সালাহ উদ্দিন বাবর

  ২০ জানুয়ারি, ২০২৫

হতাশা-আতঙ্ক কাটিয়ে ঘুরে দাঁড়াচ্ছে পুলিশ

গণঅভ্যুত্থানে গত বছরের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটলেও ওই আন্দোলন ঘিরে পুলিশের সঙ্গে জনগণের যে দূরত্ব তৈরি হয়েছে, সেটি এখনো ঘোচেনি। জুলাই-আগস্ট আন্দোলনকালে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের নির্দেশে ছাত্র-জনতার ওপর পুলিশের গুলি-হত্যা এবং পাল্টা হামলা-সংঘর্ষের জেরে রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশেই ভেঙে পড়েছিল আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ও নিরাপত্তাব্যবস্থা। নানা পরিস্থিতিতে পুলিশ বাহিনীর সদস্যদের মধ্যেও কাজ করছে হতাশা। তবে অন্তর্বর্তী সরকারের দিকনির্দেশনায় আইনশৃঙ্খলা ও নিরাপত্তাব্যবস্থা ফিরিয়ে আনার জোর চেষ্টা করে যাচ্ছে এ বাহিনী। প্রতিকূল অবস্থা কাটিয়ে জনসাধারণকে সেবা দেওয়ার প্রাণপণ চেষ্টাও চালিয়ে যাচ্ছেন তারা। এরই মধ্যে গত ১৫ জানুয়ারি প্রধান উপদেষ্টার কাছে বেশকিছু সুপারিশসংবলিত প্রতিবেদন দাখিল করেছে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত পুলিশ সংস্কার কমিশন।

জানা গেছে, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে হাসিনা সরকারের পতনের আগে ও পরে হতাহতসহ ব্যাপক ক্ষতির মুখে পড়ে পুলিশ বাহিনী। হামলা-সংঘর্ষে ৪৪ পুলিশ সদস্য নিহতসহ অসংখ্য সদস্য আহত হন। থানা ও পুলিশের বিভিন্ন স্থাপনা থেকে লুট হয় অস্ত্র-গুলি। হামলা-মামলার ভয়ে গা-ঢাকা দেন অনেক পুলিশ সদস্য। দেশ ছাড়েন কেউ কেউ। এখনো ১৮৭ পুলিশ সদস্য কাজেই যোগ দেননি। অনেকে যোগ দিয়েও নিয়মিত অফিস করছেন না। অনেক পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। কেউ কেউ গ্রেপ্তার হয়েছেন। অনেকে আবার গ্রেপ্তার আতঙ্কে আছেন। পুলিশ সদর দপ্তরের উপমহাপরিদর্শক (অপারেশন্স) মো. রেজাউল করিম বলেন, পুলিশ সদস্যদের মাঝে মনোবল ফিরিয়ে আনার জন্য মোটিভেশনাল উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। সম্পৃক্ত করা হচ্ছে সুশীল সমাজকে। সদর দপ্তরসহ পুলিশের বিভিন্ন ইউনিট এবং দেশের সব থানায় আগের মতো স্বাভাবিকভাবে কাজ শুরু হয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক, সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ ড. তৌহিদুল হক প্রতিদিনের সংবাদকে বলেন, ‘জুলাই গণঅভ্যুত্থানে পুলিশের ভূমিকায় নানাভাবে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে এবং তারা নৈতিক সংকটে পড়েছে। বিগত সরকারের সময় পুলিশের ভেতরে রাজনৈতিক এজেন্ডা বাস্তবায়নে ক্যাডার তৈরি হয়েছিল। তারা কোনো নিয়মনীতির মানত না। ঘুষ, অপহরণ, গুম ও দখলে লিপ্ত ছিল। মূলত পুলিশকে জনগণের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। যেখানে অপরাধ, সেখানেই তাদের অবস্থান জানান দিতে হবে। এতে মানুষের আস্থা এবং পরিস্থিতিরও উন্নতি হবে।’

