বিবিসি
বাংলাদেশ শাখা দায় না নিলেও চিন্ময়ের পাশে থাকবে ইসকন
ইসকনের সঙ্গে সনাতনী জোট ও চিন্ময় দাসের সম্পর্ক নিয়ে বেশ কিছু তথ্য জানা গেছে। শেখ হাসিনা সরকার পতনের পর সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তার দাবিতে টানা আন্দোলনের নেতৃত্বে থাকা ‘ইসকন নেতা’ চিন্ময় কৃষ্ণ দাসকে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলায় আটকের পর তার অনুসারীদের মধ্যে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। এই বিক্ষোভে চট্টগ্রামে বিএনপি-জামায়াতপন্থি এক আইনজীবী নিহত হন। এই ঘটনার পর বাংলাদেশে ইসকনের কার্যক্রম নিষিদ্ধের বিষয়টি সামনে আসে। মঙ্গলবার সিলেটে এক অনুষ্ঠানে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেছেন, ইসকনের আন্দোলনে দেশি-বিদেশি ইন্ধন রয়েছে। অপরদিকে বাংলাদেশে ইসকনের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব দাবি করেছেন কয়েকদিন আগেই চিন্ময় কৃষ্ণ দাসকে ইসকন থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। তবে বহিষ্কারের দাবি করলেও বৈশ্বিক ইসকনের পক্ষ থেকে গ্রেপ্তারের নিন্দা জানিয়ে বিবৃতিও দেওয়া হয়েছে। জানা গেছে, ‘বহিষ্কৃত’ হলেও চিন্ময় কৃষ্ণ দাস এখনো চট্টগ্রামের হাটহাজারীতে অবস্থিত ইসকন পরিচালিত পু-রীক ধামের অধ্যক্ষের দায়িত্বে আছেন।
সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তার আন্দোলন হচ্ছে ‘সম্মিলিত সনাতনী জাগরণ জোট’র ব্যানারে। সংগঠনটির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য বিমলা কুমার ঘোষ বলেছেন, ‘চিন্ময় কৃষ্ণ দাস ইসকন থেকে বহিষ্কৃত। সে রাষ্ট্রবিরোধী কোনো কাজ করলে আমরা তার দায় নিব না।’ পু-রীক ধামের অফিসিয়াল ফেসবুক পেজ থেকে চিন্ময় কৃষ্ণ দাসের পূর্বে ধারণকৃত একটি বক্তব্যও প্রচার করা হয়েছে।
বিভিন্ন ইসলামী সংগঠনের পক্ষ থেকে ইসকন নিষিদ্ধের দাবি তোলা হয়েছে। তথ্য উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম বলেন, ‘চিন্ময় কৃষ্ণ দাস দেশকে অস্থিতিশীল করার পরিকল্পনা করে আন্দোলনকে রাজনৈতিক মোড় দেওয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছিল।’ চিন্ময় কৃষ্ণ দাসের আসল নাম ছিল চন্দন কুমার ধর। ভক্তরা তাকে ডাকেন ‘চিন্ময় প্রভু’ নামে। গত অক্টোবরে চট্টগ্রামে একটি মিছিলের সময় জাতীয় পতাকার অবমাননার অভিযোগ ওঠে তার বিরুদ্ধে। এর আগে গত ৩ জুলাই ইসকন পরিপন্থী বিভিন্ন কাজের সঙ্গে যুক্ত থাকায় ইসকন বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় সভাপতি সত্য রঞ্জন বাড়ৈ তাকে সতর্ক করে চিঠি দেয়। সেখানে তার বিরুদ্ধ ৫টি অভিযোগও আনা হয়। পরে গত ৯ নভেম্বর ইসকন বাংলাদেশ আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক চারু চন্দ্র দাস জানান, সাংগঠনিক শৃঙ্খলা ভঙের দায়ে ইসকনের যাবতীয় কার্যক্রম থেকে চট্টগ্রামের পু-রীক ধামের অধ্যক্ষ চিন্ময় কৃষ্ণ দাসকে সংগঠন থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে।
