বদরুল আলম মজুমদার
সম্পর্কের নতুন মোড় নাকি জনমত গঠন
একসময়ের জোটসঙ্গী বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর মধ্যে শুরু হয়েছে ঠাণ্ডা লড়াই। ৫ আগস্ট-পরবর্তী রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে দুই দলের নেতাদের মধ্যে দূরত্ব তৈরি হয়েছে। তবে গত কয়েক সপ্তাহে সেটি প্রকাশ্যে এসেছে দল দুটির নেতাদের পাল্টাপাল্টি বক্তব্য ও তৎপরতায়। এক দলের নেতারা আরেক দলের কর্মকাণ্ড নিয়ে বক্তব্য দিয়ে যাচ্ছেন। আওয়ামী লীগবিহীন রাজনৈতিক মাঠে দুই দলের নেতাদের বিস্ফোরক মন্তব্যের কারণে রাজনীতিতে কিছুটা উত্তেজনাও ছড়িয়েছে।
দেখা গেছে, জামায়াতে ইসলামীর শীর্ষনেতারা বিএনপিকে টার্গেট করে যেসব বক্তব্য দিচ্ছেন, তাতে দলটিকে চাঁদাবাজ-দখলবাজ তকমা দিয়ে দলটিকে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের জায়গায় বসানোর প্রয়াস বলে মনে হচ্ছে। অন্যদিকে জামায়াতের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে বক্তব্য দিয়ে দলটিকে জনমনে হেয় করার চেষ্টা করা হচ্ছে।
যদিও দল দুটির নেতারা বলছেন, এসব বাহাসের মূলে রয়েছে জনমত গঠন। তবে রাজনৈতিক এ বাহাস অনেক ক্ষেত্রে সংঘাতের দিকেও যেতে পারে বলে আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে যখন জাতীয় ঐক্য গড়ার আলোচনা চলছে, তখনই দুই দলের নেতারা দ্বন্দ্বে জড়াচ্ছেন। দীর্ঘদিনের মিত্র দল জামায়াত ও বিএনপি কেন পরস্পর দ্বন্দ্বে জড়াচ্ছে, তা নিয়ে বাড়ছে রাজনৈতিক কৌতূহল, নানা জিজ্ঞাসা।
সূত্রের দাবি, চলমান পরিস্থিতিতে দলীয় স্বার্থ বিবেচনায় নিয়ে কাজ করছে দল দুটি। এ কারণে কিছু ইস্যুতে পরস্পরের মধ্যে সন্দেহ ও অবিশ্বাস তৈরি হয়েছে। বিএনপি নেতারা মনে করছেন, অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রেখে চলছে জামায়াত। এ ঘনিষ্ঠতার সূত্র ধরে প্রশাসনসহ সর্বক্ষেত্রে তারা সুবিধাও আদায় করে নিচ্ছে। অন্তর্বর্তী সরকারের শুরুতে এ অবস্থা না থাকলেও দিন দিন তা আরো বেড়েছে। এছাড়া ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে সরকারকে খুব একটা চাপ দিচ্ছে না জামায়াত। কেননা দলটির লক্ষ্য, যতটা সময় পাবে, তাতে জাতীয় নির্বাচনের জন্য যথেষ্ট প্রস্তুতি নিয়ে রাখা।
অন্যদিকে বিএনপি চাচ্ছে যত দ্রুত সময়ে সম্ভব নির্বাচন হোক। বিএনপির শীর্ষনেতারা মনে করেন, জামায়াত যদি সরকারকে চাপ দেয়, তাতে নির্বাচন আদায় সহজ হবে। অথচ সেটি করছে না জামায়াত। উল্টো সরকার যে সংস্কারের কথা বলছে, সেটি জামায়াত অন্ধভাবে সমর্থন করছে। এ সংস্কারে কতদিন লাগবে, সেটি ঠিক জানা নেই কারোর। এভাবে সংস্কারে অন্ধ সমর্থন দেওয়া হলে নির্বাচন নিয়ে সরকার সময়ক্ষেপণ করতে পারে। তাতে বিএনপির প্রতি মানুষের সহানুভূতি তলানিতে ঠেকতে পারে। আর সেই জায়গা দখল করতে পারে জামায়াত, এমন ভয় বিএনপিকে পেয়ে বসেছে। তাই খানিকটা বেকায়দায় রয়েছে বিএনপি।
