নিজস্ব প্রতিবেদক
দাম কমেছে চাল-চিনির অস্বস্তি মাছ আলু তেলে
নিত্যপণ্যের দর কমাতে সরকারের শুল্ক ছাড় ও আমদানির উদ্যোগের পুরোপুরি সুফল এখনো পাচ্ছেন না ভোক্তারা। চাল, চিনি, ডিম, আদার মতো কিছু পণ্যের দর কমেছে। তবে আলু, বোতলজাত সয়াবিন তেল, মাছসহ বেশকিছু পণ্য আগের মতোই বেশি দরে বিক্রি হচ্ছে। এ ছাড়া বাজারে সরবরাহ বাড়লে আশানুরূপ কমছে না সবজির দাম। বৃহস্পতিবার ও গতকাল শুক্রবার কারওয়ানবাজার, মহাখালী কাঁচাবাজারসহ রাজধানীর বিভিন্ন বাজার ঘুরে এ তথ্য জানা গেছে।
চালের বাজারে স্বস্তি : এবার চালের দাম বেশ ভুগিয়েছে। প্রায় তিন মাস পর এখন মিলেছে কিছুটা স্বস্তির খবর। কেজিতে কমেছে ৩ থেকে ৪ টাকা। প্রতি কেজি মোটা চাল (গুটি স্বর্ণা ও চায়না ইরি) ৫০ থেকে ৫৩ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। গত সপ্তাহে এ ধরনের চালের কেজি ছিল ৫৪ থেকে ৫৫ টাকা। অর্থাৎ কেজিতে কমেছে সর্বোচ্চ ৪ টাকা। বাজারে সবচেয়ে বেশি বেচাকেনা হয় বিআর-২৮ ও পাইজাম জাতীয় চাল। এ ধরনের চালের কেজি বিক্রি হচ্ছে ৫৯ থেকে ৬২ টাকা। এ মানের চালের দর গত সপ্তাহে ছিল ৬০ থেকে ৬৫ টাকা। সেই হিসাবে কেজিতে কমেছে সর্বোচ্চ ৩ টাকা। এ ছাড়া ৩ টাকার মতো কমে মিনিকেট বা চিকন চাল বিক্রি হচ্ছে ৭০ থেকে ৭২ টাকায়।
দাম কমার কারণ হিসেবে খুচরা ব্যবসায়ীরা মনে করেন, শুল্ক ছাড় ও আমদানির অনুমতির উদ্যোগ কিছুটা হলেও বড় ব্যবসায়ীদের দৌরাত্ম্য কমিয়েছে। যদিও বাজারে আমদানি করা চাল দেখা যায়নি। তাছাড়া বাজারে নতুন চাল আসা শুরু হয়েছে। এসব কারণে দাম কমছে।
চিনি কেজিতে কমেছে ১০ টাকা : চিনির বাজারেও শুল্ক ছাড়ের ইতিবাচক প্রভাব দেখা গেছে। প্রতি কেজি প্যাকেট চিনি ১২৪ থেকে ১২৫ এবং খোলা চিনি ১২০ টাকার আশপাশের দরে বিক্রি হচ্ছে। সপ্তাহখানেক আগে দুই ধরনের চিনির দর ছিল যথাক্রমে কমবেশি ১৩০ ও ১৩৫ টাকা। সেই হিসাবে কেজিতে কমেছে ১০ টাকার মতো।
বোতলজাত তেল সরবরাহে ঘাটতি : ভোজ্যতেলে শুল্ক কমানোর সুফল পুরোপুরি পাচ্ছেন না ভোক্তা; বরং বোতলজাত তেলের সরবরাহে কিছুটা ঘাটতি দেখা গেছে। বিশেষ করে এক ও দুই লিটারের বোতল সয়াবিন তেল দেখা যায়নি বেশির ভাগ দোকানে। পাঁচ লিটারের বোতল থাকলেও বিক্রি হচ্ছে নির্ধারিত দরে, অর্থাৎ ৮১৮ টাকায়। সপ্তাহ দুয়েক আগে কেনা যেত ৭৯০ থেকে ৮১০ টাকায়। তবে খোলা সয়াবিন ও পাম অয়েলের সরবরাহ স্বাভাবিক। পাম অয়েলের দর লিটারে ১০ টাকার মতো কমেছে। প্রতি লিটার বিক্রি হচ্ছে ১৫৫ টাকার আশপাশে। খোলা সয়াবিনের লিটার কিনতে খরচ হবে ১৬৫ থেকে ১৬৭ টাকা।
