প্রতিদিনের সংবাদ ডেস্ক
সিরিয়ায় আসাদের পতন
সিরিয়ার রাজধানী দামেস্ক বিদ্রোহী সশস্ত্র বাহিনী হায়াত তাহরির আল-শাম (এইচটিএস) দখলের মধ্যে দিয়ে পতন হয়েছে বাশার আল আসাদ সরকারের। গতকাল রবিবার সকালে দামেস্ক বিমানবন্দর থেকে একটি ইলিউশিন ৭৫ উড়োজাহাজ উড়তে দেখা গেছে। এরপরই বিমানবন্দর ছেড়ে চলে যান সরকারি সেনারা। ধারণা করা হচ্ছে, ব্যক্তিগত উড়োজাহাজে দেশ ছাড়েন বাশার। এতে প্রেসিডেন্ট হিসেবে তার টানা ২৪ বছরের শাসনামল শেষ হলো।
এর আগে তার বাবা হাফিজ আল আসাদ টানা ২৯ বছর সিরিয়া শাসন করেন। বাশার আল আসাদের পালানোর মধ্য দিয়ে সিরিয়ায় ৫৩ বছরের আসাদ পরিবারের শাসনের অবসান হলো। ২০১১ সাল থেকে দেশটিতে গৃহযুদ্ধ চলছে। বিভিন্ন সূত্রের বরাতে একাধিক আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম এ তথ্য জানিয়েছে। এদিকে চলতি বছরের এইচটিএসের নেতৃত্বে সিরিয়ার বিদ্রোহী গোষ্ঠী হঠাৎ দেশটির সরকারি বাহিনীর বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করে। গত কয়েকদিনে দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ শহর আলেপ্পো, তৃতীয় বৃহত্তম শহর হোমসসহ সিরিয়ার বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ শহরের নিয়ন্ত্রণ নেন বিদ্রোহীরা। হোমস শহরের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে বিদ্রোহী কমান্ডার হাসান আবদুল ঘানি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে দেওয়া পোস্টে বলেন, হোমস শহর ‘পূর্ণাঙ্গ স্বাধীন’ করা হয়েছে। পরে তারা দামেস্কের দিকে এগোতে থাকেন। অভিযান শুরুর মাত্র ১২ দিনের মাথায় বিদ্রোহীরা রাজধানী দামেস্ক দখল করেন।
গত শনিবার রাতে দামেস্কের উপকণ্ঠে পৌঁছে যান বিদ্রোহীরা। গতকাল সকালে তারা দামেস্কে ঢুকে পড়েন। এ অবস্থায় ব্যক্তিগত বিমানে বাশার আল আসাদের পালিয়ে যাওয়ার পর বিদ্রোহীরা সিরিয়াকে ‘মুক্ত’ বলে আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেন। এইচটিএসের পক্ষ থেকে দেওয়া বিবৃতিতে বলা হয়, সিরিয়া এখন মুক্ত। জালিম শাসক বাশার আল আসাদের হাত থেকে সিরিয়াকে মুক্ত করা হয়েছে। সিরিয়ান অবজারভেটরি ফর হিউম্যান রাইটস জানায়, দামেস্কে সিরিয়ার সেনাবাহিনী ও নিরাপত্তা বাহিনীর কয়েকশ’ সদস্যকে তাদের সামরিক ইউনিফর্ম খুলে ফেলতে দেখা গেছে। বিদ্রোহীদের রাজধানী দখলের পর প্রায় ২ হাজার সিরিয়ান সেনা সীমান্ত পার হয়ে ইরাকে আশ্রয় নিয়েছেন বলে জানান ইরাকের সীমান্তবর্তী সিরিয়ার আল কায়িম শহরের মেয়র। এদিকে বাসার আল আসাদ পালিয়ে যাওয়া খবরে দামেস্কের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত ল্যান্ডমার্ক উমাইয়াদ স্কয়ারে লোকজনকে উল্লাস