জামায়াত নেতারা বলছেন, সারা দেশে দখল-চাঁদাবাজিতে যেভাবে বিএনপি জড়িয়ে পড়ছে, তাতে জনগণ বেশ বিরক্ত। ভাগাভাগি বা আধিপত্য বিস্তার নিয়ে এরই মধ্যে ২১ জনের মতো তৃর্ণমূল নেতা খুন হয়েছে বিএনপির। গত সরকারের রেখে যাওয়া সব অপকর্মের ড্রাইভিং সিটে এখন বিএনপির নেতারা। এ অবস্থায় দেশের মানুষ বিএনপিকে আওয়ামী লীগের এক্সটেনশন মনে করছে। এসব অপকর্মের কারণে বিএনপির জনপ্রিয়তা দিনে দিনে কমছে। মানুষ এখন বিএনপির বিকল্প খুঁজতে শুরু করেছে। তাই নিজেদের ভালো রাজনীতি প্রকাশ করতে বা প্রচার করতে জামায়াত কার্পণ্য করছে না। আর এটাকেই বিএনপির বিরুদ্ধে বিষোদ্গার বলা হচ্ছে।
জামায়াত নেতারা যখন বিএনপির নানা অনিয়মের বিষয়ে কথা বলছেন, তখন বিএনপিও বসে নেই। দলটির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী গণমাধ্যমে জামায়াতের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে কথা বলতে শুরু করেছেন।
তিনি বলেন, ঘোলা পানিতে মাছ শিকারের চেষ্টা চালাচ্ছে জামায়াত। শেখ হাসিনার আমলে যারা লুট করেছে, সেই এস আলমদের উত্তরসূরি হয়ে ব্যাংক দখল করেছে অনেকে। অথচ তারাই বড় বড় কথা বলে বিএনপির নামে কলঙ্ক লেপন করছে। পাড়া-মহল্লায়, জেলায় জেলায় অনেক টার্মিনাল দখল, টেন্ডারবাজিসহ নানা কিছু দখল করেছে একটি দল। সেই রাজনৈতিক দলটিকে বলতে চাই, খুব নীরবে-নিভৃতে সব অপকর্মের সঙ্গে আপনারা জড়িত। ৫ আগস্টের পর একটি রাজনৈতিক দলের আত্মসাৎ দেখেছে জনগণ। কারা ব্যাংক আত্মসাৎ করেছে, সেটা জনগণ দেখেছে। কারা পায়ের রগ কাটে, তাদের চেনে জনগণ।
ওইদিন রাতেই রিজভীর বক্তব্যের নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়ে জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা রফিকুল ইসলাম খান এক বিবৃতিতে বলেন, রিজভীর বক্তব্য বিভ্রান্তিকর, ভিত্তিহীন ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। রিজভী জামায়াতের বিরুদ্ধে এসব কথা উচ্চারণ করে কী অর্জন করতে চান, তা জনগণের কাছে স্পষ্ট নয়। জামায়াত রগকাটা ও ঘোলা পানিতে মাছ শিকারের রাজনীতি কখনো করেনি। রিজভীর বক্তব্য চরম মিথ্যাচার ছাড়া আর কিছু নয়।
সর্বশেষ গত বৃহস্পতিবার সিলেটে এক অনুষ্ঠানে বিএনপি নেতা রিজভী বলেন, আমি সেই রাজনৈতিক দলকে বলতে চাই, ইসলামপন্থি সেই রাজনৈতিক দল, একাত্তরে আপনাদের ভূমিকা কী ছিল?
