বদরুল আলম মজুমদার
বিএনপিতে ভারতবিরোধী কঠোর মনোভাব
শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর বিএনপির সঙ্গে ভারত সরকারের সম্পর্কের বরফ গলার কূটনীতি শুরু হতে না হতেই বইছে উল্টো বাতাস; বিরূপ হাওয়া। এরই মধ্যে বিএনপির তিনটি অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের ব্যানারে ঢাকায় ভারতীয় হাইকমিশন অভিমুখী ঘেরাও মিছিল হয়েছে। দলটির নেতারা বিভিন্নভাবে ভারতবিরোধী কথাবার্তা মাঝেমধ্যেই বলছেন। কিন্তু গত রবিবারের এ কর্মসূচিতে নেতাকর্মীদের অংশগ্রহণ ছিল চোখে পড়ার মতো। এ মিছিলের আয়োজকদের স্লোগান ছিল ভারতের প্রতি রাগ-ঘৃণার। দিল্লিবিরোধী স্লোগানে স্লোগানে ফেটে পড়ছিলেন নেতাকর্মীরা। এছাড়া ভারতের সীমান্ত অভিমুখে লংমার্চের কর্মসূচিও রয়েছে বিএনপির। স্বাধীনতা-পরবর্তী গত অর্ধশতাধিক বছরে অন্য কোনো সময়ে এমন ভারতবিরোধিতা বাংলাদেশে আর দেখা যায়নি। ড. মুহাম্মদ ইউনূসের অন্তর্বর্তী সরকারের মনোভাব হচ্ছে- ভারতের সঙ্গে সমমর্যাদার ভিত্তিতে কূটনৈতিক সম্পর্ক রক্ষা করা।
কূটনৈতিক সূত্র বলছে, হাসিনা-পরবর্তী দেশের মানুষ চরম ভারতবিরোধী মনোভাব পোষণ করছেন। সম্প্রতি ইসকনের সাবেক নেতা চিন্ময় দাসের গ্রেপ্তার ও চট্টগ্রামের আদালতে আইনজীবী সাইফুল ইসলামের হত্যার মধ্য দিয়ে ভারতবিরোধী অবস্থান আরো স্পষ্ট হয় রাজনৈতিক ও সামাজিকভাবে। এ অবস্থায় বিএনপির পক্ষে ভারতকে খুশির রাখার চিন্তা থেকে সরাসরি বেরিয়ে আসতে হয়েছে বলে মনে করছেন দলটির একাধিক নেতা। যদিও দলের একটি অংশ ভারতবিরোধী মনোভাব নিয়ে চলতে রাজি নয় বলে জানা গেছে। কিন্তু পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে তারাও এখন দলে কোণঠাসা। এ অবস্থায় বিএনপি বাধ্য হয়েই ভারতবিরোধী জনতার মন জয় করতে এ অবস্থান আরো এক ধাপ স্পষ্ট করল বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
দলীয় সূত্রে জানা গেছে, বিএনপি দলগতভাবে চরম ভারতবিরোধী অবস্থানে গিয়ে রাজনীতি করতে রাজি ছিল না। এজন্য গত কয়েক মাস থেকে দলটির বেশ কয়েকজন জাতীয় পর্যায়ের নেতা ভারতীয় দূতাবাসের কর্মকর্তাদের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নের চেষ্টা করে যাচ্ছিলেন। এক্ষেত্রে ভারতীয় কর্মকর্তাদের ইতিবাচক সাড়া এ সম্পর্কোন্নয়নের ক্ষেত্রে বড় সহায়ক ভূমিকা রেখেছিল। এ অবস্থায় দলের নেতারা নিয়মিতই ভারতীয় কূটনৈতিকদের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়িয়েছেন। কিন্তু ইসকন ইস্যু এবং চট্টগ্রামে আইনজীবী সাইফুল নিহতের ঘটনা প্রেক্ষাপট বদলে দিয়েছে। এতে অন্তর্বর্তী সরকার ভারতের সরকারের বাংলাদেশনীতি, শেখ হাসিনার তৎপরতা ও ভারতীয় কতিপয় গণমাধ্যমের সাম্প্রদায়িক প্রোপাগান্ডাকে ছেড়ে কথা বলেনি। কড়া নিন্দা জানিয়েছে। স্বাভাবিক কারণেই বিএনপি নেতাকর্মীরা এর বাইরে থাকা সমীচীন মনে করেননি।