নিজস্ব প্রতিবেদক
অবশেষে র্যাবের ক্ষমাপ্রার্থনা
পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে গোপন বন্দিশালা বা ‘আয়নাঘর’ থাকার কথা স্বীকার করেছে র্যাব। ভবিষ্যতে এ ধরনের অপরাধে জড়াবে না বলেও প্রতিশ্রুতি দিয়েছে তারা। গতকাল বৃহস্পতিবার সকালে রাজধানীর কারওয়ানবাজারে র্যাবের মিডিয়া সেন্টারে সাংবাদিকদের সঙ্গে মতবিনিময় সভায় এক প্রশ্নের জবাবে এসব কথা বলেন র্যাবের মহাপরিচালক এ কে এম শহিদুর রহমান।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী র্যাব। এ বাহিনীর বিরুদ্ধে ঝালকাঠির কলেজছাত্র লিমনকে গুলিতে পঙ্গু করা, ক্রসফায়ারের নামে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, গুম, নারায়ণগঞ্জে ৭ খুন- এমন অসংখ্য অভিযোগ রয়েছে। এসব ঘটনায় মানবাধিকার লঙ্ঘনের কারণে যুক্তরাষ্ট্র এরই মধ্যে র্যাবের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিটিরও এ বাহিনীর প্রতি নেতিবাচক মনোভাব রয়েছে। দেশের মানবাধিকার সংগঠনগুলোও এর বিলুপ্তি চেয়েছে। পুলিশ সংস্কার কমিশনের কাছে জনবান্ধব মানবিক পুলিশ বাহিনী গড়ে তুলতে ‘পুলিশ কমিশন’ গঠন এবং ‘র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন-র্যাব’ বিলুপ্ত চেয়েছে বিএনপি। গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর ৮ আগস্ট তিনি বাহিনীটির মহাপরিচালকের দায়িত্ব নেন। সভায় র্যাব মহাপরিচালক বলেন, র্যাব সৃষ্টির পর থেকে যেসব জনসাধারণ র্যাব সদস্যদের দ্বারা নির্যাতিত, অত্যাচারিত ও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, তাদের কাছে এবং নারায়ণগঞ্জের ৭ খুনসহ যারা র্যাবের দ্বারা হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন, তাদের পরিবারের কাছে আমরা দুঃখপ্রকাশ এবং ক্ষমাপ্রার্থনা করছি।
অপরাধের সুষ্ঠু বিচার চেয়ে র্যাব মহাপরিচালক বলেন, আমি আপনাদের নিশ্চয়তা দিচ্ছি, আমি যতদিন দায়িত্ব পালন করব এবং আমার এ কর্মকর্তারা যারা দায়িত্বে আছেন, তারা কখনো কারো নির্দেশে গুম, খুনের মতো ফৌজদারি অপরাধে জড়িত হবে না। র্যাব সদস্যদের দ্বারা নির্যাতন ও অত্যাচারের মতো ঘটনাগুলোর সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে যেন বিচার হয়, সেটা আমরা প্রত্যাশা করি। বিচারের মাধ্যমে দায়মুক্তি চেয়ে র্যাবের মহাপরিচালক বলেন, অন্তর্বর্তী সরকার গুমের ঘটনা তদন্তে কমিশন করেছে। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল এ ধরনের অপরাধ আমলে নিয়ে বিচারকার্য পরিচালনা করছে। সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ তদন্তের মাধ্যমে র্যাবের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ আছে, সেগুলোর বিচার হবে বলে জানান তিনি। এভাবেই র্যাবের দায়মুক্তি সম্ভব বলেও জানান তিনি। বাহিনীর সদস্যদের বিষয়ে কঠোর বার্তা দিয়ে র্যাব মহাপরিচালক বলেন, যদি কোনো সদস্য নিজ দায়িত্বে কোনো ধরনের অপরাধমূলক কার্যকলাপে জড়িত হয়, তাদের বিরুদ্ধে আমরা কঠোর আইনগত ব্যবস্থা নেব। যেটা ৫ আগস্ট পরবর্তী সময়ে আমরা নিয়ে আসছি। র্যাবের গোপন বন্দিশালা বা আয়নাঘরের অস্তিত্ব নিয়ে বাহিনীর মহাপরিচালকের কাছে জানতে চেয়েছিলেন সাংবাদিকরা। জবাবে তিনি বলেন, ‘র্যাবে আয়নাঘরের যে বিষয়টি এসেছে, সেটি ছিল, আছে। কমিশন (গুমের ঘটনা তদন্তে কমিশন) আমাদের নির্দেশ দিয়েছে যা যে অবস্থায় আছে, সেই অবস্থায় রাখার জন্য। কোথাও কোনো ধরনের পরিবর্তন বা পরিবর্ধন যেন না করা হয়, যা যেভাবে ছিল সেগুলো আমরা ওইভাবেই রেখেছি।’
