সালাহ উদ্দিন বাবর
অপরাধে জড়িয়ে পড়ছেন অবৈধ বিদেশিরা

একে তো অবৈধভাবে বাংলাদেশে অবস্থান করছেন; তার ওপর মাদক, চোরাচালান, প্রতারণাসহ নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়ছেন বিদেশিরা। অনলাইনে বন্ধুত্ব গড়ে উপহার পাঠানো, স্বর্ণ বা বিট-কয়েনে বিনিয়োগ ও আকর্ষণীয় উপার্জনের আশ্বাসসহ নানা ফাঁদে ফেলে মানুষের কাছ থেকে অর্থ বের করে নেওয়ার ঘটনা আলোচনায় আসছে কিছুদিন পরপরই। এ ধরনের ঘটনায় অনেক বিদেশি নাগরিকের সম্পৃক্ততাও পাওয়া যাচ্ছে। এর বাইরে ব্যাংকের এটিএম বুথে জালিয়াতি, ক্রেডিট কার্ড জালিয়াতি, অনলাইনে ক্যাসিনো, অপ্রচলিত মাদকের কারবার, জাল মুদ্রা তৈরি, অবৈধ ভিওআইপি ব্যবসা, স্বর্ণ চোরাচালান ও মানব পাচারের মতো অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডেও অনেক বিদেশি নাগরিক ধরা পড়ছেন।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তথ্যানুযায়ী, নানা অপরাধে জেল খাটছেন ৮ দেশের ৩৮০ বিদেশি নাগরিক। অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের বিভিন্ন মামলায় গত ১০ বছরে আসামি হয়েছেন ৩৩ দেশের ৮৫০ নাগরিক। এদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি নাইজেরিয়ার। এরপর রয়েছে পাকিস্তান ও ক্যামেরুনের নাগরিক। এদের বেশিরভাগই এদেশে এসেছেন ব্যবসায়িক ও ভ্রমণ ভিসায়। কেউ কেউ ‘অন অ্যারাইভাল’ ভিসায় এসে অবৈধভাবে রয়ে গেছেন।
জানা গেছে, দেশে গত ১৮ জানুয়ারি পর্যন্ত অবৈধ বিদেশি নাগরিকের সংখ্যা ৩৩ হাজার ৬৪৮। ভিসার মেয়াদ শেষ হলেও নানা প্রতিষ্ঠানে কাজ করছেন ৩৩ হাজার বিদেশি। এমন পরিস্থিতিতে অবৈধ বিদেশিদের বিরুদ্ধে কঠোর হচ্ছে সরকার।
তদন্তসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, বিদেশিদের অনেকে বাংলাদেশে ঢুকেই পাসপোর্ট নষ্ট করে ফেলেন, আবার অনেকে ভিসার মেয়াদ শেষ হলে পাসপোর্ট ফেলে দেন অথবা পাসপোর্ট হারানোর কথা বলে থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন। এরপর জিডির সুবাদে অবৈধভাবে থাকার সুযোগ নেন। গ্রেপ্তার বা মামলার আসামি হলে বিচার প্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রতার সুযোগ নিয়েও তারা এদেশে থেকে যাওয়ার সুযোগ নেন। পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি ইনামুল হক সাগর বলেন, ‘সরকারের নির্দেশনা অনুযায়ী অবৈধ বিদেশিদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানে আমরা। এরই মধ্য নজরদারি শুরু হয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এছাড়া অভিযান চালিয়ে অপরাধ কর্মকাণ্ডে জড়িত বিদেশিদের গ্রেপ্তারও করা হচ্ছে। ৩১ জানুয়ারির পর আমাদের অভিযান শুরু হবে।’
পুলিশ সূত্র জানায়, প্রতারণা বা জালিয়াতিতে জড়িত বিদেশিদের সহযোগিতা করছে এদেশের একশ্রেণির অপরাধী। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সরকারের কাছে ১ লাখ ২০ হাজার বিদেশি নাগরিকের তথ্য রয়েছে। তবে প্রকৃত সংখ্যা ৪-৫ লাখের মতো হবে বলে জানা গেছে, যাদের মধ্যে ভারতীয় নাগরিকের সংখ্যাই বেশি। বিদেশি এসব নাগরিকের অনেকে নানা অপরাধের সঙ্গে জড়াচ্ছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। বিভিন্ন অপরাধে জড়িয়ে বর্তমানে ৪৭২ জন কারাগারে রয়েছেন। এদিকে ১৪ জানুয়ারি পর্যন্ত অবৈধভাবে বাস করা নাগরিকদের থেকে ১০ কোটি ৫৩ লাখ টাকা জরিমানা আদায় করা হয়েছে বলে জানান উপদেষ্টা। স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী জানান, ‘কোনো বিদেশি নাগরিককে অবৈধভাবে বাংলাদেশে থাকতে দেওয়া হবে না। আমরা তাদের সময়সীমা বেঁধে দিয়েছি। নির্ধারিত সময় অতিবাহিত হলে আমরা তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেব।’