পেঁয়াজ অপরিবর্তিত, কমেছে আদার দাম : অপরিবর্তিত রয়েছে পেঁয়াজের বাজার। গত সপ্তাহের মতো দেশি ভালো মানের পেঁয়াজের কেজি ১১৮ থেকে ১২০, দেশি হাইব্রিডের কেজি ১১০ থেকে ১১৫ এবং ভারতীয় পেঁয়াজের কেজি ৯৮ থেকে ১০০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। আগের মতোই রসুনের কেজি ২৩০ থেকে ২৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। আদার দর কমতির দিকে। দেশি আদার কেজি ১৪০ থেকে ১৫০ এবং চীনা আদার কেজি ১৭০ থেকে ১৮০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। ব্যবসায়ীরা জানান, গত ৮-১০ দিনে আদার কেজিতে ২০ থেকে ৩০ টাকা কমেছে।
কমছে না আলুর দাম : বাজারে নতুন আলু আসা শুরু করলেও দাম কমছে না। প্রতি কেজি নতুন আলু মানভেদে ৯০ থেকে ১১০ টাকা এবং পুরোনো আলুর কেজি ৭০ থেকে ৮০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। ব্যবসায়ীরা বলছেন, বাজারে বিক্রি হওয়া নতুন আলু ভারত থেকে আমদানি করা। স্থানীয় আলু খেত থেকে ওঠার আগ পর্যন্ত দর কমার সুযোগ সীমিত। সবজির সরবরাহ বাড়লেও দাম কমছে না : শীতের সবজির সরবরাহ বেড়েছে। সে তুলনায় দর কমেনি। মানভেদে প্রতি কেজি বেগুন ৭০-৮০ টাকা, করলা ৮০ টাকা, ঢ্যাঁড়শ ৬০ টাকা, বরবটি ৮০ টাকা, মুলা ৩০ টাকা, লতি ৭০ টাকা, কহি ৬০ টাকা, ধুন্দুল ৫০ টাকা ও পটোল ৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। আর প্রতি কেজি পেঁপে ৪০ টাকা, গাজর ১৩০ টাকা, কচুরমুখী ১০০ টাকা, টমেটো ১২০ টাকা, শিম ৮০ টাকা, শালগম ৬০ টাকা ও শসা বিক্রি হচ্ছে ৪০-৫০ টাকায়। এ ছাড়া প্রতি কেজি ধনেপাতা ৪০-৬০ টাকা, পেঁয়াজের কালি ৫০-৬০ টাকা ও চিচিঙ্গা বিক্রি হচ্ছে ৪০-৫০ টাকায়। আর মানভেদে প্রতি পিস ফুলকপি ৪০ টাকা, বাঁধাকপি ৫০ টাকা এবং লাউয়ের জন্য গুনতে হচ্ছে ৫০-৭০ টাকা।
বাজারে লালশাকের আঁটি ১০ টাকা, পাটশাক ১০-১৫ টাকা, পুঁইশাক ৩০-৪০ টাকা, মুলাশাক ১০ টাকা, ডাঁটাশাক ১০-১৫ টাকা, কলমিশাক ১০ টাকা ও পালংশাক বিক্রি হচ্ছে ১৫-২০ টাকায়। আর খুচরা পর্যায়ে কাঁচামরিচ বিক্রি হচ্ছে ১০০ টাকায়, যা পাইকারিতে বিক্রি হচ্ছে প্রতি কেজি ৭০-৮০ টাকা দরে।
বিক্রেতারা বলছেন, বাজারে সরবরাহ বেড়েছে কাঁচামরিচের। এতে পাইকারি ও খুচরা উভয় পর্যায়েই কমেছে দাম।
মাংস ও ডিমের বাজার অপরিবর্তিত : সোনালি ও ব্রয়লার মুরগির দাম কিছুটা কমলেও স্থিতিশীল রয়েছে অন্যান্য মাংস ও ডিমের দাম। কেজিতে ১০ টাকা কমে প্রতি কেজি সোনালি মুরগি ২৯০ থেকে ৩০০ টাকা ও ব্রয়লার মুরগি ১৭৫-১৯০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এছাড়া প্রতি কেজি দেশি মুরগি ৫৫০-৬০০ টাকা, সাদা লেয়ার ২৩০ টাকা ও লাল লেয়ার বিক্রি হচ্ছে ২৮০ টাকায়। আর জাতভেদে প্রতি পিস হাঁস বিক্রি হচ্ছে ৫৫০-৬০০ টাকায়।
