চট্টগ্রাম ব্যুরো
চট্টগ্রামে চিন্ময় সমর্থক-পুলিশ সংঘর্ষে আইনজীবী নিহত
রাষ্ট্রদ্রোহ মামলায় গ্রেপ্তার বাংলাদেশ সম্মিলিত সনাতনী জাগরণ জোটের মুখপাত্র ও আন্তর্জাতিক কৃষ্ণভাবনামৃত সংঘের (ইসকন) সাবেক নেতা চিন্ময় কৃষ্ণ দাস ব্রহ্মচারীর জামিন নামঞ্জুর করে তাকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দিয়েছেন চট্টগ্রামের এক আদালত। চিন্ময় কৃষ্ণ দাসকে কারাগারে নেওয়ার সময় তার সমর্থকদের সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। গতকাল মঙ্গলবার বিকেল ৪টায় এ সংঘর্ষে একজন আইনজীবী নিহত এবং বেশ কয়েকজন আহত হয়েছেন। চিন্ময় কৃষ্ণ দাস ব্রহ্মচারীকে গ্রেপ্তারের ঘটনায় নিন্দা জানিয়েছে ভারত।
নিহত আইনজীবী হলেন চট্টগ্রাম আদালতের সহকারী পাবলিক প্রসিকিউটর সাইফুল ইসলাম আলিফ (৩৫)। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালের পুলিশ ফাঁড়ির এএসআই আলাউদ্দিন ওই আইনজীবী নিহত হওয়ার তথ্য নিশ্চিত করেছেন। অন্যদিকে পুলিশের লাঠিচার্জে আহত হন চিন্ময়ের ছয় অনুসারী। তারা হাসপাতালে ভর্তি রয়েছেন। আহতরা হলেন- শ্রীবাস দাশ, শারকু দাশ, ছোটন, সুজিত ঘোষ, উৎপল ও এনামুল হক।
গতকাল সকাল সাড়ে ১০টায় কড়া নিরাপত্তার মধ্য দিয়ে চিন্ময় কৃষ্ণকে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট ষষ্ঠ আদালতের বিচারক কাজী শরিফুল ইসলামের আদালত তোলা হয়। পরে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলায় আদালত চিন্ময় কৃষ্ণ দাস ব্রহ্মচারীর জামিন নামঞ্জুর করে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন। বিকেল ৩টায় পুলিশ, সোয়াত ও বিজিবি সাউন্ড গ্রেনেড নিক্ষেপ ও লাঠিচার্জ করে অবরোধকারীদের ছত্রভঙ্গ করে চিন্ময়কে আদালত থেকে কারাগারে পাঠানো হয়।
চিন্ময় সমর্থকরা আদালত মসজিদের নিচতলায় থাকায় আইনজীবীর চেম্বার ও দোকান ভাঙচুর করেন। বিকেল ৪টায় রঙ্গম কনভেনশন হলের সামনে প্রধান সড়কে চিন্ময় সমর্থকদের সঙ্গে ক্ষুব্ধ আইনজীবী ও জনতার সঙ্গে সংঘর্ষ বাঁধে। ধাওয়া-পাল্টাধাওয়া ও সংঘর্ষে সাইফুল ইসলাম আলিফ নামে এক আইনজীবী গুরুতর আহত হন। পরে আহত আলিফকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হলে কর্তব্যরত চিকিৎসকরা মৃত ঘোষণা করেন।
চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল পুলিশ ফাঁড়ির এএসআই মো. আলাউদ্দিন বলেন, কোর্ট বিল্ডিং এলাকায় মারামারিতে আহত আলিফ নামে এক আইনজীবীকে হাসপাতালে আনা হয়। কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। কোর্ট বিল্ডিং এলাকা থেকে আহত আরো ছয়জনকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।
চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত উপকমিশনার (প্রসিকিউশন) মফিজুর রহমান বলেন, সকালে আসামি চিন্ময়কে আদালতে তোলা হলে শুনানি শেষে জামিনের আবেদন নামঞ্জুর করা হয়। তাকে আদালত থেকে কারাগারে নেওয়ার জন্য প্রিজন ভ্যানে তোলা হলে তার অনুসারীরা প্রিজন ভ্যান অবরোধ আশপাশে অবস্থান নেন। বারবার অনুরোধ করা হলেও অবস্থানকারীরা সরে যাননি। পরে বিকেলে পুলিশ, বিজিবি ও সোয়াত তাদের ছত্রভঙ্গ করে দেওয়ার পর আসামিকে কারাগারে পাঠানো হয়।
