মেহেদী হাসান
জেলেদের ছাগলের টাকাও লুট
বৃহত্তর কুমিল্লা জেলার মৎস্য চাষি ও জেলেদের ভাগ্যোন্নয়নে তৎকালীন হাসিনা সরকারের সময় ঢাকঢোল পিটিয়ে বেশকিছু উদ্যোগ নেয় মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ২০৬ কোটি টাকায় ‘বৃহত্তর কুমিল্লা জেলায় মৎস্য উন্নয়ন প্রকল্প (১ম সংশোধিত)’ অনুমোদন দেওয়া হয়। আওয়ামী লীগ দলীয় লোকজন নিয়ে জনবল নিয়োগ দেওয়া হয়। তারা প্রভাব খাটিয়ে টেন্ডার বাগিয়ে ও বিল-ভাউচার, কোটেশনের মাধ্যমে কেনাকাটার নামে লুটপাট ও অপচয় করে প্রকল্পের টাকা। জেলেদের জন্য বরাদ্দ জাল ও আয়বর্ধক উপকরণ ছাগল, সেলাই মেশিন ক্রয়-বিতরণসহ অঙ্গভিত্তিক বিভিন্ন খাতে অনিয়মের মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা লোপাট করা হয়।
কৃষি ও অডিট অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, ২০২২ সালের জুনে শেষ হয় বৃহত্তর কুমিল্লা জেলায় মৎস্য উন্নয়ন প্রকল্প। এর ২ মাস পর অডিট আপত্তি আসে। বের হয়ে আসে লুটপাটের নানা তথ্য। প্রকল্প পরিচালককে ১৩ সেপ্টেম্বর থেকে ১৯ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৫ দিন সময় দেওয়া হয়। প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর ও মৎস্য অধিদপ্তরের ২০২০-২১ অর্থবছরের হিসাব-সম্পর্কিত কমপ্লায়েন্স অডিট রিপোর্টে কোটেশন ভাউচারের মাধ্যমে টাকা লুটপাটের তথ্য বেরিয়ে আসে।
অনুসন্ধানে জানা যায়, প্রকল্পের আওতায় বৃহত্তর কুমিল্লা মৎস্য উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় ২০২১ সালের ২৮ নভেম্বর ই-টেন্ডারের (৬২৭৩৬২) মাধ্যমে চাঁদপুর সদর, মতলব উত্তর-দক্ষিণ ব্ল্যাক বেঙ্গল জাতের ছাগলও এআইজিএ পণ্য ক্রয়ের আহ্বান করেন প্রকল্প পরিচালক আবদুস সাত্তার। একই টেন্ডারে ভেড়া ও এআইজিএ উপকরণ (৬২৭৩৫৩) ক্রয় করা হয় ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগর, আখাউড়া, নবীনগর ও ব্রাহ্মণপুর উপজেলায় বিতরণের জন্য। ২০২২ সালে চাঁদপুরের মতলব দক্ষিণ উপজেলার জেলেদের মধ্যে বিতরণের জন্য ৬০টি ছাগল বরাদ্দ হয়। প্রতিটি ছাগলের দাম ধরা হয় ৮ হাজার টাকা। ১৬ জন জেলেকে দেওয়া হয় ৩২টি ছাগল। এরই মধ্যে ১৩টিই মারা যায় এক সপ্তাহের ব্যবধানে। বাকি ২৮টি ছাগলের টাকা ঠিকাদার ও মৎস্য কর্মকর্তা টাকা ভাগ-বাটোয়ারা করেন বলে অভিযোগ ওঠে। কম বয়সি ও কম দামের ছাগল বিতরণ করে সেখানেও সরকারি টাকা নয়ছয় করেন ঠিকাদার। প্রকল্পে জেলেদের বিকল্প আয়বর্ধনমূলক উপকরণ (এআইজিএ) বিতরণে কারচুপির মাধ্যমে অর্থ হাতিয়ে নেয় প্রকল্প সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। সূত্র বলছে, জেলেদের বেড় জাল কিনতে ৮ কোটি ২৩ লাখ ৬৫ হাজার ২৮০ টাকার কেনাকাটা করা হয় কোটেশনের মাধ্যমে। ২০২০-২১ অর্থবছরে