পুলিশ সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পুলিশ সদস্যরা এখনো বিভিন্ন জায়গায় নিগৃহীত হচ্ছেন। সামাজিকভাবে পুলিশ এখন অপরাধী হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। সামাজিকভাবে ইমেজ পুরোপুরি নষ্ট হয়ে গেছে। বাহিনীর সদস্যদের মধ্যে সিনিয়র-জুনিয়র শৃঙ্খলাও নাজুক। কে ছাত্রলীগ, কে কার দালাল- এভাবে চিহ্নিত করা হচ্ছে। ব্যক্তিগত, সামাজিক, রাজনৈতিক ও পেশাগত নানা টানাপড়েনের মধ্যে সময় কাটছে পুলিশের। তবে এসব প্রতিকূল অবস্থা কাটিয়ে জনগণের বন্ধু হওয়ার চেষ্টা করছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীটি।

আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি : একের পর এক ঘটছে প্রকাশ্যে চাপাতি হাতে কোপ, পুলিশের আত্মহত্যা, চুরি, ডাকাতি। নিউমার্কেট থানা সূত্রে জানা যায়, গত ১০ জানুয়ারি রাত ১০টা ৪০ মিনিটে এলিফ্যান্ট রোডের ইসিএস কম্পিউটার সিটির (মাল্টিপ্ল্যান সেন্টার) রাস্তার ওপর দুষ্কৃতকারীরা ধারালো ছুরি, চাপাতিসহ দলবদ্ধ হয়ে ইসিএস কম্পিউটার সিটির ব্যবসায়ী এহতেশামুল হককে এলোপাতাড়িভাবে কুপিয়ে আহত করে। ওই সময়ে এলিফ্যান্ট রোড কম্পিউটার সমিতির সভাপতি ব্যবসায়ী মো. ওয়াহিদুল হাসান দিপু মার্কেটের নিচতলা থেকে গাড়িতে করে আসার সময় তিনিও সন্ত্রাসীদের হামলার শিকার হন। মামলা সূত্রে জানা যায়, আসামিরা ৫ আগস্টের পর বিভিন্ন সময়ে মাল্টিপ্ল্যান সেন্টারে দলবদ্ধ হয়ে এসে মার্কেটের ব্যবসায়ীদের কাছে চাঁদা দাবি করতে থাকে। চাঁদা দিতে অস্বীকৃতি জানালে আসামিরা মার্কেটের ব্যবসায়ীদের নানাভাবে ভয়ভীতি ও হুমকি দিয়ে হয়রানি করতে থাকে। এ পরিপ্রেক্ষিতে পূর্বপরিকল্পিতভাবে এ আক্রমণ করে।

রাজধানীর মিরপুর থেকে ব্যবসায়ীকে অপহরণ : রাজধানীর শেওড়াপাড়া থেকে রাসেল খান নামে এক ব্যবসায়ীকে অপহরণ হওয়ার ৭ ঘণ্টা পর ১০ জানুয়ারি শুক্রবার রাতে উদ্ধার করা হয়েছে। একইসঙ্গে এ ঘটনায় গ্রেপ্তার হয়েছে পাঁচজন। মিরপুর মডেল থানার পরিদর্শক (তদন্ত) সাজ্জাদ রুমন বলেন, ১০ জানুয়ারি রাত ৯টার পর শেওড়াপাড়ার একটি বাসায় অভিযান চালিয়ে পুলিশ তাকে উদ্ধার করে। পুলিশ ওই বাসা থেকে নগদ ৭৫ হাজার টাকা, ৫টি মুঠোফোন, ১টি চাকুসহ পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করেছে। গ্রেপ্তার ব্যক্তিরা হলেন- আলম হোসেন, মনির আহম্মেদ, মো. কবির, মফিজুল হোসেন ওরফে জনি মোল্লা এবং মোছা. সুফিয়া। অপহরণের ঘটনায় ব্যবসায়ী রাসেল খান মিরপুর মডেল থানায় একটি মামলা করেছেন। মামলার এজাহার থেকে জানা যায়, তিনি একজন তৈরি পোশাক ব্যবসায়ী। অপহরণকারীরা রাসেলের গলায় চাকু ঠেকিয়ে তার কাছে ১০ লাখ চাঁদা দাবি করেন এবং ওই টাকা আনতে তাকে দিয়ে তার মা-বাবা ও স্ত্রীকে ফোন করান। বিষয়টি রাসেল তার এক বন্ধুকেও জানান। ওই বন্ধু ঘটনাটি মিরপুর মডেল থানায় জানালে পুলিশ অভিযান চালিয়ে ব্যবসায়ী রাসেলকে আহতাবস্থায় উদ্ধার করে।

