নিজস্ব প্রতিবেদক

  ১২ ডিসেম্বর, ২০২৪

লুট হওয়া দেড় হাজার আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার হয়নি এখনো

* জুলাই-আগস্টে থানা-ফাঁড়ি থেকে ৫৭৫০ অস্ত্র লুট * অস্ত্র চলে গেছে অপরাধীদের হাতে

জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের সময় পুলিশের লুট হওয়া প্রায় দেড় হাজার আগ্নেয়াস্ত্র ও আড়াই লাখের বেশি গোলাবারুদ এখনো উদ্ধার হয়নি। লুট হওয়া অস্ত্র অপরাধীদের হাতে চলে গেছে; অপরাধেও ব্যবহৃত হচ্ছে। গত সপ্তাহে মুন্সীগঞ্জে এক তরুণীকে হত্যায় থানা থেকে লুট হওয়া পিস্তল ব্যবহার করা হয়। এছাড়া গত অক্টোবর-নভেম্বরে রাজধানীর মোহাম্মদপুরের জেনেভা ক্যাম্পে গোলাগুলিসহ একাধিক হত্যাকাণ্ডে লুট হওয়া আগ্নেয়াস্ত্র-গুলি ব্যবহার করা হয়েছে বলে ধারণা পুলিশের।

পুলিশের একাধিক কর্মকর্তা বলেন, লুট হওয়া আগ্নেয়াস্ত্র-গোলাবারুদ জেলপলাতক আসামি, দাগী সন্ত্রাসী, উগ্রপন্থি, চরমপন্থি, কিশোর গ্যাংয়ের হাতে চলে যাওয়ার বিষয়টি ভয় ও আতঙ্কের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতন হয়। পুলিশ সদর দপ্তর সূত্র জানায়, সরকার পতনের পর বিভিন্ন থানা-ফাঁড়িসহ পুলিশের নানা স্থাপনা থেকে ৫ হাজার ৭৫০টি আগ্নেয়াস্ত্র লুট হয়। গোলাবারুদ লুট হয় ৬ লাখ ৫১ হাজার ৬০৯টি। লুট হওয়া আগ্নেয়াস্ত্র-গোলাবারুদের মধ্যে আছে বিভিন্ন ধরনের রাইফেল, এসএমজি (স্মল মেশিনগান), এলএমজি (লাইট মেশিনগান), পিস্তল, শটগান, গ্যাসগান, কাঁদানে গ্যাস লঞ্চার, কাঁদানে গ্যাসের শেল, কাঁদানে গ্যাসের স্প্রে, সাউন্ড গ্রেনেড ও বিভিন্ন বোরের গুলি।

লুট হওয়া আগ্নেয়াস্ত্র-গোলাবারুদ উদ্ধারে গত ৪ সেপ্টেম্বর যৌথ অভিযান শুরু হয়। পুলিশ সদর দপ্তর বলছে, এ অভিযানে ৩ ডিসেম্বর পর্যন্ত ৪ হাজার ৩৩১টি আগ্নেয়াস্ত্র ও ৩ লাখ ৮৮ হাজার ৪৫৬টি গোলাবারুদ উদ্ধার করা হয়। তবে এখনো ১ হাজার ৪১৯টি আগ্নেয়াস্ত্র ও ২ লাখ ৬৩ হাজার ১৫৩টি গোলাবারুদ উদ্ধার করা যায়নি। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পুলিশের একাধিক কর্মকর্তা বলেন, জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের সময় দেশের বিভিন্ন কারাগার থেকে পালানো ৭০০ আসামি এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে। পুলিশের লুট হওয়া আগ্নেয়াস্ত্র-গোলাবারুদ অপরাধীদের হাতে চলে গেছে। এ দুটি বিষয় জনমনে উদ্বেগ ও নিরাপত্তাহীনতা তৈরি করেছে। আগ্নেয়াস্ত্র-গোলাবারুদ উদ্ধার করা না গেলে, জেলপলাতক আসামিদের ধরতে না পারলে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হওয়ার আশঙ্কা আছে।