আরডিপিপিতে সংস্থান না থাকা সত্ত্বেও এবং ওপেন টেন্ডার ম্যাথডের (ওটিএম) পরিবর্তে কোটেশন (আরএফকিউ) পদ্ধতিতে এআইজিএ ও বেড়জাল কেনা হয়। এই কেনাকাটার বেশিরভাগই মালামাল প্রদান না করেই বিল করা হয়েছে। এছাড়া ২ থেকে ৩ লাখ টাকার কেনাকাটা অর্থাৎ অফিস স্টেশনারি ক্রয়ে ব্যাপক অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে। প্রকল্প শেষে মালামাল স্টোরে জমা দেওয়ার কথা থাকলেও সঠিক তালিকার মাধ্যমে তা জমা দেওয়া হয়নি।
বৃহত্তর কুমিল্লা (কুমিল্লা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও চাঁদপুর) জেলার ৩৪টি উপজেলায় মাছের উৎপাদন বাড়াতে গৃহীত প্রকল্পে পুকুর পুনঃখনন, অভয়াশ্রম স্থাপন, চাষি প্রশিক্ষণ, এআইজিএ প্রশিক্ষণ, জাল, ছাগল, সেলাই মেশিন ক্রয়-বিতরণসহ অঙ্গভিত্তিক বিভিন্ন খাতের অনিয়মের তথ্য গণমাধ্যমে প্রকাশ পেতে থাকে।
অডিট রিপোর্টেও তথ্য বলছে, বৃহত্তর কুমিল্লা জেলায় মৎস্য উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় কুমিল্লা, চাঁদপুর ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার ২৮টি উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা ওপেন টেন্ডারের পরিবর্তে কোটেশনের মাধ্যমে কেনাকাটা করেন। কাজ পান আওয়ামী লীগের নেতারা। জেলেদের এআইজিএ উপকরণ কিনতে ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানকে ৬ কোটি ২৩ লাখ ৮৯ হাজার ৩০ টাকা পরিশোধ করা হয়। প্রকল্পের আওতায় কুমিল্লা, চাঁদপুর ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার ১১টি উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা কোটেশনের মাধ্যমে বেড়জাল ক্রয় করেন। সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানকে ১ কোটি ৯৯ লাখ ৭৬ হাজার ২৫০ টাকা পরিশোধ করা হয়। ফলে সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানকে এআইজিএ ও বেড়জাল ক্রয় বাবদ ৮ কোটি ২৩ লাখ ৬৫ হাজার ২৮০ টাকা পরিশোধ করা হয়।
প্রকল্পে ২০১৯-২০ অর্থবছরে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার জন্য ওপেন টেন্ডার পদ্ধতি বাধ্যবাধকতা থাকলেও কোটেশন পদ্ধতিতে এডিপি টপকিয়ে ১০টি বিলের মাধ্যমে ১০০টি বেড় জাল কেনা হয় ৫০ লাখ টাকায়। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগর উপজেলায় ছয়টি বিল-ভাউচারে ২৫ লাখ ৫৯ হাজার ২০০ টাকা, সরাইল উপজেলায় ছয়টি বিল-ভাউচারে ২৫ লাখ ৫৯ হাজার ৭০০ টাকা, বাঞ্চারামপুর উপজেলায় পাঁচটি বিল ভাউচারে ২০ লাখ ৭৯ হাজার ৭৮০ টাকা, আখাউড়া উপজেলায় ছয়টি বিল ভাউচারে ২৫ লাখ ৫৯ হাজার ৮৫০ টাকাসহ সবমিলিয়ে কুমিল্লা, চাঁদপুর ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার ২৮টি উপজেলায় সর্বমোট ৬ কোটি ২৩ লাখ ৮৯ হাজার ৩০ টাকার কেনাকাটা করা হয়।
