আমদানি করত। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর পুলিশ নাসা গ্রুপের চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম মজুমদার ও মদিনা গ্রুপের চেয়ারম্যান হাজি মোহাম্মদ সেলিমকে গ্রেপ্তার করে। এখন এ দুই গ্রুপের আমদানি বন্ধ বা কম। তবে খেজুর আমদানিতে যুক্ত হয়েছে নতুন নতুন প্রতিষ্ঠান।
টি কে গ্রুপের পরিচালক মোস্তফা হায়দার জানান, জানুয়ারিতে আমদানি বেড়েছে। পাইপলাইনে আরো পণ্য পাইপলাইনে আছে। বাজারে সরবরাহে ঘাটতি হওয়ার সুযোগ নেই। বিশ্ববাজারও মোটামুটি স্থিতিশীল। দুশ্চিন্তার কারণ নাই বলে জানান তিনি।
বেসরকারি গবেষণাপ্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, নিত্যপণ্য আমদানিতে যুক্ত কয়েকটি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান বাণিজ্য করার মতো অবস্থায় নেই। এতে নিত্যপণ্য সরবরাহে যে শঙ্কা তৈরি হয়েছিল, তা কেটে গেছে। পণ্য আমদানিতে নতুন প্রতিষ্ঠান যুক্ত হয়েছে। তারপরও বাজার তদারিকের জন্য সরকারের নজরদারি বাড়ানোর পরামর্শ দেন তিনি।
আগামী রমজানে পণ্যের দাম নিম্নমুখী থাকবে জানিয়ে বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন বলেন, রজমানে খাদ্যপণ্যের বাজার নিম্নগামী থাকবে। খেজুর, ছোলা, ডালসহ এ সময় প্রয়োজনীয় সব পণ্যের সরবরাহ স্বাভাবিক থাকবে বলে আশা করছি। সে প্রস্তুতি আমাদের রয়েছে।
"