পুলিশ সদর দপ্তর সূত্র জানায়, সারা দেশে ৬৬৪টি থানা আছে। ৫ আগস্ট ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন থানা, ফাঁড়ি, বক্সসহ পুলিশের বিভিন্ন ইউনিট-স্থাপনায় হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে। পুড়িয়ে দেওয়া হয় থানা-পুলিশের কাজে ব্যবহৃত গাড়ি। এসব জায়গা থেকে পুলিশের আগ্নেয়াস্ত্র-গোলাবারুদ লুট হয়। কার্যত ৫ আগস্ট দুপুরের পর সারা দেশে পুলিশি কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়। পুলিশ সদস্যরা থানায় যেতে সাহস পাননি। একপর্যায়ে পুলিশের বিভিন্ন স্থাপনা পাহারা দেওয়ার জন্য আনসার সদস্য মোতায়েন করা হয়। ১৩ আগস্ট ঢাকাসহ সারা দেশে থানার কার্যক্রম আবার শুরু হয়।

লুট হওয়া আগ্নেয়াস্ত্র দিয়ে মানুষ খুন : মুন্সীগঞ্জের শ্রীনগর উপজেলার দোগাছি এলাকায় গত শনিবার সকালে এক্সপ্রেসওয়ের সার্ভিস লেন থেকে শাহিদা আক্তার (২২) নামে এক তরুণীর গুলিবিদ্ধ লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। এ ঘটনায় শাহিদার ‘প্রেমিক’ তৌহিদ শেখ ওরফে তন্ময়কে গ্রেপ্তার করা হয়। পুলিশ বলছে, তদন্তে বেরিয়ে আসে, ঢাকার ওয়ারী থানা থেকে লুট করা পিস্তল দিয়ে শাহিদাকে গুলি করে হত্যা করেন তৌহিদ। তার তথ্যের ভিত্তিতে হত্যায় ব্যবহৃত পিস্তলটি উদ্ধার করা হয়। মুন্সীগঞ্জের পুলিশ সুপার মুহম্মদ শামসুল আলম সরকার বলেন, গত ৫ আগস্ট ওয়ারী থানা থেকে লুট করার পর পুলিশের পিস্তলটি বাসায় লুকিয়ে রেখেছিলেন বলে স্বীকার করেছেন তৌহিদ। প্রেম-বিয়েসংক্রান্ত ঝামেলার জেরে তিনি শাহিদাকে গুলি চালিয়ে হত্যা করেন। তৌহিদ আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। তিনি এখন কারাগারে।

গত অক্টোবর-নভেম্বরে রাজধানীর মোহাম্মদপুরের জেনেভা ক্যাম্পে গোলাগুলি ও একাধিক হত্যাকাণ্ড ঘটে। এসব ঘটনায় লুট হওয়া আগ্নেয়াস্ত্র-গুলি ব্যবহার করা হয়ে থাকতে পারে বলে ধারণা পুলিশের। মোহাম্মদপুর থানার ওসি আলী ইফতেখার হাসান বলেন, জেনেভা ক্যাম্পে গোলাগুলি-হত্যাকাণ্ডের পর যৌথ বাহিনী অভিযান চালায়। অভিযানে বেশকিছু পিস্তল, রিভলবার ও ধারালো অস্ত্র উদ্ধার হয়। উদ্ধার হওয়া পিস্তল-রিভলবারগুলো থানায় জমা রাখা সাধারণ মানুষের লাইসেন্স করা আগ্নেয়াস্ত্র হতে পারে। তবে থানায় কাগজপত্র না পাওয়ায় বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া যায়নি। ৫ ডিসেম্বর দুপুরে কুষ্টিয়া শহরের শিশুপার্কের পেছনের নালা পরিষ্কার করার সময় এক পরিচ্ছন্নতাকর্মী একটি শটগান, ছয়টি গুলি ও একটি গুলির খোসা পান। কুষ্টিয়া মডেল থানায় খবর দিলে পুলিশ এসে এগুলো নিয়ে যায়। কুষ্টিয়া মডেল থানার (ওসি শিহাবুর রহমান বলেন, ‘শটগান-গুলি কুষ্টিয়া জেলা পুলিশের। এটি লুট হয়েছিল।’

উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা : গত সপ্তাহে কারা অধিদপ্তরের মহাপরিদর্শক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সৈয়দ মো. মোতাহের হোসেন এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার আন্দোলনের সময় দেশের বিভিন্ন কারাগার থেকে ২ হাজার ২০০ আসামি পালান। তাদের মধ্যে ১ হাজার ৫০০ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তবে এখনো ৭০০ আসামি পলাতক। তাদের মধ্যে জঙ্গি, ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত, শীর্ষ সন্ত্রাসীর মতো অতি ঝুঁকিপূর্ণ ৭০ আসামি রয়েছেন। এছাড়া কারাগার থেকে এখন পর্যন্ত আলোচিত ১৭৪ আসামিকে মুক্তি দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে ১১ জন শীর্ষ সন্ত্রাসীও মুক্তি পেয়েছেন। জেলপলাতক ৭০০ আসামি এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকা, শীর্ষ সন্ত্রাসীসহ আলোচিত ১৭৪ আসামি কারাগার থেকে মুক্তি পাওয়ার বিষয়টি নিয়ে একাধিক পুলিশ কর্মকর্তা উদ্বেগ জানিয়েছেন।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এ কর্মকর্তারা বলেন, লুট হওয়া আগ্নেয়াস্ত্র-গোলাবারুদ জেলপলাতক আসামি ও দাগী সন্ত্রাসীদের হাতে চলে যাওয়ার ব্যাপাটি উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। মঙ্গলবার পুলিশ সদর দপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক (ক্রাইম অ্যান্ড অপারেশনস) মো. আকরাম হোসেন বলেন, পুলিশের লুট হওয়া অস্ত্রের বেশির ভাগ উদ্ধার করা হয়েছে। অস্ত্রের খোঁজে বিভিন্নভাবে অভিযান চালানো হচ্ছে। অভিযানের মুখে দুর্বৃত্তরা অস্ত্র ফেলে যেতে বাধ্য হচ্ছে। সেগুলো পুলিশ উদ্ধার করছে। বাকি অস্ত্র উদ্ধারে সারা দেশে পুলিশের কমিটি গঠন করা হয়েছে। এ কমিটি কাজ করছে। জেলপলাতক আসামি ও জামিনে থাকা সন্ত্রাসীদের ওপর পুলিশের নজরদারি আছে। তারা যাতে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটাতে না পারেন, সেজন্য পুলিশ সতর্ক রয়েছে।

পুলিশের লুট হওয়া যেসব আগ্নেয়াস্ত্র-গোলাবারুদ এখনো উদ্ধার করা যায়নি, তা আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির অন্যতম কারণ হতে পারে বলে মনে করেন মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি অ্যান্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগের অধ্যাপক মুহাম্মদ উমর ফারুক। তিনি বলেন, লুট হওয়া অস্ত্রগুলো অপরাধীদের কাছে চলে যাওয়ায় জনজীবনে নিরাপত্তার হুমকি দেখা দিয়েছে। এসব অস্ত্র দিয়ে অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে। যৌথবাহিনীর যে অভিযান চলছে, তা আরো জোরদার করতে হবে। নজরদারি বাড়াতে হবে। সন্দেহভাজন ব্যক্তিদের চিহ্নিত করে এলাকাভিত্তিক তল্লাশি চালাতে হবে। অতীতে যারা সহিসংতা ও অপরাধের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, তাদের সন্দেহভাজনের আওতায় নিয়ে আসতে হবে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে কয়েকটি স্তরে বিভক্ত হয়ে এলাকাভিত্তিক ও ঘরে ঘরে অভিযান না চালালে লুট হওয়া অস্ত্র উদ্ধার কঠিন হবে।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close