কিশোরগঞ্জ প্রতিনিধি

  ০৪ ডিসেম্বর, ২০২৪

পাগলা মসজিদ

জমা টাকা শতকোটিরও বেশি!

কিশোরগঞ্জের পাগলা মসজিদের দানের সিন্দুক ৩ মাস পরপর খুলে পাওয়া যায় কোটি কোটি টাকা, স্বর্ণালংকার ও বৈদেশিক মুদ্রা। এখন পর্যন্ত কত টাকা পাওয়া গেল, এই টাকা কোথায় জমা রাখা হয় বা কীভাবে খরচ হয়- এ নিয়ে মানুষের মনে স্বভাবতই কৌতুহল জাগে। দানের সিন্দুক খোলার কয়েকদিন পর্যন্ত চলে এসব আলোচনা।

সর্বশেষ গত ৩০ নভেম্বর দানের ১১টি সিন্দুক খুলে পাওয়া যায় ৮ কোটি ২১ লাখ টাকার ওপরে। এখন পর্যন্ত মসজিদের কত টাকা জমা হয়েছে, সাংবাদিকরা সেটা জানতে চেয়েছিলেন কিশোরগঞ্জের জেলা প্রশাসক ও পাগলা মসজিদ কমিটির সভাপতি ফৌজিয়া খানের কাছে। তিনি প্রশ্নটি এড়িয়ে যান। এ নিয়ে মসজিদ কমিটির লোকজনও কথা বলতে রাজি হন না।

সর্বশেষ যেদিন মসজিদের দানবাক্স খোলা হয়, সেদিন জেলার বৈষম্যবিরোধী ছাত্রআন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক ইকরাম হোসেন মসজিদে এসে আয়-ব্যয়ের সব হিসাব জনসমক্ষে উত্থাপন করার দাবি জানিয়েছিলেন। তিনি বলেন, পাগলা মসজিদের টাকা জনসাধারণের দেওয়া টাকা। তাই জনগণ এ টাকার হিসাব জানার অধিকার রাখে। তবে এ ব্যাপারে মসজিদ কর্তৃপক্ষের যুক্তি, ৩ থেকে ৪ মাস অন্তর অন্তর যখন দানের সিন্দুক খোলা হয়, তখন নগদ কত টাকা পাওয়া যায়, সেটা গণমাধ্যমের কল্যাণে মানুষ জানতে পারে। এছাড়া প্রতিদিন মসজিদে মানুষের দান করা হাঁস-মুরগি, গরু-ছাগলসহ নানান জিনিসের নিলাম থেকে হাজার হাজার টাকা পাওয়া যায়। দানের সিন্দুকে টাকার সঙ্গে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা আর স্বর্ণালংকারও পাওয়া যায়, সেটার হিসাবও কখনো কাউকে জানানো হয় না। ফলে মানুষের মধ্যে বিষয়টি নিয়ে জানার আগ্রহ বাড়ছে।

২০১৫ সাল থেকে টাকার পরিমাণ বেশি হচ্ছে ও বিষয়টি আলোচনায় এসেছে, সেই ৯ বছরে পাগলা মসজিদের সিন্দুকে টাকা জমা পড়েছে ৭৫ কোটি টাকার ওপরে। এ ৯ বছরে অন্তত ২৩ বার দানের সিন্দুক খোলা হয়েছে। এছাড়া প্রতিদিন মসজিদে দেওয়া প্রাণী, অন্যান্য জিনিস, বৈদেশিক মুদ্রা ও স্বর্ণালংকার নিলামে তুলে আরো ২৫ কোটি টাকার ওপরে পাওয়া গেছে। এভাবে সব মিলিয়ে এখন পর্যন্ত পাগলা মসজিদে শতকোটি টাকার ওপরে জমা পড়েছে।

তবে এ টাকা থেকে মসজিদের ৩৭ কর্মীর বেতন ও মাদরাসার এতিম শিশুদের ভরণপোষণ বাবদ ৬ থেকে সাড়ে ৬ লাখ টাকা প্রতি মাসে ব্যয় হয়। আবার ওয়াক্?ফ স্টেটের হিসাব বাবদ ৫ শতাংশহারে বছরে টাকা কাটা হয়। তবে কোটি কোটি টাকা ব্যাংকে জমা রাখায় প্রতি মাসে লভ্যাংশও আসছে।

২০১৫ সালের শুরুর দিকে ৮টি লোহার সিন্দুক খুলে একসঙ্গে প্রায় ৬৫ লাখ টাকা ও স্বর্ণালংকার পাওয়া যায়। তখন ৬ মাস পরপর সিন্দুক খোলা হতো। এর পরেরবার পাওয়া গিয়েছিল প্রায় ৭৮ লাখ টাকা। ২০১৬ সালের শেষের দিকে দানসিন্দুকে সর্বোচ্চ প্রায় ১ কোটি ১০ লাখ টাকার ওপরে মিলেছিল। দিন দিন টাকা ও বৈদেশিক মুদ্রা জমার পরিমাণ বেড়ে যাওয়ায় ৩ মাস পরপর সিন্দুক খোলার প্রথা চালু হয়। এভাবে ২০১৫ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত ৯ বছরে দানের সিন্দুক খুলে সর্বমোট ৭৫ কোটি ৪৭ লাখ ৫৫ হাজার ৪৩৮ টাকা পাওয়া গেছে। আর যে বৈদেশিক মুদ্রা ও স্বর্ণালংকার পাওয়া যায়, তা জেলা প্রশাসনের ট্রেজারিতে গচ্ছিত রাখা হয়।