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিএনপির এক ভাইস চেয়ারম্যান এ প্রতিবেদককে বলেন, বর্তমান সরকারসহ সারা দেশের বেশিরভাগ মানুষ ভারতবিরোধী মনোভাব পোষণ করলেও বিএনপির একটি পক্ষ ভারতকে আস্থায় নিয়ে রাষ্ট্রক্ষমতায় যেতে চাইছিলেন। কিন্তু তাদের এমন ভারততুষ্টের রাজনীতি নিয়ে কিছু ইউটিউবার ও সমালোচক নানা মাধ্যমে বিএনপির নীতির প্রকাশ্যে বিরোধিতা করেন। অন্তর্বর্তী সরকার ও বিএনপি ছাড়া সব রাজনৈতিক দল যেখানে প্রকাশ্যে ভারতবিরোধী অবস্থান নিয়ে জনমত গঠন করছিল, ঠিক সেই সময়টায় বিএনপি একরকম চুপ ছিল। কিন্তু দেশের অভ্যন্তরীণ নানা ঘটনা নিয়ে ভারতীয় গণমাধ্যমসহ সেদেশের রাজনৈতিক নেতারা বাংলাদেশ নিয়ে নানা গুজব ও বিভ্রান্তি তৈরি করছেন। এরই ধারাবাহিকতায় ভারতে বাংলাদেশের সহকারী হাইকমিশনে আক্রমণ করা হয়। তাই বিএনপিকে বাধ্য হয়েই ভারতকুল রক্ষার নীতি থেকে সরে আসতে হয়। দলটির শীর্ষ পর্যায়ের নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দলীয়ভাবে ভারতের নেতিবাচক কর্মকাণ্ডের বিরোধী অবস্থান ধরে রাখতে চান শীর্ষ পর্যায়ের নেতারা। তবে সেটি শুধু বিরোধিতার অর্থে নয়। দেশের স্বার্থ ও সামগ্রিক রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট বিবেচনা করে এ বিষয়ে কর্মকৌশল ঠিক করা উচিত বলে মনে করেন তারা।
বিএনপি নেতারা মনে করেন, গত তিনটি জাতীয় নির্বাচন নিয়ে ভারতের অবস্থানে জনগণের প্রত্যাশার প্রতিফলন ঘটেনি। দুই দেশের জনগণের মধ্যকার যে সম্পর্ক গড়ে ওঠার কথা, তার বদলে শুধু আওয়ামী লীগের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক গভীর হয়েছে। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু বলেন, বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে অযাচিত হস্তক্ষেপ করছে ভারত। তারা শেখ হাসিনাকে সমর্থন দিচ্ছে। ভারত সরকারের বক্তব্য এবং তাদের গণমাধ্যমের সংবাদ এক ধরনের বিদ্বেষ ছড়াচ্ছে। কিন্তু এর বিপরীতে দলমত-নির্বিশেষ বাংলাদেশে ঐক্য তৈরি হয়েছে। অন্য একটি সূত্র জানায়, সম্প্রতি বিএনপির একজন গুরুত্বপূর্ণ নেতা দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার সঙ্গে তার গুলশানের বাসভবনে গিয়ে দেখা করেন। দলের নেত্রীর সঙ্গে কথার একপর্যায়ে ভারতের বিষয়টি আলোচনা আনেন ওই নেতা। তার বক্তব্যের সঙ্গে একমত পোষণ করে খালেদা জিয়া ২০০৮ সালের আগ পর্যন্ত বিএনপির ভারতবিরোধী কৌশলগত অবস্থানকে সমর্থন করেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দলের এক গুরুত্বপূর্ণ নেতা বলেন, বাংলাদেশ নিয়ে নেতিবাচক প্রচার, সেদেশের সংবাদমাধ্যমে ক্রমাগত গুজব রটানোসহ সীমান্ত হত্যা, তিস্তাসহ অভিন্ন নদীর পানিবণ্টন, বাণিজ্যিক বৈষম্য, রাজনীতিতে হস্তক্ষেপসহ নানা বিষয়ে একটি ভারতবিরোধী অবস্থান গড়ে তোলার পক্ষে নেতাদের প্রায় সবাই একমত। তাছাড়া ভৌগোলিক কারণে বাংলাদেশের মানুষের ভারতবিরোধী দৃষ্টিভঙ্গিকে বিএনপি সবসময় সমর্থন জানিয়েছিল। সেই রাজনীতির ধারাটা আবার ফিরিয়ে আনার চেষ্টা চলছে মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানের প্রতিষ্ঠিত এ দলে। ভারতের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে বিএনপিতে ভিন্নমতও আছে। দলের শীর্ষ পর্যায়ের নেতাদের অনেকেই মনে করেন, ভৌগোলিক কারণে ভারতকে কোনোভাবেই অগ্রাহ্য করা যাবে না। দেশটির বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের কৌশলগত প্রতিক্রিয়া বা সমালোচনা করা যেতে পারে। কিন্তু সেটি কোনোভাবেই মাত্রার বাইরে নয়।
"