চিন্ময় কৃষ্ণের আইনজীবী স্বরূপ কান্তি নাথ বলেন, ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে জামিন নামঞ্জুরের পর মিচ মামলা করে আমরা মহানগর দায়রা জজ আদালতে জামিনের জন্য আবেদন করি। আদালত আবেদনটি আগামীকাল (আজ) শুনানির জন্য রেখেছেন। চিন্ময়ের অনুসারীরা সকাল থেকে শান্তিপূর্ণভাবেই আদালত ভবনের নিচতলায় অবস্থান করছিলেন। বিকেলে পুলিশ, বিজিবি বিনা উসকানিতে সাধারণ সনাতনীদের উপর লাঠিচার্জ ও হামলা করে অনেককে আহত করেন। আদালত ভবনের নিচে এমন হামলা নজিরবিহীন। স্বাধীনতার পর এই প্রথম আদালতে এমন কলঙ্কজনক ঘটনা ঘটল।
সরেজমিনে দেখা যায়, দুপুর ১২টা থেকেই শত শত নারী-পুরুষ চিন্ময় কৃষ্ণ দাস ব্রহ্মচারীকে বহন করা প্রিজন ভ্যান আটকে স্লোগান দিয়ে বিক্ষোভ শুরু করেন। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে চিন্ময় অনুসারীদের সংখ্যাও বাড়তে থাকে। এ সময় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিপুল পরিমাণ সদস্য নির্বিকার দাঁড়িয়ে ছিল। দুপুর ২টায় পুলিশ অবরোধকারীদের সরানোর চেষ্টা করলে উত্তেজনার সৃষ্টি হয়। তখন আদালতপাড়ার নিচতলায় মালখানার পুরোনো একট মিনি ট্রাক ও একটি নোহা প্রিজন ভ্যানের সামনে সড়কের ওপর এনে অবরোধ করেন। অনেক অবরোধকারীকে তখন মাটিতে শুয়ে পড়তে দেখা যায়।
আদালতপাড়ায় উত্তেজনা বেড়ে গেলে চট্টগ্রাম মহানগর দায়রা জজ মো. সাইফুল ইসলামের চেম্বার মহানগর পিপি অ্যাডভোকেট মফিজুল হক ভূঁইয়া, চট্টগ্রাম আইনজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদক আশরাফ হোসেন চৌধুরী রাজ্জাককে ঢুকতে দেখা যায়। তখন মহানগর দায়রা জজ আদালতের বাইরে শতাধিক চিন্ময়ের আইনজীবী মিস-কেস শুনানি করার জন্য অপেক্ষা করছিলেন। তখনই আদালত ভবনের নিচতলায় অবস্থান নেওয়া কয়েকশ পুলিশ, সোয়াত ও বিজিবি সদস্যরা একযোগে বাঁশি বাজিয়ে প্রথমে সাউন্ড গ্রেনেডের বিস্ফোরণ ঘটান। তারপর অবরোধকারীদের ওপর লাঠিচার্জ করে ছত্রভঙ্গ করে দেন। তিন বাহিনীর ১৫-২০ মিনিটের অ্যাকশনে আদালত ভবনের নিচতলায় থেকে ছত্রভঙ্গ হয়ে যে যেদিকে পেরেছে নিরাপদ স্থানে চলে যায়। আদালত ভবনের পাহাড় থেকে নিচে মূল সড়কে যাওয়ার সময় সড়কের পাশে পার্কিংয়ে থাকা গাড়ি ভাঙচুর করেন।
এ খবর ছড়িয়ে পড়লে জেলা পরিষদের সামনে শতাধিক ক্ষুব্ধ আইনজীবী ও অবরোধবিরোধী মানুষ চিন্ময় অনুসারীদের রঙ্গম কনভেনশন গলির দিকে ধাওয়া করেন। তখন চিন্ময় অনুসারীরাও পাল্টা ধাওয়া দেয়। ধাওয়া-পাল্টাধাওয়ার সময় আলিফ নামে এক আইনজীবীকে এলোপাতাড়ি কোপানো হয়। এতে তার শরীর অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ হতে থাকে। তাকে দ্রুত চমেক হাসপাতালে নিয়ে গেলে সেখানে তিনি মারা যান। এর আগে সোমবার ঢাকা থেকে চট্টগ্রামে যাওয়ার সময় শাহজালাল বিমানবন্দর থেকে ডিবি পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করেন। গত ৩১ অক্টোবর চট্টগ্রাম নগরের চান্দগাঁও মোহরা ওয়ার্ড বিএনপির সাধারণ সম্পাদক ফিরোজ খান বাদী হয়ে কোতোয়ালি থানায় চিন্ময় কৃষ্ণ দাস ব্রহ্মচারীসহ ১৯ জনের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা করেন।
চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের অতিরিক্ত জনসংযোগ কর্মকর্তা আজিজ বলেন, পুলিশের সিনিয়র কর্মকর্তারা মাঠে সতর্ক অবস্থানে রয়েছেন। সনাতনীদের নিরাপত্তার বিষয়টিও গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে।