মসজিদ কমিটির প্রশাসনিক কর্মকর্তা শওকত উদ্দিন ভূঁইয়ার ভাষ্য ও সরেজমিনে নিলামের একটি চিত্র পাওয়া গেছে। নিলামে শুক্রবার বাদে প্রতিদিন গড়ে ৫০ হাজার টাকার জিনিস বিক্রি হয়। আর প্রতি শুক্রবার দেড় লাখ থেকে ২ লাখ টাকার জিনিস বিক্রি হয়। এ হিসাবে প্রতি মাসে নিলামের ডাক থেকে ২০ লাখ টাকার ওপরে পাওয়া যাচ্ছে। আর বছরে নিলামের এ হিসাব দাঁড়ায় প্রায় আড়াই কোটি টাকার মতো। এভাবে গত ৯ বছরে নিলাম থেকে পাওয়ার কথা ২২ কোটি টাকার ওপরে।

শওকত উদ্দিন ভূঁইয়া বলেন, মসজিদের দানসিন্দুক থেকে যে স্বর্ণালংকার পাওয়া যায়, তা সর্বশেষ ২০২০ সালে একবার নিলাম হয়েছিল। তখন এ থেকে আরো প্রায় পৌনে ২ কোটি টাকা পাওয়া যায়। তবে এর পর থেকে পাওয়া স্বর্ণালংকার ও বৈদেশিক মুদ্রা জেলা প্রশাসনের ট্রেজারিতে জমা আছে। ২০২০ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত অন্তত ১৫ বার সিন্দুক খোলা হয়েছে। এ থেকে ধারণা করা যায়, ট্রেজারিতে জমা থাকা ১৫ বারের স্বর্ণালংকার আর বৈদেশিক মুদ্রা মিলে আরো ৭ থেকে ৮ কোটি টাকা পাওয়া যেতে পারে। দানসিন্দুকের ৭৫ কোটি টাকার ওপরে, নিলামের প্রায় ২২ কোটি টাকা, ৪ বছর আগের স্বর্ণালংকারের নিলাম থেকে প্রায় পৌনে ২ কোটি টাকা, ট্রেজারিতে জমা থাকা গত ৪ বছরের স্বর্ণালংকার ও বৈদেশিক মুদ্রা হিসেবে থাকা প্রায় ৭ থেকে ৮ কোটি টাকা মিলিয়ে ১০০ কোটি টাকার বেশি হয়।

জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, ১৯৭৯ সাল থেকে প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণে পাগলা মসজিদের কার্যক্রম চলে আসছে। সেই থেকে পদাধিকারবলে কিশোরগঞ্জের দায়িত্বপ্রাপ্ত জেলা প্রশাসকরা পাগলা মসজিদ কমিটির সভাপতির দায়িত্ব পালন করে আসছেন।

মসজিদ কমিটির প্রশাসনিক কর্মকর্তা শওকত উদ্দিন ভূঁইয়া বলেন, সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের যৌথ স্বাক্ষরে পাগলা মসজিদের আর্থিক লেনদেন হয়ে থাকে। এ মসজিদের টাকা দুটি ব্যাংকে আছে। মসজিদের আয় দিয়ে এ কমপ্লেক্সে অবস্থিত নুরুল কোরআন হাফিজিয়া মাদরাসার ১৩০ এতিম ও দুস্থ শিক্ষার্থীর বিনামূল্যে পড়াশোনা ও ভরণপোষণ করা হচ্ছে। এছাড়া এখানে দায়িত্বরত কর্মীদের বেতনও মসজিদের আয় থেকে দেওয়া হয়।

মসজিদ কমিটি সূত্রে জানা গেছে, দানের অর্থ দিয়ে মসজিদের ৫ একর জায়গায় একটি দৃষ্টিনন্দন ও আধুনিক স্থাপনা নির্মাণ করা হবে। এতে প্রাথমিক ব্যয় ধরা হয়েছে ১১৫ কোটি টাকা। মূল মসজিদটি ছয়তলাবিশিষ্ট হবে। প্রতি তলায় একসঙ্গে ৫ হাজার মুসল্লি নামাজ আদায় করতে পারবেন। পাশাপাশি আরো ৫ হাজার নারী মুসল্লির জন্য আলাদা নামাজের ব্যবস্থা থাকবে। সব মিলিয়ে ৪০ হাজার লোক যাতে একসঙ্গে নামাজ আদায় করতে পারেন, সে ব্যবস্থা থাকবে। এছাড়া থাকবে একাডেমিক ভবন ও অতিথিশালা। অতিথিশালায় রাষ্ট্রের অতি গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের অবস্থানের ব্যবস্থা থাকবে।

জেলা প্রশাসক ও মসজিদ কমিটির সভাপতি ফৌজিয়া খান বলেন, পাগলা মসজিদ ও ইসলামী কমপ্লেক্সের খরচ চালিয়ে দানের বাকি টাকা ব্যাংকে জমা রাখা হয়। জমা টাকার লভ্যাংশ থেকে জেলার বিভিন্ন মসজিদ, মাদরাসা ও এতিমখানায় অনুদান দেওয়ার পাশাপাশি অসহায় ও জটিল রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিদের সহায়তাও করা হয়ে থাকে।

কিশোরগঞ্জ শহরের ঐতিহাসিক স্থাপনার মধ্যে পাগলা মসজিদ অন্যতম একটি প্রতিষ্ঠান। শহরের পশ্চিমে নরসুন্দা নদীর তীরে মসজিদটি গড়ে ওঠে। কথিত আছে, খাস নিয়তে এ মসজিদে দান করলে মানুষের মনের আশা পূরণ হয়। সে জন্য দূরদূরান্ত থেকে অসংখ্য মানুষ এখানে এসে দান করে থাকেন।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close