নিজস্ব প্রতিবেদক
মৌসুমেও বাড়তি চালের দাম
দেশের বাজারে প্রতিনিয়তই বাড়ছে চালের দাম। খুচরা পর্যায়ে চালের দাম আগের সপ্তাহের চেয়ে কেজিতে ৩ থেকে ৬ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। এখন চলছে আমনের ভরা মৌসুম। নতুন ধানের চাল পুরোদমে বাজারে আসছে। কিন্তু তাতে দাম কমেনি, বরং বেড়েছে। গত দু-তিন সপ্তাহ ধরে বাজারে শাকসবজির দাম কিছু কম থাকলেও নিত্যপ্রয়োজনীয় অন্যান্য পণ্যের দাম অনেক বেশি। তার ওপর চালের দাম বাড়তে থাকায় বিপাকে রয়েছেন স্বল্প ও নির্দিষ্ট আয়ের মানুষ। এরই মধ্যে অন্তর্বর্তী সরকার চালের দাম কমাতে আমদানি শুল্ক পর্যন্ত কমিয়েছে। তাতেও বাগে আসেনি চালের বাজার। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, উৎপাদন বাধাগ্রস্ত হওয়া, হাটবাজার-সড়কে অব্যাহত চাঁদাবাজি, আমদানি করা চাল না আসা, সরকারি মজুদ কমে যাওয়া, মৌসুমে সরকারের সংগ্রহ লক্ষ্যমাত্রা ব্যর্থ হওয়াসহ বিভিন্ন কারণে অব্যাহতভাবে বাড়ছে চালের দাম।
স্বল্প আয়ের মানুষ মূলত মোটা ও মাঝারি মানের চাল কেনেন। সরু চালের ক্রেতা মধ্যবিত্ত শ্রেণি। নিম্নবিত্তের পরিবারগুলো বলছে, এখন ১ কেজি চাল কিনতে ৬০ টাকার বেশি খরচ হচ্ছে। ঢাকার কারওয়ানবাজার, রামপুরা বাজার, মোহাম্মদপুর কৃষি মার্কেট, শাহজাহানপুর ও শেওড়াপাড়া বাজার ঘুরে দেখা গেল, বেশি উৎপাদন ও বিক্রি হওয়া আটাশ চাল ৬৫ থেকে ৭০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। বেশি বেড়েছে মোটা চালের দাম। মোটা চালের মধ্যে বেশি বিক্রি হয় গুটি ও স্বর্ণা। যার কেজি ৬০ টাকার আশপাশে। বড় বাজারে এর চেয়ে কম দামে চাল পাওয়া কঠিন। তবে দরিদ্র মানুষ যেসব বাজারে যান, সেখানে ৫৫-৫৮ টাকা কেজিদরে চাল পাওয়া যায়। সেগুলো মূলত সরকারিভাবে দেওয়া রেশন ও অন্যান্য কর্মসূচির চাল, যা নানাভাবে বাজারে আসে।
মধ্যম আয়ের মানুষ বেশি কেনেন মিনিকেট চাল। ৭০ টাকা কেজির নিচে মিনিকেট চাল পাওয়া কঠিন। ভালোমানের মিনিকেট বিক্রি হয় ৭৫-৭৮ টাকায়। কাটারি ও নাজিরশাইল চালের কেজি ৮০ থেকে ৯০ টাকা। চালের দামের খোঁজ নিতে ফোন করা হলে রাজধানীর শাহজাহানপুরের চাল ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান দেলোয়ার এন্টারপ্রাাইজের মালিক দেলোয়ার হোসেন বলেন, মোটা ও চিকন সব ধরনের চালই আগের সপ্তাহের চেয়ে ৫০ কেজির বস্তায় ১০০-১৫০ টাকা বেড়েছে। তাতে কেজিতে বেড়েছে দু-তিন টাকা। অন্যদিকে রামপুরা এলাকার মেসার্স ভোলা রাইস এজেন্সির মালিক তামিম হোসেন জানান, আগের সপ্তাহের চেয়ে এ সপ্তাহে চিকন চালের দাম কেজিতে বেড়েছে ৩-৫ টাকা।