পাল্টা বিবৃতি দিয়ে তার বক্তব্যের প্রতিবাদ জানিয়ে জামায়াতে ইসলামী বলছে, তারা ঘোলা পানিতে মাছর শিকার করে না। দখল চাঁদাবাজিতে জামায়াত নেই, বরং বিএনপি নিজেদের দলীয় শৃঙ্খলা ধরে রাখতে না পেরে আবোল-তাবোল বকছে।
শেখ হাসিনার পতনের দাবিতে যুগপৎ আন্দোলনে থাকা সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে নতুন দল গঠনের ক্ষেত্রে জামায়াতে ইসলামী ভেতরে ভেতরে সহযোগিতা করেছে। তারা নির্বাচনী জোট করে বিএনপির প্রতিদ্বন্দ্বী হওয়ার প্রচেষ্টায় রয়েছে। মিত্রদের পাশাপাশি বিএনপিও এ ধরনের ধারণা করছে। ফলে বিএনপি ও জামায়াত নেতারা বাগযুদ্ধে জড়িয়েছে।
দুই দলের বাহাস নিয়ে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, রাজনৈতিক তর্কবিতর্কে আওয়ামী লীগের চুরি, লুটপাটের চিত্র নিচে পড়ে যাচ্ছে। তারা সুবিধা পেয়ে যাচ্ছে। আওয়ামী লীগ যে ধ্বংস করে দিয়েছে দেশটাকে, অর্থনীতিকে ফোকলা করে দিয়েছে, এটা মানুষ ভুলে যাচ্ছে।
বিএনপির একাধিক সূত্র বলছে, আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর জামায়াত নিজেদের জুলাই অভ্যুত্থানের বড় শক্তি হিসেবে প্রমাণের চেষ্টা করছে। সেটিও বিএনপির সঙ্গে সম্পর্কে প্রভাব ফেলছে। সংস্কার ও নির্বাচন প্রশ্নে জামায়াত এখন দ্বৈত ভূমিকা রাখার চেষ্টা করছে বলেও অভিযোগ রয়েছে বিএনপি ও মিত্রদের মধ্যে। জামায়াতে ইসলামীর নেতারা এসব অভিযোগ মানতে রাজি নন। দলটির কেন্দ্রীয় প্রচার সম্পাদক মতিউর রহমান আকন্দ বলেন, তারা দ্বৈত ভূমিকায় নেই। তারা অন্যান্য দলের মতো প্রয়োজনীয় সংস্কার করে নির্বাচন চাইছেন।
বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান শামসুজ্জামান দুদু বলেন, সমস্যা তো নেই। রাজনৈতিক বক্তব্য সহজভাবেই গ্রহণ করা ভালো। জামায়াতের আমীর ডা. শফিকুর রহমান জাসদ ছাত্রলীগ করতেন। জাসদ ছাত্রলীগ তো মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সংগঠন। সেই অর্থে জামায়াতের আমীর তো মুক্তিযুদ্ধের মানুষ। তিনি এখন যে দলে গেছেন, তাহলে স্পষ্ট করে বলুন যে, তারা অমুক সেক্টরে যুদ্ধ করেছেন।
এ প্রসঙ্গে জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল এ এইচ এম হামিদুর রহমান আযাদ বলেন, বিএনপির শীর্ষনেতারা যেসব বক্তব্য দিচ্ছেন, তা অসত্য, অনুমানভিত্তিক ও মনগড়া। তিনি বলেন, যে উদ্দেশ্যে গণঅভ্যুত্থান হয়েছে, সেই প্রয়োজনীয়তা কিন্তু এখনো শেষ হয়নি। জামায়াতের বিরুদ্ধে দখলের অভিযোগ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, দখল করা মানে অন্যের মালিকানাধীন জিনিস জোর করে নিজের করে নেওয়া। আমরা তো সে ধরনের কিছু করিনি। প্রকৃতপক্ষে সবারই উচিত আগে নিজের দিকে তাকানো। তাহলে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে দেখবে যে, সে কোথায় রয়েছে। তারপর অন্যের বিষয়ে বলা উচিত।
দীর্ঘদিনের আন্দোলনের মিত্র বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর শীর্ষনেতাদের মধ্যে বাগযুদ্ধ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক কাজী মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমান বলেন, উভয় দলই পরস্পরের বিরুদ্ধে বলছে। এগুলোর মূল লক্ষ হচ্ছে জনমত গঠন। এছাড়া ৫ আগস্টের পর পুনর্গঠিত ক্ষমতা কাঠামোয় বিএনপির লোকজন হয়তো কম স্থান পেয়েছেন। সে কারণে তাদের অসন্তোষ তৈরি হতে পারে। পুনর্গঠিত ক্ষমতা কাঠামোয় সবার সমান সুযোগ নেই। সেজন্যই পরস্পরের বাগযুদ্ধ হচ্ছে। এ সরকারের উচিত ৫ আগস্ট ঘিরে সব রাজনৈতিক দলসহ স্টেকহোল্ডারদের ক্ষমতা কাঠামোয় স্থান দেওয়া। তা না হলে ঐক্য হবে না। আমাদের অবস্থান থেকে এমন কিছু বলা ঠিক নয়, যাতে ঐক্য বিনষ্ট হয়।
"