অবৈধভাবে বসবাসকারীদের একটা বড় অংশ বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন বলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে তথ্য আছে। আবার একটা অংশ প্রতারণাসহ বিভিন্ন অপরাধে জড়াচ্ছেন। এর মধ্যে নাইজেরিয়া, ক্যামেরুন, মালি, কঙ্গো, তানজানিয়া, ঘানা, গিনি, উগান্ডা, ইথিওপিয়া, অ্যাঙ্গোলা, পেরু, আলজেরিয়া, চীন ও ইউক্রেন- এসব দেশের নাগরিকরা অপরাধ কর্মকাণ্ডে বেশি জড়িত। নাইজেরিয়ার নাগরিকরা সহজে বাংলাদেশ থেকে যেতে চান না। তারা চান তাদের নামে মামলা হোক, তাহলে তারা দীর্ঘদিন এখানে থেকে যেতে পারবেন। তাদের দেশে ফেরত পাঠাতে হলে বাংলাদেশ সরকারের খরচে পাঠাতে হবে। এটাও সরকারের জন্য বাধা।
গত ১০ ডিসেম্বর চাঁদপুরের এক তরুণীকে পাচারের সময় বিমানবন্দরের আটক হয় দুই চীনা নাগরিক। রাজধানীর নিকুঞ্জে ব্যবসার কথা বলে একটি তিনতলা বাড়ি ভাড়া নিয়েছিলেন চীনের তিনজন। বিদেশে চাকরি দেওয়ার কথা বলে নারীদের পাচার করতেন তারা। শুধু মাদক বা নারী পাচারই নয়, এটিএম বুথ ও ক্রেডিট কার্ড জালিয়াতি, অনলাইনে ক্যাসিনো, স্বর্ণ চোরাচালানসহ নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়েছেন বিদেশিরা। এসব অপরাধীর বেশিরভাগই বৈধ কাগজপত্র দেখাতে পারেন না। র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মুনীম ফেরদৌস বলেন, ‘বিভিন্ন সংস্থায় চাকরির প্রলোভন এবং ব্ল্যাকমেইলসহ প্রেমের ফাঁদে ফেলেও বিদেশিরা প্রতারণা করে আসছে। এ ধরনের বিষয়ে নির্দিষ্ট কোনো তথ্য পেলে আমরা কাজ করব।’
গত বছরের ২০ জানুয়ারি রাজধানীর উত্তরার হোটেল এফোর্ড ইনে লাগেজ ও ব্যাগ নিয়ে ঢুকতে দেখা যায় দুই বিদেশি নাগরিককে। চেক ইন করেই চলে যান বারিধারায়। পরে বারিধারার একটি বাসার সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজে দেখা যায়, তারা লাগেজ-ব্যাগ নিয়ে ঢুকলেও বেরিয়ে আসেন শুধু ব্যাগ নিয়ে। চার দিন পর হোটেল এফোর্ড ইনে অভিযান চালিয়ে ২০০ গ্রাম কোকেনসহ আটক করা হয় একজনকে।
এর আগে ঢাকা বিমানবন্দরের আটক করা হয় দেশের ইতিহাসের সবচেয়ে বড় কোকেনের চালান। জানা যায়, এর আগেও পোশাকের আড়ালে লাগেজে এসেছে কোকেনের চালান। পরে বারিধারার সেই বাসায় বসে প্যাকেটে ভাগ করে পাঠানো হতো ভারতে। বাসাটি ভাড়া নিয়েছিল ডন ফ্রাংকি নামে নাইজেরিয়ান নাগরিক। সর্বশেষ জুলাইয়ে চট্টগ্রাম বিমানবন্দরে আরেক অভিযানে এ সিন্ডিকেটের এক নারী কোকেনসহ গ্রেপ্তার হয়। ডন ফ্রাংকির নেতৃত্বেই বাংলাদেশ গড়ে ওঠা এ সিন্ডিকেটের আটজন গ্রেপ্তার হলেও পালিয়ে গেছে ডন। এদের কারোরই ছিল না বৈধ কাগজপত্র।
তবে অভিবাসন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সময় বেঁধে দিয়ে সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়। এজন্য দরকার টেকসই কাঠামো। ব্র্যাকের সহযোগী পরিচালক শরিফুল হাসান বলেন, ‘বিদেশি নাগরিকদের আমাদের দেশে কীভাবে থাকতে দেব, কোন প্রক্রিয়ায় তাদের মনিটরিং করব, কীভাবে তারা রিপোর্টিং করবে- এসব বিষয় থাকা উচিত। যারা প্রয়োজনে এদেশে আসতে চায়, তাদের যেন আনতে পারি আর যাতে কেউ যেন অপরাধে জড়িয়ে না পড়ে, সেটাও নিশ্চিত করতে হবে।’
"