ইসকন বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় কমিটির নেতা বিমলা কুমার ঘোষ বলেন, ‘চিন্ময় কৃষ্ণ দাসকে সতর্কীকরণের পরও যখন কথা শোনেননি তখন তাকে বহিষ্কার করা হয়। পরে তিনি দলের সভাপতি সাধারণ সম্পাদকের বিরুদ্ধে মামলাও দায়ের করেন।’
সংগঠনটির কেন্দ্রীয় কমিটি জানিয়েছে, বহিষ্কারের কারণে চিন্ময় কৃষ্ণ দাস ইসকনের হয়ে জনসম্মুখে বক্তব্য-বিবৃতি বা ধর্মীয় কোনো কাজ করতে পারবে না।
বহিষ্কার করা হলেও তিনি চট্টগ্রামের ইসকন পরিচালিত পু-রীক ধামের অধ্যক্ষের দায়িত্বে কীভাবে থাকেন এমন প্রশ্নে ইসকনের কেন্দ্রীয় কমিটির নেতা বিমলা কুমার ঘোষ বলেন, ‘তাকে আমরা পদপদবী থেকে বহিষ্কার করে দিতে পারি। কিন্তু তার গুরু শিক্ষা থেকে তো সরানোর ক্ষমতা আমাদের নেই।’
তবে তিনি জানিয়েছেন, এরপরও যেহেতু নতুন করে তাকে নিয়ে আলোচনা হয়েছে তার বিরুদ্ধে আরো নতুন কোনো সিদ্ধান্ত আসতে পারে দলের পক্ষ থেকে। যদিও চিন্ময় কৃষ্ণ দাসকে আটকের পর ভারতের হস্তক্ষেপ চেয়ে বিবৃতি দিয়েছে ইসকন বৈশ্বিক প্লাটফরম। তাদের অফিসিয়াল এক্স (পূর্বের টুইটার) হ্যান্ডেলে টুইট করে জানিয়েছে, সন্ত্রাসবাদের সঙ্গে ইসকনের যুক্ত থাকার অভিযোগ ভিত্তিহীন এবং অত্যন্ত আপত্তিজনক।
রাষ্ট্রদ্রোহ মামলায় আটকের পর তার মুক্তির দাবিতে চট্টগ্রাম আদালত প্রাঙ্গণে ইসকন সদস্যরাও গিয়েছিলেন। ওই সংঘর্ষে আইনজীবী সাইফুল ইসলাম নিহতের পর চট্টগ্রামের পু-রীক ধামের ইসকন সদস্যরাও কিছুটা বিব্রত বলেও জানিয়েছেন। সেখানে প্রতিবাদে অংশ নেওয়া নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন ইসকন সদস্য বলেন, ‘পরিকল্পিতভাবে প্রাণ নিয়ে রাজনীতি করে আমাদের ওপর দায় চাপানো হচ্ছে। অথচ ইসকন অহিংস প্রতিবাদ করে আসছে সবসময়।’ ইসকনের কেন্দ্রীয় কমিটির নেতা বিমলা কুমার ঘোষ বলেন, ‘চিন্ময় বিভিন্ন জায়গায় যে বক্তব্য রাখছে সেটা তার ব্যক্তিগত বক্তব্য। এর দায় নেবে না ইসকন।’ সনাতনী জাগরণ জোট বলছে, অভ্যন্তরীণ রাজনীতির কারণে মিথ্যা অভিযোগে ইসকন থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে চিন্ময় কুমার দাসকে।
জোটের কেন্দ্রীয় প্রতিনিধি সুমন কুমার রায় বলেন, ‘আমাদের ৮ দফা দাবি ইসকনও সমর্থন করছে। তবে বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে এক ধরনের ইসকন ফোবিয়া থাকার কারণে তারা সরাসরি অংশগ্রহণ করছে না।’
