প্রতিদিনের সংবাদ ডেস্ক
পরাজয় নিশ্চিত জেনে ফরমান আলির বার্তা
আজ ১১ ডিসেম্বর। ১৯৭১ সালের এদিন সন্ধ্যায় গোবিন্দগঞ্জে হানাদার বাহিনীর শক্তিশালী ঘাঁটিতে আক্রমণ ও সারা রাত যুদ্ধ শেষে ভোরে গোবিন্দগঞ্জের পতন ঘটে। জাতিসংঘের অনুরোধে বিদেশি নাগরিকদের স্থানান্তরের জন্য ঢাকা বিমানবন্দরে সাময়িক সময়ের জন্য বিমান হামলা স্থগিত হয়। পরাজয় নিশ্চিত জেনে যুদ্ধবিরতির জন্য প্রাদেশিক সরকারের সামরিক উপদেষ্টা মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলি জাতিসংঘ সদর দপ্তরে জরুরি বার্তা পাঠান।
জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে উত্থাপিত যুদ্ধবিরতির এ প্রস্তাব মেনে নিতে জোর দাবি জানায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। এদিন হোয়াইট হাউসের এক মুখপাত্র বলেন, জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের প্রস্তাব মেনে নেওয়া ভারত-পাকিস্তান উভয়ের জন্যই অত্যাবশ্যক। একাত্তরের এই দিনে জামালপুর ময়মনসিংহ, গাইবান্ধা, চণ্ডীপুর, টাঙ্গাইল, কুষ্টিয়া, ফুলছড়িহাট ও বাহাদুরবাদ ঘাটসহ মুক্ত হয় অবরুদ্ধ বাংলাদেশের ১২টি গুরুত্বপূর্ণ এলাকা। মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনীর ছয় দিনব্যাপী অবরোধ ও প্রচণ্ড যুদ্ধের পর এদিন ভোরে জামালপুর হানাদারমুক্ত হয়। জামালপুর গ্যারিসনে অবস্থানকারী পাকিস্তানি বাহিনী ২১ বেলুচ রেজিমেন্টের ছয় কর্মকর্তা ও ৫২২ সেনা যৌথবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করে। হানাদারদের মধ্যে নিহত হন ২১২ জন, আর আহত হন ২০০ জন।
এদিন মুক্ত যশোরের জনসভায় অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেন। এগুলো হলো- যুদ্ধাপরাধীদের বিচার, ২৫ মার্চের আগের মালিককে সম্পত্তি ফেরত দান, সব নাগরিকের সমঅধিকার এবং চারটি রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধকরণ। সৈয়দ নজরুল ও তাজউদ্দীন এক সংবাদ সম্মেলনে যশোর সার্কিট হাউসে বলেন, ‘আমরা তাড়াতাড়ি সংবিধান রচনা করব, যা ২৪ বছরে পাকিস্তান করতে পারেনি।’ মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনীর যৌথ অভিযানে পাকিস্তানি হানাদার ঘাতকদের পরাজয় যখন সুনিশ্চিত, তখন মার্কিন সপ্তম নৌবহরের টাস্কফোর্স বঙ্গোপসাগর অভিমুখে রওনা দেয়। এদিন ইস্টার্ন কমান্ডের প্রধান লে. জেনারেল নিয়াজির কাছে এক বার্তায় পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান জানান, মার্কিন সপ্তম নৌবহর বাংলাদেশের উদ্দেশে রওনা দিয়েছে। চীনও যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছে। এদিন বিকেল ৩টা থেকে ঢাকায় অনির্দিষ্টকালের জন্য কারফিউ জারি করা হয়।
মুক্তিবাহিনীর গেরিলারা ঢাকার প্রত্যেক এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে। ঢাকার চারপাশে মিত্রবাহিনী নির্দিষ্ট এলাকায় রাতে ছত্রীসেনা অবতরণ করে। মিত্রবাহিনী ও মুক্তিবাহিনী বীরবিক্রমে ঢাকা অভিমুখে এগিয়ে আসে। ১১ ডিসেম্বর মুজিবনগর সরকার থেকে প্রকাশিত জনগণের উদ্দেশে এক নির্দেশনায় বলা হয়, ‘ওই খুনিগুলোকে (ধরা পড়া বা সারেন্ডার করা পাকিস্তানি সৈন্য) তোমরা মেরে ফেল না, মুক্তিবাহিনীর হাতে ওদের হস্তান্তর করো। হয়তো ওদের বিনিময়ে আমরা জাতির পিতাকে উদ্ধার করতে পারব।’ এদিন ঢাকার উপকণ্ঠে মিত্রবাহিনীর ছত্রীসেনার অবতরণ এবং বিভিন্ন এলাকায় ছত্রীসেনাদের সঙ্গে পাকিস্তানি সেনাদের মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়। হানাদার পাকিস্তানিদের ফ্ল্যাগ অফিসার লেফটেন্যান্ট জেনারেল রাও ফরমান আলির উদ্দেশে মুক্তি ও মিত্রবাহিনীর প্রধান জেনারেল মানেকশ অস্ত্র সম্বরণ ও আত্মসমর্পণ করার শেষ শেষ সুযোগটুকু গ্রহণের আহ্বান জানান। তথ্যসূত্র : বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ; দলিলপত্র একাদশ, দ্বাদশ ও ত্রয়োদশ খণ্ড।
"