করতে দেখা যায়। সেখান থেকে সরে গেছেন প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা। এলাকাটি আসাদ সরকারের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় ও সিরিয়ার সশস্ত্র বাহিনীসহ গুরুত্বপূর্ণ সরকারি সংস্থাগুলো অবস্থিত। সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রচারিত একটি ভিডিওতে দেখা গেছে, উমাইয়াদ স্কোয়ারে জোরে গান বাজানো হচ্ছে এবং অন্তত এক ডজন ব্যক্তি একটি পরিত্যক্ত ট্যাঙ্কের চারপাশে নাচছেন। দাবি করা হচ্ছে, ট্যাঙ্কটি সরকারের সেনাবাহিনীর সদস্যরা ফেলে রেখে চলে গেছেন।
এর আগে শনিবার দামেস্ক থেকে প্রায় ১০ কিলোমিটার দূরে জেরমানা শহরতলিতে থাকা বাশার আল আসাদের বাবা হাফিজ আল আসাদের একটি ভাস্কর্য ভেঙে ফেলেন স্থানীয় ও আরেক এলাকার বিক্ষুব্ধ জনতা। এ সময় ফাঁকা গুলিও ছোড়েন তারা। পরে গতকাল বিদ্রোহীরা দামেস্কে প্রবেশ করলে হাফিজের আরেকটি ভাস্কর্য ভেঙে ফেলে জনতা। বার্তা সংস্থা এএফপি এ ভাস্কর্য ভেঙে ফেলার ছবি প্রকাশ করেছে। স্থানীয় বাসিন্দাদের বরাতে সিএনএন জানায়, গতকাল সকালে দামেস্কে গোলাগুলির শব্দ শুনতে পায় তারা। এ সময় দামেস্কের বারজেহ এলাকায় বিদ্রোহী যোদ্ধারা ঢুকে পড়লে লড়াই শুরু হয়। এ সময় দামেস্কের বিদ্যুৎ সংযোগ বন্ধ করে দেওয়া হয়, ইন্টারনেটের গতিও খুব কম ছিল। লোকজন ঘরের বাইরে বের হওয়া বন্ধ ছিল। পরে বাশার আল আসাদের পালিয়ে যাওয়ার খবরে উল্লাস করতে করতে বাইরে বেরিয়ে আসেন তারা।
দিনভর বিমান দুর্ঘটনার গুঞ্জন : হামলায় উড়োজাহাজ বিদ্ধস্ত হয়ে বাশার আল আসাদের মৃত্যুর দিনভর গুঞ্জনের মধ্যে তার সর্বশেষ তথ্য দিয়েছে রাশিয়া। দেশটি বলছে, সিরিয়ায় এখন আর আসাদ নেই, তিনি সিরিয়া থেকে বের হয়ে গেছেন। রাশিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে প্রকাশিত এক বিবৃতিতে এ তথ্য প্রকাশ করা হয়েছে বলে জানায় বার্তা সংস্থা রয়টার্স। তবে বাশার রাশিয়ার দিকে গেছেন কি না, তা-ও নিশ্চিত করে বলেনি রুশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। রাশিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিবৃতিতে বলা হয়, কার্যালয় ছেড়েছেন বাশার আল আসাদ। তিনি সিরিয়াও ছেড়েছেন। দেশ ছাড়ার আগে তিনি ঘোষণা দিয়ে গেছেন, শান্তিপূর্ণভাবে যাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করা হয়। তবে এ নিয়ে রাশিয়ার সঙ্গে তার কথা হয়নি।