এদিকে সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) হিসাবে, সর্বশেষ এক সপ্তাহে মোটা চালের দাম বেড়েছে কেজিতে ৩ থেকে ৪ টাকা। এ সময়ে মাঝারি মানের চালের দাম বেড়েছে কেজিতে ২ টাকা। চালের বাড়তি দামের বিষয়ে রাজধানীর মিরপুরের বাসিন্দা মো. শামসুল হক বলেন, এখন বাজারে সবজি ছাড়া অন্য সব নিত্যপণ্যের দামই চড়া। আমনের ভরা মৌসুমেও কেন চালের দাম বাড়ছে, সেটাই বুঝে আসছে না।
শুধু রাজধানীর বাজারে নয়, আমনের ভরা মৌসুমে রাজশাহীতেও বেড়েছে চালের দাম। এক সপ্তাহের ব্যবধানে পাইকারি বাজারে ৫০ কেজির বস্তাপ্রতি চালের দাম বেড়েছে ৩০০ থেকে ৫০০ টাকা পর্যন্ত। এর মধ্যে আমন ধান থেকে জেলার চালকলগুলোয় যেসব চাল উৎপাদন হয়, সেগুলোর দামও বেড়েছে। এসব চালের মধ্যে কাটারি, জিরাশাইল, নাজিরশাইল ও মিনিকেটের দাম বেড়েছে কেজিতে ৬ থেকে ১০ টাকা পর্যন্ত।
ব্যবসায়ী ও চালকলের মালিকরা জানান, মৌসুম হলেও ধানের দাম বাড়তি। ধান মজুদ করেছেন অনেক মৌসুমি ব্যবসায়ী। তাদের কাছ থেকে বেশি দামে ধান কিনে চাল তৈরিতে খরচ পড়ছে বেশি। এজন্য চালের দাম বাড়িয়েছেন তারা। তবে সেটি বস্তায় ২০০ থেকে ৩০০ টাকা পর্যন্ত, যা বাজারে গিয়ে ৩০০ থেকে ৫০০ টাকা ছাড়িয়ে যাচ্ছে। এটি বেড়েছে পাইকারি ব্যবসায়ীদের কারণে।
এ অবস্থায় পাইকারি বিক্রেতারা বলছেন, চালকলের মালিকরা দাম বাড়াচ্ছেন। চালকলের মালিকরা বলছেন, মৌসুমি ব্যবসায়ীরা দাম বাড়াচ্ছেন। খুচরা ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, সব দোষ পাইকারি ব্যবসায়ীদের। কারণ চালকলের মালিকরা ১ টাকা বাড়ালে পাইকারি ব্যবসায়ীরা বাড়ায় দ্বিগুণ। তারা একে-অন্যকে দোষারোপ করলেও বাড়তি দামে চাল কিনতে কষ্ট হচ্ছে ক্রেতাদের। এ নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে ক্রেতারা বলেন, প্রতিটি জাতের চালের দাম ৬ থেকে ১০ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। মোটা থেকে চিকন সব চালের দামই চড়া। সিন্ডিকেট করে বাড়ানো হয়েছে। এজন্য একে-অন্যকে দোষারোপ করছেন।
নাজিরশাইল চালের মৌসুম এখন। এরপরও দাম চড়া কেন, মৌসুমের সময় সার্বিকভাবে চালের দাম কমল না কেন, জানতে চাইলে নওগাঁ চালকল মালিক গ্রুপের সাধারণ সম্পাদক ফরহাদ চকদার বলেন, ধানের মূল্যবৃদ্ধির কারণেই চাল উৎপাদন খরচ বেড়ে গেছে। বিদেশ থেকে পর্যাপ্ত চাল আমদানি করা গেলে চালের দাম কমতে পারে। এদিকে জুলাই অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ৮ আগস্ট অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেয়। নতুন সরকার চালের দাম কমাতে আমদানি শুল্ক অনেকটাই কমিয়েছে। সরকারিভাবে চাল আমদানির উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। কিন্তু দাম নিয়ন্ত্রণে আসেনি।