‘একটা গ্রুপ ইসকনকে ঘায়েল করার জন্য উঠেপড়ে লেগেছে। তারা ইসকন-সনাতনী জাগরণ জোটকে বাংলাদেশের মানুষের মুখোমুখি দাঁড় করাতে চায়।’
বাংলাদেশে ইসকনকে নিষিদ্ধের প্রশ্নে অ্যাটর্নি জেনারেল এম আসাদুজ্জামান হাইকোর্টকে জানান, বাংলাদেশে ইসকন নিষিদ্ধ হবে কি না সেটি সরকারের নীতিগত সিদ্ধান্তের বিষয়। এ বিষয়ে হাইকোর্টকে এখনই কোনো পদক্ষেপ না নেওয়ার আবেদন জানান রাষ্ট্রের অ্যাটর্নি জেনারেল। বাংলাদেশ সম্মিলিত সনাতনী জাগরণ জোট বলছে, একটি নৈরাজ্যের ঘটনা ভিন্নখাতে প্রবাহিত করতেই চিন্ময় কৃষ্ণ দাসকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে এবং আদালতেও বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। জোটের কেন্দ্রীয় নেতা সুমন কুমার রায় বলেন, ‘বাংলাদেশে ইসকন, হিন্দু ও ভারত এ তিন ইস্যুকে এক করে একটি দাঙ্গা লাগানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। মুসলিম সেন্টিমেন্ট কাজে লাগিয়েই তারা ইসকনের বিরুদ্ধে ফায়দা লোটার চেষ্টা করছে। ব্যর্থতা ঢাকার জন্য ইসকনকে সামনে নিয়ে আসা হচ্ছে এবং চিন্ময় দাসকে আটক একই সূত্রে গাথা।’
ইন্টারন্যাশনাল সোসাইটি ফর কৃষ্ণ কনশাসনেস (ইসকন) বা আন্তর্জাতিক কৃষ্ণভাবনামৃত সংঘ হলো বৈষ্ণব মতবাদের একটি হিন্দু ধর্মীয় সংগঠন, যারা তাদের আধ্যাত্মিক দর্শন প্রচার করে থাকেন বলে তাদের ওয়েবসাইটে উল্লেখ রয়েছে। বিশ্বের অনেক দেশে এই সংগঠনের শাখাও রয়েছে। বিশ্বের কোনো কোনো দেশে ইসকন নিষিদ্ধের ঘটনাও ঘটেছে।
মঙ্গলবার রাতে এক বিবৃতিতে ইসকন বাংলাদেশের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে সনাতনী সংগঠন হিসেবে বাংলাদেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের যেমন- হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান ও অন্যদের ধর্মীয় স্বাধীনতা এবং অধিকার রক্ষায় কাজ করেন তারা। ইসকন বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য বিমলা প্রসাদ দাস বলেন, ‘আমরা সারাবিশ্বের মতো বাংলাদেশেও সেবামূলক কাজ করি। সরকারের বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থাগুলো সেটি দেখবেন। ওনাদের কাছে সব তথ্য আছে সেটি তারা দেখবেন।’
ইসকন বাংলাদেশের সাধারণ সম্পাদক চারু চন্দ্র দাস ব্রহ্মচারী মঙ্গলবার এক বিবৃতিতে জানিয়েছেন, ‘ইসকন একটি আন্তর্জাতিক সংগঠন যা গৌড়ীয় বৈষ্ণব ধর্মীয় আদর্শ ও সনাতনী মূল্যবোধকে ধারণ করে শান্তিপূর্ণভাবে ধর্মীয় চর্চা এবং মানবকল্যাণমূলক কার্যক্রম পরিচালনা করে। আমরা সর্বদা শান্তি, সম্প্রীতি ও সৌহার্দ্যরে পক্ষে কাজ করেছি। ভবিষ্যতেও একই আদর্শে কাজ করতে অঙ্গীকারবদ্ধ।’
"