মেহেদী হাসান

  ০৫ ডিসেম্বর, ২০২৪

পাঁচশ টাকায় বাজারে কিছুই হয় না, ধারে চলে মাস

‘দশ বছর আগে প্রাইভেট পড়িয়ে যে টাকা পেতাম তার চেয়ে ডাবল (দ্বিগুণ) ইনকাম করি। টাকা বেশি হলেও টানাপড়েন কিন্তু যায়নি। বাজারে পাঁচশ টাকা নিয়ে গেলে কিছুই হয় না। এক কেজি ব্রয়লার মুরগি, এক কেজি আলু, এক লিটার তেল কিনতেই শেষ। যা বেতন পাই তা দিয়ে সংসার চলে না, মাস শেষে ধার করে চলতে হয়’ বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের ভ্যাট ট্যাক্স অডিট বিভাগের কর্মকর্তা সোহেল রানা এভাবেই বলছিলেন তার আর্থিক পরিস্থিতির কথা।

দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে স্বল্প আয়ের মানুষের অবস্থা বেগতিক। মধ্যবিত্ত শ্রেণি মুখ ফুটে কিছু বলতে পারছে না, দাঁড়াতে পারছে না টিসিবির লাইনে। বেতন যতটা না বেড়েছে তার দ্বিগুণ বেড়েছে ব্যয়। ঘরভাড়া, প্রতিদিনের খাবার, পানি-গ্যাস বিল, বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দামে আগুন, সবমিলিয়ে চিড়েচ্যাপ্টা সাধারণ মানুষ।

বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) তথ্য বলছে, গত এপ্রিলে মূল্যস্ফীতি বেড়ে ১০ শতাংশে দাঁড়ায়। এর আগে সমান্য হ্রাস পেয়েছিল। প্রতিষ্ঠানটি বলছে, দেশে গত পাঁচ বছরে শুধু ভোগ্যপণ্যের দাম ৩১০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে। ২০১৯ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ২০২৪ সালের ১৯ মে পর্যন্ত মোটা চালের গড় দাম কেজিপ্রতি ৪০ টাকা থেকে বেড়ে ৫২ টাকায় দাঁড়িয়েছে। ‘মিনিকেট’ নামে পরিচিত চিকন চালের দাম কেজিতে ৫৮ টাকা থেকে ১৭ শতাংশ বেড়ে ৬৮ টাকা হয়েছে। পাইজাম চালের গড় দাম কেজিতে ১৫ শতাংশ বেড়ে ৫৫ টাকা হয়েছে। ঢাকায় সাধারণ তিন ধরনের চালের দাম ধারাবাহিকভাবে থাইল্যান্ড ও ভিয়েতনামের চালের তুলনায় বেশি। বাংলাদেশের বাজারে চিনির দাম কেজিপ্রতি ইউরোপের দেশগুলোর চেয়েও বেশি।

৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পরও পণ্যের দাম বৃদ্ধির জন্য অনেকে ‘ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটকে’ দায়ী করছেন। সিন্ডিকেটের লাগাম টেনে ধরতে ২০১২ সালে প্রতিযোগিতা আইন প্রণয়ন এবং ২০১৬ সালে বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা কমিশন গঠন করা হয়। ২০১৮ সালে কৃষিপণ্য বাজারজাতকরণ আইন প্রণীত হয়। প্রচলিত আইনগুলো প্রয়োগে যে বিচারিক ব্যবস্থা দরকার সেগুলো অনেক সময় কাজ করে না।

ক্যাবের তালিকা অনুযায়ী ২০০৯ সালে মোটা চালের দাম জাতভেদে প্রতি কেজি গড়ে ২৩ টাকা থেকে ২৮ টাকা মধ্যে ছিল। এই চালের দাম এখন গড়ে কেজিপ্রতি ৬২ টাকা থেকে ৭৫ টাকা।

অন্যদিকে গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) মতে, ২০১৯ সালের তুলনায় ২০২৪ সালে পাঁচ বছর ব্যবধানে মোটা চালের দাম বেড়েছে ৩০ শতাংশ। ২০২২ সালে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস) এক গবেষণায় দেখিয়েছিল, অতি গরিব শ্রেণিভুক্ত একজন মানুষ তার ব্যয়ের ৩২ শতাংশ খরচ করেন চাল কিনতে। গরিব মানুষের ক্ষেত্রে এই হার ২৯ শতাংশ। এ ছাড়া গরিব নন, এমন ব্যক্তি তার ব্যয়ের এক-পঞ্চমাংশ চাল কেনায় খরচ করেন। সিপিডির প্রতিবেদনে ১৬টি দেশের তালিকা করা হয় যেখানে মাথাপিছু জিডিপি (মোট দেশজ উৎপাদন) বাংলাদেশের তুলনায় বেশি, তবুও সেই দেশগুলোর ভোক্তারা বাংলাদেশের মানুষদের তুলনায় খাদ্যে কম ব্যয় করে। সিপিডি বলছে, যেসব পণ্য গরিব, মধ্যবিত্তরা ব্যবহার করে এবং বাজারে বেশি বিক্রি হয় সেগুলোতে মুনাফাখোররা বেশি লাভ করছে।

সিপিডির তথ্য বলছে, গত পাঁচ বছরে মসুর ডালের দাম বেড়েছে ৯৫ শতাংশ। ২০১৯ সালে আলুর দাম বেড়ে হয় প্রতি কেজি ৩০ থেকে ৩২ টাকা। তবে গত বছরের শেষে আলুর দাম রেকর্ড পরিমাণ বেড়ে কেজিপ্রতি ৬৫ থেকে ৭০ টাকায় দাঁড়ায়। গত বছর মুরগির ডিমের দাম রেকর্ড বেড়ে প্রতি হালি ৫০ থেকে ৫৮ টাকায়।

গত কয়েক বছরে পেঁয়াজের নাম কয়েকবার বেড়েছে। সিপিডির তথ্য বলছে, গত পাঁচ বছরে পেঁয়াজের দাম ১৬৪ শতাংশ বেড়েছে। অন্যদিকে রসুনের দাম বেড়েছে ৩১০ শতাংশ, যা সর্বোচ্চ। এছাড়া শুকনো মরিচ ১০৫ শতাংশ, আদা ২০৫ শতাংশ এবং গুঁড়া হলুদের দাম ৭০ শতাংশ বেড়েছে।

আগামী অর্থবছরে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের ওপর গুরুত্বারোপ করে সিপিডির গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির পরিবর্তে দুর্বল ও সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্ঠীর স্বার্থ রক্ষা করা নীতিনির্ধারকদের অগ্রাধিকার হওয়া উচিত।

সরকারের বাজার ব্যবস্থাপনার দুর্বলতা উল্লেখ করে অর্থনীতিবিদ দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, পণ্যের জোগান যেখানে স্বাভাবিক, যেখানে যোগাযোগব্যবস্থা আগের চেয়ে উন্নত, বাজার সুসংহত, সেখানে দাম বাড়ার একটাই কারণ তাহলো পুরো সরবরাহ ব্যবস্থা গুটিকয়েক ব্যক্তির নিয়ন্ত্রণ করছে। তারা শেখ হাসিনার সরকারে ছিল জামাই আদরে।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close