বিভিন্ন মহল থেকে র্যাব বিলুপ্তির প্রস্তাবের বিষয়ে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে বাহিনীটির প্রধান বলেন, আমি র্যাবে কর্মরত আছি। র্যাবে আমরা যতদিন আছি, আমাদের ওপর যে দায়িত্ব তা নিষ্ঠার সঙ্গে, আন্তরিকতার সঙ্গে পালন করব। বিলুপ্তির ব্যাপারে সরকার যে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে, সেটাই শিরোধার্য। সরকারের সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় আমরা থাকলাম। সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ড নিয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে র্যাব মহাপরিচালক বলেন, মামলাটি হাইকোর্টের আদেশে উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন তদন্ত কমিটির কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। এ কমিটিতে র্যাবের প্রতিনিধিও রাখা হয়েছে। এ ব্যাপারে র্যাবের সার্বিক সহযোগিতা অব্যাহত থাকবে।
র্যাবের নিজস্ব একটি আইন করার কথাও ভাবা হচ্ছে জানিয়ে সংস্থাটির ডিজি বলেন, ‘র্যাবের নিজস্ব কোনো আইন নেই। পুলিশ আইনে র্যাব প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। র্যাবের জন্য আমরা আলাদা একটি আইন করার চিন্তাভাবনা করছি। এছাড়া আর কোন কোন বিষয় সংস্কার করা যায়, সেজন্য গণমাধ্যম ও জনসাধারণের মতামতের ভিত্তিতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া হবে।’ র্যাবের পোশাক পরিবর্তন প্রসঙ্গে এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘পোশাকের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে যিনি পোশাকটি পরবেন তারা। আমরা প্রতিদিন ইউনিফর্ম পরি, আপনারা প্রতিদিন প্যান্ট শার্ট, স্যুট, পায়জামা-পাঞ্জাবিসহ বিভিন্ন পোশাক পরেন। একজন ভালো ব্যক্তি যে পোশাকই পরেন না কেন, তার কাছে আমরা ভালো জিনিস পাবো। কিন্তু একজন খারাপ ব্যক্তি যে পোশাকই পরেন না কেন, আমরা ভালো জিনিস কিন্তু পাব না। এখানে পোশাকের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে ব্যক্তির মানসিকতা। তারপরও আমরা র্যাবের পোশাক পরিবর্তনের বিষয়টি বিবেচনায় রেখেছি। বর্তমানে দেশে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়ন হয়েছে, তবে প্রত্যাশিত জায়গায় এখনো পৌঁছায়নি উল্লেখ করে র্যাব ডিজি বলেন, আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে র্যাব তার দায়িত্ব আন্তরিকতা ও নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করবে।
গত ৫ আগস্ট ক্ষমতার পটপরিবর্তনের পর থেকে এখন পর্যন্ত বিভিন্ন অপরাধে জড়িত থাকার অভিযোগে র্যাবের ১৬ সদস্যকে আটক করা হয়েছে বলেও জানান র্যাব ডিজি। বলেন, গত ৫ আগস্টের পর আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটে। পরে র্যাবের সদস্যরা আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে কাজ শুরু করে। এ কাজ করতে গিয়ে র্যাবের ১৬ সদস্য বিভিন্ন অপরাধে সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে। তাদের বিরুদ্ধে ডাকাতি, চাঁদাবাজি, মাদক ব্যবসায় সম্পৃক্ততা