অপরিবর্তিত আছে গরু ও খাসির মাংসের দামও। প্রতি কেজি গরুর মাংস বিক্রি হচ্ছে ৭৫০-৮০০ টাকায়। এ ছাড়া প্রতি কেজি খাসির মাংস ১ হাজার ৫০ টাকা থেকে ১ হাজার ১০০ টাকা এবং ছাগলের মাংস বিক্রি হচ্ছে ১ হাজার টাকায়। আর বর্তমানে প্রতি ডজন লাল ডিম খুচরা পর্যায়ে ১৪৪-১৪৫ টাকা ও সাদা ডিম বিক্রি হচ্ছে ১৪৪ টাকায়। আর প্রতি ডজন হাঁসের ডিম ২৪০-২৫০ টাকা ও দেশি মুরগির ডিম বিক্রি হচ্ছে ২৪০ টাকায়।
মাছের বাজার চড়া : বাজারে এখনো চড়া দামে বিক্রি হচ্ছে ইলিশ মাছ। আর সপ্তাহ ব্যবধানে কেজিতে ৪০০-৫০০ টাকা বেড়েছে ইলিশের দাম। এক কেজি ওজনের ইলিশ বিক্রি হচ্ছে ২,২০০ টাকায়। এ ছাড়া দেড় কেজি ওজনের ইলিশ ৩,০০০ টাকা, ৭০০-৮০০ গ্রাম ওজনের ইলিশ ১,৯০০ টাকা হারে, আর ৫০০-৬০০ গ্রাম ওজনের ইলিশ ১,৪০০ টাকা ও ৩০০-৪০০ গ্রাম ওজনের ইলিশের জন্য গুনতে হচ্ছে ৮০০-১০০০ টাকা পর্যন্ত।
কেজিতে ১০-৩০ টাকা বেড়ে গেছে অন্যান্য মাছের দামও। বাজারে প্রতি কেজি রুই ৩৮০ থেকে ৪৫০ টাকা, কাতল ৪০০ থেকে ৪৮০ টাকা, চাষের শিং ৫৫০ টাকা, চাষের মাগুর ৫০০ টাকা, চাষের কৈ ২৪০ থেকে ২৮০ টাকা, কোরাল ৭৫০ থেকে ৮০০ টাকা, টেংরা ৫৫০ থেকে ৭০০ টাকা, চাষের পাঙাশ ১৮০ থেকে ২৩০ টাকা ও তেলাপিয়া ১৮০ থেকে ২২০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হচ্ছে।
এ ছাড়া প্রতি কেজি বোয়াল ৭৫০ থেকে ৮০০ টাকা, পোয়া ৪৫০, পাবদা ৩৫০ থেকে ৪৫০ টাকা, আইড় ৮৫০ থেকে ৯০০ টাকা, দেশি কৈ ১ হাজার ৩০০ টাকা থেকে ১ হাজার ৭০০ টাকা, শিং ১ হাজার ৪০০ থেকে ১ হাজার ৫০০ টাকা, শোল ৯০০ থেকে ১ হাজার টাকা এবং নদীর পাঙাশ বিক্রি হচ্ছে ৯০০ থেকে ১ হাজার ২০০ টাকায়।
বাজারে স্বস্তি ফেরাতে গত দুই মাসে ৭টি পণ্য- চাল, খেজুর, তেল, চিনি, পেঁয়াজ, আলু ও ডিম আমদানিতে শুল্ক ছাড় দিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। পাশাপাশি জোরদার করা হয়েছে তদারকি। গঠন করা হয়েছে টাস্কফোর্স। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও ঝটিকা অভিযান পরিচালনা করছে। তারপরও স্বভাবিক হচ্ছে না বাজার।
নিত্যপণ্যের বাজার নিয়ন্ত্রণে নিয়মিত বাজার মনিটরিংয়ের দাবি ক্রেতা ও বিক্রেতা উভয়েরই। ক্রেতারা বলছেন, নিয়মিত বাজার মনিটরিং করা হয় না। এতে বিক্রেতারা ইচ্ছেমতো দাম বাড়ানোর সুযোগ পান। আর বিক্রেতারা বলছেন, কিছু অসাধু ব্যবসায়ী ইচ্ছেমতো দাম বাড়াচ্ছেন। বাজারে নিয়মিত অভিযান চালালে অসাধুদের দৌরাত্ম্য কমবে।
"