মাস্ক পরে এসে ১৫৯ ভরি স্বর্ণ চুরি : রাজধানীর ধানমন্ডির সীমান্ত সম্ভার মার্কেটের একটি জুয়েলারি দোকান থেকে স্বর্ণ চুরির ঘটনায় ৩ চোরকে গ্রেপ্তার করেছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। ১২ জানুয়ারি দুপুরে ডিএমপি মিডিয়া সেন্টারে এক সংবাদ সম্মেলনে ডিবির যুগ্ম কমিশনার মোহাম্মদ নাসিরুল ইসলাম এ তথ্য জানান। গ্রেপ্তাররা হলেন- মো. রুবেল (২৮), সফিক ওরফে সোহেল (৩৫) ও সাদ্দাম হোসেন (৩১)। ৯ জানুয়ারি বৃহস্পতিবার থেকে ১১ জানুয়ারি শনিবার পর্যন্ত কুমিল্লার বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালিয়ে তাদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তিনি জানান, গ্রেপ্তারদের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে কুমিল্লার একটি জুয়েলারি দোকান থেকে ৫০ ভরি চোরাই স্বর্ণ উদ্ধার করা হয়। বাকি অপরাধীদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে।

উত্তরা পূর্ব থানা থেকে সাবেক ওসির পলায়ন : বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে সংঘটিত হত্যাকাণ্ডের একটি মামলায় ইন্সপেকটর শাহ আলমকে কুষ্টিয়া থেকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। ৮ জানুয়ারি বুধবার রাত ১২টার পর তাকে কুষ্টিয়া থেকে উত্তরা পূর্ব থানায় আনা হয়। ৯ জানুয়ারি বৃহস্পতিবার দুপুর ১২টায় তিনি থানা থেকে পালিয়ে যান। এ ঘটনায় থানার একজন সহকারী উপপরিদর্শককে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। এরপর ১০ জানুয়ারি উত্তরা পূর্ব থানার ওসি মহিবুল্লাহকে প্রত্যাহার করে ডিএমপি সদর দপ্তরে সংযুক্ত করা হয়েছে। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন চলাকালে উত্তরা পূর্ব থানার ওসি ছিলেন মো. শাহ আলম (৪২)। ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর কুষ্টিয়ায় ইন সার্ভিস ট্রেনিং সেন্টারে পরিদর্শক হিসেবে তাকে বদলি করা হয়েছিল। এরপর থেকে তিনি সেখানেই কর্মরত ছিলেন।

পুলিশ সূত্র জানায়, বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সময় হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় গত বছরের ২ সেপ্টেম্বর উত্তরা পূর্ব থানায় একটি হত্যা মামলা হয়। সেই মামলায় শাহ আলমকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। শাহ আলমকে ধরতে সারা দেশে রেড অ্যালার্ট জারি করেছে পুলিশ। ঢাকা মহানগর পুলিশের উত্তরা বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) রওনক জাহান বলেন, পালিয়ে যাওয়া এ আসামিকে ধরতে সব ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে।

শরীয়তপুরের জাজিরা থানার ওসির আত্মহত্যা : শরীয়তপুরের জাজিরা থানার ওসি আল-আমিনের ঝুলন্ত লাশ উদ্ধার করেছে পুলিশ। গত ৯ জানুয়ারি বেলা সোয়া ১টায় থানা ভবনের একটি কক্ষে ঝুলন্ত অবস্থায় তাকে দেখতে পান সহকর্মীরা। পরে তার লাশ উদ্ধার করা হয়। শরীয়তপুরের পুলিশ সুপার (এসপি) নজরুল ইসলাম বলেন, আল-আমিন আত্মহত্যা করেছেন। ওসি আল-আমিনের বাড়ি বরিশালের মুলাদী এলাকায়। তিনি গত ১৪ সেপ্টেম্বর জাজিরা থানায় ওসি হিসেবে যোগ দেন। জাজিরা থানা সূত্র জানায়, ওসি আল-আমিন বিষণ্ণতায় ভুগছিলেন।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close