ও ছিনতাইয়ের অভিযোগ পাওয়া গেছে। এসব অপরাধে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। তিনি বলেন, প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে র্যাবের ৫৮ কর্মকর্তা ও ৪ হাজার ২৩৫ সদস্যকে বিভিন্ন অপরাধে শাস্তির আওতায় আনা হয়েছে। র্যাব মহাপরিচালক আরো বলেন, ৫ আগস্টের পর আমাদের কিছু চ্যালেঞ্জ ছিল। আনসার বাহিনীর সদস্যদের মধ্যে বিদ্রোহ, গার্মেন্ট সেক্টরে অস্থিতিশীলতা, পল্লী বিদ্যুৎ সমিতিতে কর্মবিরতিসহ আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে কাজ করে যাচ্ছে র্যাব। প্রতিষ্ঠার পর থেকে এখন পর্যন্ত ১৪ হাজার ৫০০ আসামিকে গ্রেপ্তার করেছে র্যাব। পাশাপাশি ২০ হাজার অস্ত্রও উদ্ধার করেছে সংস্থাটি।
র্যাব বিলুপ্তির সুপারিশ বিএনপির : এর আগে মানবাধিকার লঙ্ঘন ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের অভিযোগ তুলে পুলিশ সংস্কার কমিশনের কাছে র্যাব বিলুপ্ত করার সুপারিশ করে বিএনপি। গত মঙ্গলবার গুলশানে দলের চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য হাফিজ উদ্দিন আহমেদ বলেন, র্যাবের কার্যক্রম বিশ্লেষণ করে আমাদের কমিটি র্যাব বিলুপ্তির সুপারিশ করেছে। ওই সময় তিনি বলেছিলেন, এ বাহিনী এরই মধ্যে জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে সমালোচনার মুখে পড়েছে। হাফিজ উদ্দিন বলেন, মানবাধিকার লঙ্ঘনের কারণে যুক্তরাষ্ট্র এরই মধ্যে র্যাবের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিটিরও এর প্রতি নেতিবাচক মনোভাব রয়েছে। বিএনপি পুলিশ সংস্কার কমিশনের কাছে আরো যেসব সুপারিশ করেছে, তার মধ্যে রয়েছে- পুলিশ কমিশন গঠন, উপজেলা পর্যায়ে নাগরিক কমিটি গঠন, ক্ষমতার অপব্যবহার রোধে গ্রেপ্তারের আগে যথাযথ ডকুমেন্টেশন প্রক্রিয়া চালু করা। বিএনপি সরকারের আমলে ২০০৪ সালের ২৬ মার্চ র্যাব প্রতিষ্ঠিত হয়।
পিচ্চি হান্নানকে দিয়ে বিচারবহির্ভূত হত্যায় হাতেখড়ি : ২০০৪ সালের ২৬ জুন তালিকাভুক্ত শীর্ষ সন্ত্রাসী পিচ্চি হান্নান কথিত বন্দুকযুদ্ধে (ক্রসফায়ার) নিহত হওয়ার মধ্য দিয়ে বিচারবহির্ভূত হত্যায় হাতেখড়ি র্যাবের। এরপর একের পর ক্রসফায়ারের নামে বিচারবহির্ভূত হত্যায় নাম আসতে থাকে পুলিশের বিশেষায়িত এই ইউনিটের। শুরুর দিকে চিহ্নিত সন্ত্রাসী বা অপরাধীরা ক্রসফায়ারের তালিকায় থাকলেও শেষে তা গিয়ে ঠেকে রাজনৈতিক, ব্যবসায়িক এবং বিরোধী মত ও ব্যক্তিগত শত্রু দমনের ক্ষেত্রেও। যার একটি উদাহরণ সাধারণ কলেজছাত্র লিমনকে গুলি করে পঙ্গু বানিয়ে দেওয়া। এরপর সন্ত্রাসী সাজিয়ে তাকে হেনস্তা করা। নারায়ণগঞ্জে ৭ খুনে র্যাবের কর্মকর্তাদের সংশ্লিষ্টতা এবং কক্সবাজারে আওয়ামী লীগ নেতা ও টেকনাফ পৌরসভার ওয়ার্ড কাউন্সিলর একরামুল হককে গুলি করে হত্যাসহ ফি বছর একের পর এক বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ঘটিয়ে বিতর্কিত হয়েছে পুলিশের এ বিশেষ ইউনিট। ২০০৪ সালে র্যাব গঠনের পর চলতি বছরের জুন পর্যন্ত পুলিশের এ বিশেষ ইউনিটের সদস্যদের বিরুদ্ধে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ঘটানোর প্রায় ২ হাজার ৯৫৪টি অভিযোগ উঠেছে। মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) এ ধরনের হত্যাকাণ্ড ধারাবাহিকভাবে পর্যবেক্ষণ করে। সংবাদপত্রে প্রকাশিত প্রতিবেদন এবং নিজেদের তথ্যানুসন্ধানের ভিত্তিতে এ তালিকা করেছে আসক।