ইসকনের প্রতিবাদ : এদিকে বাংলাদেশ সম্মিলিত সনাতনী জাগরণ জোটের মুখপাত্র চিন্ময় কৃষ্ণ দাসের গ্রেপ্তারের ঘটনায় তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছে ইসকন বাংলাদেশ। গতকাল এক বিবৃতিতে এ প্রতিবাদ জানায় ইসকন। সেই সঙ্গে তারা দেশের বিভিন্ন স্থানে সনাতনী সম্প্রদায়ের ওপর হামলা ও সহিংসতার প্রতিবাদ জানিয়েছে। ইসকন বাংলাদেশের সাধারণ সম্পাদক চারুচন্দ্র দাস ব্রহ্মচারী এ প্রতিবাদ জানান।
চিন্ময় কৃষ্ণের গ্রেপ্তার ইস্যুতে ভারতের উদ্বেগ : বাংলাদেশ সম্মিলিত সনাতনী জাগরণ জোটের মুখপাত্র ও চট্টগ্রামের হাটহাজারীর পু-রীক ধামের অধ্যক্ষ প্রভু চিন্ময় কৃষ্ণ দাস ব্রহ্মচারীকে গ্রেপ্তারের ঘটনায় নিন্দা জানিয়েছে ভারত।
ভারতীয় গণমাধ্যম এনডিটিভি জানিয়েছে, মঙ্গলবার ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে বাংলাদেশি কর্তৃপক্ষকে হিন্দু এবং অন্য সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নিরাপত্তা ও সুরক্ষা নিশ্চিত করার আহ্বান জানিয়েছে। বিবৃতিতে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানায়, বাংলাদেশ সম্মিলিত সনাতন জাগরণ জোটের মুখপাত্র চিন্ময় কৃষ্ণ দাসকে গ্রেপ্তার ও জামিন নাকচ করার বিষয়টি আমরা গভীর উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ্য করেছি। বাংলাদেশে হিন্দু এবং অন্য সংখ্যালঘুদের ওপর একাধিক হামলার পরে এখন এ ঘটনা ঘটল। বিবৃতিতে ভারত দাবি করে, বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের বাড়িঘর ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে অগ্নিসংযোগ ও লুটপাটের পাশাপাশি চুরি ও ভাঙচুর এবং দেবতা ও মন্দির অবমাননার একাধিক নথিভুক্ত ঘটনা রয়েছে। বিবৃতিতে বাংলাদেশ সরকারের প্রতি হিন্দু ধর্মাবলম্বীসহ সব সংখ্যালঘুর শান্তিপূর্ণ সমাবেশ ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতার অধিকার প্রতিষ্ঠা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করার আহ্বান জানানো হয়েছে। সনাতন ধর্মাবলম্বীদের কাছে তিনি চিন্ময় প্রভু নামে পরিচিত।
বাংলাদেশ সীমান্ত অবরোধের হুমকি বিজেপির : ইসকন নেতা চিন্ময় কৃষ্ণ দাসের গ্রেফতারের বিষয়টি মানতে পাড়ছে না বিজেপি। তার মুক্তি দাবি করেছে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য বিজেপি। এমনকি তাকে মুক্তি না দিলে বাংলাদেশ সীমান্ত সনাতনীরা অবরোধ করবে বলেও হুমকি দিয়েছেন রাজ্যটির বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী। একইসঙ্গে কলকাতার বাংলাদেশ ডেপুটি হাইকমিশনের সামনে বিক্ষোভেরও হুমকি দিয়েছেন তিনি।
চিন্ময় কৃষ্ণ দাসের গ্রেপ্তার নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে বিজেপি নেতা শুভেন্দু অধিকারী সাংবাদিকদের কাছে দাবি করেন, চিন্ময়কৃষ্ণ প্রভুকে মুক্তি না দিলে সীমান্তে সনাতনীরা অবরোধ করবে। ভারত থেকে পশ্চিমবঙ্গ দিয়ে কোনও পরিষেবা বাংলাদেশে ঢুকতে দেব না।
টাঙ্গাইল ও বরিশালে বিক্ষোভ : চিন্ময় কৃষ্ণ দাসকে গ্রেপ্তারের প্রতিবাদ এবং তার মুক্তির দাবিতে টাঙ্গাইল ও বরিশালে বিক্ষোভ মিছিল ও প্রতিবাদ সভা হয়েছে। সম্মিলিত সনাতনী জাগরণ জোট টাঙ্গাইল শাখার আয়োজনে গতকাল মঙ্গলবার সকালে প্রেস ক্লাবের সামনে সমাবেশ হয়। চিন্ময় কৃষ্ণ দাসের দ্রুত মুক্তির দাবি জানিয়ে বক্তারা বলেন, এই দেশ আমাদের মাতৃভূমি। আমাদের পূর্বপুরুষের জন্ম এখানেই। আমরা আছি এবং এই দেশেই মৃত্যুবরণ করব। সভায় বক্তব্য দেন বাংলাদেশ জাতীয় হিন্দু মহাজোটের সভাপতি বিপ্লব দত্ত পল্টন, বটতলা ইসকন মন্দিরের সভাপতি শ্রীধর দাস, সাবালিয়া ইসকন মন্দিরের সভাপতি সত্য সেবক প্রমুখ।
"