ভারত থেকে বেনাপোল বন্দর দিয়ে গত এক মাসে শুল্কমুক্ত ৬ হাজার ৫৯৬ টন চাল আমদানি হলেও বেনাপোলসহ যশোরের বাজারে দামের কোনো প্রভাব নেই। স্থানীয় বাজারে চালের দাম তো কমেইনি বরং কেজিপ্রতি ৩ থেকে ৫ টাকা বেড়েছে। ব্যবসায়ীরা বলছেন, শুল্কমুক্ত চাল বাজারে এলেও দামে কোনো প্রভাব পড়েনি বেনাপোলসহ আশপাশের বাজারগুলোয়। বেনাপোল বাজারের অন্যতম পাইকারি ব্যবসায়ী মোশারফ হোসেন জানান, বর্তমানে মোটা চাল ৫২ টাকা, হীরা চাল ৪৮, উনপঞ্চাশ চাল ৫৬, আঠাশ চাল ৫৮-৬০, জিরা মিনিকেট ৭৫, রড মিনিকেট ৬৫, ইন্ডিয়ান মিনিকেট ৭৫, বাসমতি ৯০, পাইজাম ৫৬, স্বর্ণা ৫৫ ও নাজিরশাইল ৮০ টাকা কেজিদরে খুচরা বাজারে বিক্রি হচ্ছে।
খাদ্য মন্ত্রণালয়ের হিসাবে, গত ১ জুলাই থেকে ২ জানুয়ারি পর্যন্ত ১ লাখ ১৭ হাজার টন চাল আমদানি হয়েছে। যদিও খাদ্য অধিদপ্তর থেকে গত অক্টোবরে ১০ লাখ টন চাল আমদানির প্রয়োজনীয়তার কথা সরকারকে জানানো হয়েছিল। বেসরকারি খাতে যথেষ্ট পরিমাণ চাল আমদানি না হওয়ার কারণ মার্কিন ডলারের দাম বেড়ে যাওয়ায় চাল আমদানিতে খরচ বেশি পড়ছে। সরকার নিজস্ব উদ্যোগে ভিয়েতনাম, ভারত, পাকিস্তান ও মিয়ানমার থেকে চাল আমদানির চেষ্টা করছে।
এদিকে খাদ্য অধিদপ্তরের সংগ্রহ বিভাগের পরিচালক মো. মনিরুজ্জামান বলেন, ‘চালের দাম নিয়ন্ত্রণে আমরা অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক বাজার থেকে চাল কেনার কাজ শুরু করেছি। ভারত থেকে চাল আসা শুরু হয়েছে। মিয়ানমার ও ভিয়েতনামের সঙ্গে আলোচনা চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। আর পাকিস্তানের সঙ্গে আমরা আলোচনা শুরু করেছি। সরকারিভাবে আমরা মোট ৯ লাখ টন চাল কেনার উদ্যোগ নিয়েছি।’
চালকলের মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ অটো মেজর অ্যান্ড হাসকিং মিলমালিক সমিতির কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক এইচ আর খান পাঠান বলেন, ধান ও চালের দাম অনেক বেড়ে গেছে। যে কারণে সরকারি গুদামে চাল সরবরাহের গতি হয়তো কিছুটা ধীর। তবে বেশিরভাগ চালকল মালিক সরকারের বেঁধে দেওয়া সময়ের মধ্যে চাল সরবরাহ করবেন।
বেসরকারি সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, ধারণা করা যায়, এবার বন্যা ও অন্য কারণে আমনের উৎপাদন আশানুরূপ হয়নি। সরকারের কাছেও মজুদ কম। এ কারণে বাড়তি দামের আশায় ব্যবসায়ী ও বড় কৃষকরা চাল বাজারে ছাড়ার বদলে মজুদ করছেন। চালের বাজার স্থিতিশীল রাখা না গেলে আগামী দিনগুলোয় মূল্যস্ফীতির ওপর তা আরো প্রভাব ফেলবে। তিনি বলেন, এখন সরকারের উচিত অভ্যন্তরীণ বাজার থেকে সংগ্রহ অথবা আমদানির জন্য ব্যবসায়ীদের দিকে না তাকিয়ে নিজে বড় উদ্যোগ নিয়ে আমদানি বাড়ানো।
"