মানুষ গুমে সিদ্ধহস্ত : ক্রসফায়ার ছাড়াও র্যাব সমালোচিত ও নিন্দিত হয়েছে গুমসংশ্লিষ্টতার কারণে। বিএনপি নেতা ইলিয়াস আলী এবং সাবেক যুবলীগ নেতা শীর্ষ সন্ত্রাসী লিয়াকত হোসেনসহ কয়েকশ চেনা-অচেনা ব্যক্তিকে গুমের সঙ্গে র্যাবের সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ ও কিছু ক্ষেত্রে প্রমাণ রয়েছে। গুমের এ তালিকা থেকে বাদ যায়নি ভিন্নমতের মানুষ, দলীয় প্রতিদ্বন্দ্বী বা রাজনীতিক কেউই। ২০০৮ সালের ২৫ নভেম্বর ভোরে লালমাটিয়ার বাসা থেকে তৎকালীন যুবলীগ নেতা লিয়াকত হোসেনকে র্যাব তুলে নিয়ে যায়। এরপর আজ পর্যন্ত তার আর খোঁজ মেলেনি। এখনো পরিবারের সদস্যরা তার ফিরে আসার অপেক্ষায় দিন গুনছে। লিয়াকতের পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা হয়েছে দেশ রূপান্তরের। তার একমাত্র বোন বলেন, ‘সেদিন আমার ভাইকে যারা তুলে নিয়ে গিয়েছিল, তারা সবাই র্যাবের সদস্য ছিলেন। সেদিনের পর তো আর আমার ভাই ফিরে এলো না।’
কলেজছাত্র লিমন হোসেনকে গুলি : ২০১১ সালের ২৩ মার্চ ঝালকাঠির রাজাপুর উপজেলার সাতুরয়া গ্রামে বাড়ির কাছের মাঠে গরু আনতে গিয়ে কলেজছাত্র লিমন হোসেন র্যাবের গুলিতে আহত হন। গুরুতর আহত লিমনকে ভর্তি করা হয় বরিশাল শেবাচিম হাসপাতালে। সেখান থেকে নেওয়া হয় ঢাকা পঙ্গু হাসপাতালে। যথাযথ চিকিৎসা না হওয়ায় ২৭ মার্চ লিমনের বাম পা হাঁটু থেকে কেটে ফেলা হয়। এদিকে লিমনকে সন্ত্রাসী সাজিয়ে র্যাবের ডিএডি লুৎফর রহমান বাদী হয়ে লিমন হোসেন, শীর্ষ সন্ত্রাসী মোরসেদ জমাদ্দার এবং তার সহযোগীসহ আটজনের নামে দুটি মামলা করেন। এর একটি অস্ত্র আইনে এবং অন্যটি সরকারি কাজে বাধাদানের অভিযোগে। এ পরিস্থিতিতে লিমনের মা হেনোয়ারা বেগম বাদী হয়ে বরিশাল র্যাব-৮-এর ছয় সদস্যের বিরুদ্ধে ছেলেকে গুলি করে হত্যাচেষ্টার অভিযোগে ২০১১ সালের ১০ এপ্রিল ঝালকাঠির জ্যেষ্ঠ বিচারিক আদালতে একটি নালিশি মামলা করেন।
আদালতের নির্দেশের ১৬ দিন পর ২৬ এপ্রিল রাজাপুর থানায় র্যাবের ডিএডি লুৎফর রহমানসহ ছয়জনের নামে মামলাটি রেকর্ড করা হয়। অন্য আসামিরা হলেন- করপোরাল মাজহারুল ইসলাম, কনস্টেবল আ. আজিজ, নায়েক মুক্তাদির হোসেন, সৈনিক শ্রী প্রহ্লাদ চন্দ্র এবং সৈনিক কার্তিক কুমার বিশ্বাস। পুলিশ ওই মামলায় ২০১২ সালের ১৪ আগস্ট র্যাব সদস্যদের নির্দোষ উল্লেখ করে আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করে। লিমনের মা হেনোয়রা বেগম প্রতিবেদনের বিরুদ্ধে সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে ২০১২ সালের ৩০ আগস্ট নারাজি দাখিল করেন। দীর্ঘ শুনানি শেষে ২০১৩ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি নারাজি আবেদন খারিজ করে দেন সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মো. শাহীদুল ইসলাম। এ আদেশের বিরুদ্ধে ২০১৩ সালের ১৮ মার্চ ঝালকাঠি জেলা ও দায়রা জজ আদালতে রিভিশন আবেদন করেন লিমনের মা। লিমনের মায়ের আইনজীবী আক্কাস সিকদার জানান, রিভিশন মঞ্জুর হওয়ায় লিমন হত্যাচেষ্টায় র্যাব সদস্যদের বিরুদ্ধে মামলাটি পুনরুজ্জীবিত হলো। মামলার নথি অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ আদালত থেকে ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে যাওয়ার পর ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের বিচারক সিদ্ধান্ত দেবেন মামলাটি কোন সংস্থা তদন্ত করবে। লিমনসহ আটজনের বিরুদ্ধে র্যাব অস্ত্র আইনে এবং সরকারি কাজে বাধাদানের অভিযোগে যে দুটি মামলা করেছিল, ওই মামলা থেকে লিমনের নাম প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়েছে।