এর আগে সিরিয়ার বিদ্রোহী এইচটিএস যোদ্ধা রাজধানীতে প্রবেশের সময় দামেস্ক বিমানবন্দর থেকে একটি ইলিউশিন ৭৫ উড়োজাহাজ আকাশে উড়াল দেয়। ‘সিরিয়ান এয়ার ৯২১৮ ফ্লাইটটি’ দামেস্ক থেকে উড়াল দেওয়া সর্বশেষ ফ্লাইট বলে জানিয়েছে ফ্লাইটরাডার ২৪। তাদের তথ্যানুযায়ী, দামেস্ক থেকে ছাড়া ইলিউশিন ৭৫ উড়োজাহাজটি প্রথমে সিরিয়ার উপকূলীয় অঞ্চলের দিকে উড়ে যায়। কিন্তু সেখান থেকে পরে ঘুরে (ইউটার্ন) উড়ে যেতে শুরু করে। কয়েক মিনিট পর সেটি অদৃশ্য হয়ে যায়। অদৃশ্য হওয়ার সময় উড়োজাহাজটি হোমস শহরের ওপর ছিল। তবে দামেস্কে ওড়া শেষ ফ্লাইটটিতে বাশার আল আসাদ ছিলেন কি না, তা নিশ্চিত হতে পারেনি রয়টার্স। সিরিয়ার সেনাবাহিনীর দুই জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তার বরাতে সংসাব সংস্থা রয়টার্স জানায়, রবিবার স্থানীয় সময় ভোরের দিকে উড়োজাহাজে দামেস্ক ছেড়েছেন বাশার আসাদ। তবে তার গন্তব্যে কোথায়, তা জানাতে পারেননি তারা। এছাড়া দামেস্ক বিমানবন্দর এখন বিদ্রোহীদের নিয়ন্ত্রণে।
সিরিয়ায় থাকা রুশ ঘাঁটি নিয়েও মন্তব্য পাওয়া যায় রাশিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিবৃতিতে। এতে বলা হয়, এসব ঘাঁটিকে সতর্কবার্তা দেওয়া হয়েছে। সেনারা বেশ সতর্ক। তবে, ভয়ের কোনো কারণ নেই, কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটবে না। বিরোধীদের সঙ্গে মস্কো আলোচনা শুরু করেছে বলেও বিবৃতিতে বলা হয়। সব পক্ষকে শান্ত থাকারও আহ্বান জানানো হয় বিবৃতিতে। এদিকে ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল জানায়, বাশার আল আসাদের ব্রিটিশ-সিরীয় স্ত্রী আসমা আসাদ ও তাদের তিন সন্তান আগেই সিরিয়া ছেড়েছেন। সন্তানদের নিয়ে আসমা গত নভেম্বরের শেষের দিকে রাশিয়ায় চলে যান। সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট দপ্তরের বরাতে গত মে মাসে রয়টার্স এক প্রতিবেদনে জানিয়েছিল, ৪৮ বছর বয়সি আসমার লিউকেমিয়া (রক্ত বা অস্থিমজ্জার ক্যানসার) শনাক্ত হয়েছে। এ কারণে তিনি জনসমক্ষে কোনো অনুষ্ঠানে অংশ নেওয়া থেকে বিরত ছিলেন।
প্রধানমন্ত্রী আল জালালির হাতে প্রশাসন : বিদ্রোহী যোদ্ধাদের আক্রমণের মুখে সাবেক প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদ আত্মগোপনে গেলেও দামেস্কেই আছেন প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ আল জালালি। এখন বিদ্রোহী নিয়ন্ত্রিত সিরিয়ার প্রশাসন থাকবে তার হাতে। আল জালালি বলেন, ‘প্রতিবেশী এবং বিশ্বের সঙ্গে সুসম্পর্ক তৈরি করে সিরিয়া একটি স্বাভাবিক দেশ হতে পারে। জনগণের দ্বারা নির্বাচিত যেকোনো নেতৃত্বকে সহযোগিতা করতে প্রস্তুত। আমরা বিদ্রোহীদের দিকে হাত বাড়িয়ে দিচ্ছি। তারাও হাত বাড়িয়েছে। দৃঢ়ভাবে বলেছি, তারা এদেশের কারো ক্ষতি করবে না।’ বিদ্রোহী গোষ্ঠী এইচটিএসের প্রধান আবু মোহাম্মদ আল জোলানি এক বিবৃতিতে বলেন, দামেস্কে অবস্থানরত সব বিরোধী বাহিনীকে সরকারি প্রতিষ্ঠান দখল করতে নিষেধ করা হয়েছে। আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমতা হস্তান্তরের আগ পর্যন্ত এসব সরকারি প্রতিষ্ঠান আল জালালির তত্ত্বাবধানেই থাকবে। দেশটির প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ আল জালালি বলেন, নিজের বাড়ি ছেড়ে যাওয়ার কোনো পরিকল্পনা নেই তার। সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো সচল রাখতে কাজ করবেন। জানিয়েছে আলজাজিরা।
অস্ত্র কারখানায় ইসরায়েলের হামলা : বিদ্রোহী বাহিনী রাজধানী দখল নেওয়ার মধ্যেই একটি রাসায়নিক অস্ত্র কারখানায় হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল। ইসরায়েলি সংবাদমাধ্যম জেরুজালেম পোস্ট বলছে, সাবেক সিরিয় প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদের সরকারের নিয়ন্ত্রণাধীন কারখানাটি বিদ্রোহীদের হাতে যাওয়ার আশঙ্কায় এ হামলা চালানো হয়। এর আগে শনিবার আইডিএফ প্রধান সিরিয়া সীমান্ত পরিদর্শনের সময় বলেন, ‘স্থানীয় কোনো পক্ষ যেন আমাদের দিকে অগ্রসর না হয়। প্রয়োজনে শক্তিশালী আক্রমণ ও প্রতিরক্ষামূলক ব্যবস্থা গ্রহণের প্রস্তুতি রয়েছে আমাদের।’ এদিকে লেবাননের হিজবুল্লাহ নিয়ন্ত্রিত স্যাটেলাইট টেলিভিশন আল মানার জানায়, ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী গতকাল সকালে দক্ষিণ সিরিয়ায় স্থলভাগে আক্রমণের ঘোষণা দিয়েছে। তবে আইডিএফ বলেছে, তারা সিরিয়ার অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করবে না। তবে ইসরায়েলি ট্যাঙ্ক গোলান মালভূমির সীমান্তবর্তী অঞ্চল অতিক্রম করছে বলে জানায় বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম।
কুখ্যাত সেদনায়া কারাগার উন্মুক্ত : দামেস্কের কুখ্যাত সেদনায়া কারাগারে প্রবেশ করেন বিদ্রোহীরা। তারা কারাগারের ফটক খুলে দেন। বিদ্রোহীদের পক্ষ থেকে সেদনায়া কারাগারে অত্যাচারের অধ্যায়ের সমাপ্তি ঘোষণা করা হয়েছে। সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রচারিত ভিডিওগুলোয় দেখা গেছে, সেখানকার বন্দিরা কারাগারের মাঠ থেকে বেরিয়ে আসছেন। বিদ্রোহী এইচটিএসের কমান্ডার হাসান আবদুল ঘানি এক্সে দেওয়া পোস্টে বলেন, কারাগার থেকে সাড়ে ৩ হাজারের বেশি বন্দিকে মুক্তি দেওয়া হয়েছে। ওই কারাগারে হাজার হাজার বিরোধী সমর্থককে বন্দি করে নির্যাতন এবং মৃত্যুদণ্ড দিয়েছে আসাদ সরকার। সেদনায়া কারাগারকে এর আগে জাতিসংঘ একবার ‘মানব বধ্যভূমি’ হিসেবে বর্ণনা করেছিল। ওই কারাগারে হাজার হাজার বিরোধী সমর্থককে নির্যাতন ও মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছিল বলে জানা গেছে। বর্তমানে সেখানে কয়েক হাজার লোককে আটক করা হতে পারে।
"