নারায়ণগঞ্জে ৭ খুন : ২০১৪ সালের ২৭ এপ্রিল ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ লিংক রোড থেকে অপহৃত হন নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের কাউন্সিলর নজরুল ইসলাম, আইনজীবী চন্দন সরকারসহ ৭ জন। তিন দিন পর ৩০ এপ্রিল শীতলক্ষ্যা নদীতে একে একে ভেসে ওঠে ছয়টি লাশ, পরদিন মেলে আরেকটি লাশ। নিহত অন্য ব্যক্তিরা হলেন- নজরুলের বন্ধু মনিরুজ্জামান স্বপন, তাজুল ইসলাম, লিটন, গাড়িচালক জাহাঙ্গীর আলম ও চন্দন সরকারের গাড়িচালক মো. ইব্রাহীম। ঘটনার এক দিন পর কাউন্সিলর নজরুলের স্ত্রী সেলিনা ইসলাম বাদী হয়ে আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতা (পরে বহিষ্কৃত) নূর হোসেনসহ ছয়জনের নাম উল্লেখ করে ফতুল্লা মডেল থানায় মামলা করেন। আইনজীবী চন্দন সরকার ও তার গাড়িচালক ইব্রাহিম হত্যার ঘটনায় ১১ মে একই থানায় আরেকটি মামলা হয়। এ মামলার বাদী চন্দন সরকারের জামাতা বিজয় কুমার পাল। পরে দুটি মামলা একসঙ্গে তদন্ত করে পুলিশ। দুই মামলায় ২০১৮ সালের ১৬ জানুয়ারি নারায়ণগঞ্জের জেলা ও দায়রা জজ আদালত রায় দেন। রায়ে র্যাবের সাবেক ১৬ কর্মকর্তা-সদস্য এবং নারায়ণগঞ্জের সাবেক ওয়ার্ড কাউন্সিলর নূর হোসেন ও তার অপরাধজগতের ৯ সহযোগীসহ ২৬ জনের মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেন আদালত। এছাড়া র্যাবের আরো ৯ জন সাবেক কর্মীকে বিভিন্ন মেয়াদে সশ্রম কারাদণ্ড দেওয়া হয়।
কী ঘটেছিল সেদিন : ২০১৪ সালের ২৭ এপ্রিল ঢাকা-নারায়ণগঞ্জের লিংক রোডের লামাপাড়া এলাকায় র্যাবের সদস্যরা চেকপোস্ট বসিয়ে কাউন্সিলর নজরুলের গাড়ি থামান। র্যাব গাড়ি থেকে নজরুল, তার তিন সহযোগী ও গাড়িচালককে তুলে নিয়ে যায়। এ সময়ে ওই পথ দিয়ে যাচ্ছিলেন আইনজীবী চন্দন সরকার। তিনি অপহরণের বিষয়টি দেখে ফেলায় তাকে ও তার গাড়িচালককেও র্যাব তুলে নিয়ে যায়। ওই রাতেই তাদের সবাইকে হত্যা করা হয়। এরপর পেট কেটে এবং ইটের বস্তা বেঁধে সবার লাশ শীতলক্ষ্যা নদীতে ডুবিয়ে দেওয়া হয়। ৩০ এপ্রিল ছয়জন ও পরদিন একজনের লাশ ভেসে ওঠে। এর এক সপ্তাহের মধ্যে এ ঘটনায় র্যাব-১১-এর অধিনায়ক তারেক সাঈদসহ তিন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার যুক্ততার তথ্য প্রকাশ পায়, টাকার বিনিময়ে হত্যার অভিযোগ ওঠে। একসঙ্গে সাতজনকে ঠাণ্ডামাথায় হত্যা ও গুমের নৃশংসতায় শিউরে ওঠেন মানুষ। তারেক সাঈদ তৎকালীন ত্রাণ ও দুর্যোগমন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়ার জামাতা হওয়ায় বিষয়টি ভিন্ন মাত্রা পায়। একই সময়ে ঘটনার অন্যতম অভিযুক্ত নূর হোসেনের সঙ্গে নারায়ণগঞ্জের সাংসদ শামীম ওসমানের একটি টেলিকথোপকথন প্রকাশ পায়- যাতে নূর হোসেন ভারতে পালাতে শামীম ওসমানের সহায়তা চান। এরপর নূর হোসেন পালিয়ে যান ভারতে। গণমাধ্যমে ও সারা দেশে বিষয়টি হয়ে ওঠে আলোচনার প্রধান বিষয়বস্তু।
"