তথ্য বলছে, কুমিল্লা, চাঁদপুর ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিভিন্ন উপজেলার জন্য এআইজিএ উপকরণ হিসেবে সেলাই মেশিন সেট এবং বেড় জাল কেনা করা হয়। ওপেন টেন্ডার ও কোটেশন মিলিয়ে ৪২০ সেট সেলাই মেশিন ও সরঞ্জাম ক্রয় করা হয়। মেসার্স শিল্পী স্টোর নামে একটি সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান ২০২০ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি ১৪৫ নম্বর বিলের মাধ্যমে ১১ হাজার ৮৯৮ টাকা দরে সেই সেলাই মেশিন সেট ও সরঞ্জাম প্রকল্পে সরবরাহ করে। একই বিলের সাব-সরবরাহকারী চাঁদপুরের হাজীগঞ্জ উপজেলার বাবুল স্টোর ১১, ১২ ও ২৪ নম্বর বিলে ২০১৯ সালে ৯০ সেট সেলাই মেশিন প্রকল্পে সরবরাহ করে। বাবুল স্টোরের স্বত্বাধিকারী হাজীগঞ্জ বাজার থেকে সবচেয়ে নিম্নমানের প্রতি সেট মেশিন ৫ হাজার ৩০০ টাকায় ক্রয় করে প্রকল্পে ১১ হাজার ৮৯৮ টাকার বিল প্রদান করে। প্রকল্পে ৯০ সেট সেলাই মেশিন সরবরাহ করে বাবুল হাতিয়ে নেন এক লাখ ৩৪ হাজার ৭২০ টাকা। একইভাবে চাঁদপুরের ফরিদগঞ্জ উপজেলায় প্রকল্পে ১৪০ সেট মেশিন একই দামে সরবরাহ করা হয়। সেখানেও নিম্নমানের সেলাই মেশিন ও সরঞ্জাম সরবরাহের মাধ্যমে টাকা লোপাট করা হয়।
পরবর্তী ধাপে কোটেশনের মাধ্যমে অতিরিক্ত দরে ৯৫০ সেট ১৬ হাজার টাকা, ২০ সেট ১৫ হাজার ৯৯০ টাকা এবং ২০ সেট ১৫ হাজার ৯০০ টাকা দরে ক্রয় করে প্রকল্প কর্তৃপক্ষ। উল্লেখিত দরে ৯৯০ সেট সেলাই মেশিন ও সরঞ্জামের ক্রয়মূল্য ১ কোটি ৫৮ লাখ ৩৭ হাজার ৮০০ টাকা। ৯৫০ সেট সেলাই মেশিন ক্রয়ে ৩৮ লাখ ৯৬ হাজার ৯০০ টাকা, ২০ সেট সেলাই মেশিন ক্রয়ে ৮১ হাজার ৮৪০ টাকা এবং আরো ২০ সেট সেলাই মেশিন ক্রয়ে ৮০ হাজার ৪০ টাকা দরে কেনা হয়। ফলে কোটেশনে কেনাকাটা করায় সরকারের আর্থিক ক্ষতি হয় ৪০ লাখ ৫৮ হাজার ৭৮০ টাকা।
এছাড়া ২০১৯-২০ অর্থবছরে কোটেশনের মাধ্যমে জেলেদের এআইজিএ ক্রয় বাবদ ১ কোটি ৫৮ লাখ সাত হাজার ৮০০ টাকা অনিয়মিতভাবে ব্যয় করা হয়েছে বলে নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রতিবেদন সূত্রে জানা গেছে।
আইন অনুযায়ী, ‘কোটেশনে রাজস্ব বাজেটের অধীন ক্রয়ের ক্ষেত্রে-পণ্য ও সংশ্লিষ্ট সেবা ক্রয়ের জন্য প্রতিটি ক্ষেত্রে অনধিক ৩ (তিন) লক্ষ টাকা; তবে বৎসরে সর্বোচ্চ ১৫ (পনেরো) লক্ষ টাকা। কার্য ও ভৌত সেবা ক্রয়ের জন্য প্রতিটি ক্ষেত্রে অনধিক ৬ (ছয়) লক্ষ টাকা; তবে বৎসরে সর্বোচ্চ ২৫ (পঁচিশ) লক্ষ টাকা। উন্নয়ন বাজেটের অধীন ক্রয়ের ক্ষেত্রে পণ্য ও সংশ্লিষ্ট সেবা ক্রয়ের জন্য প্রতিটি ক্ষেত্রে অনধিক ৫ (পাঁচ) লক্ষ টাকা; তবে বৎসরে সর্বোচ্চ ৩০ (ত্রিশ) লক্ষ টাকা। কার্য ও ভৌত সেবা ক্রয়ের জন্য প্রতিটি ক্ষেত্রে অনধিক ১০ (দশ) লক্ষ টাকা; তবে বৎসরে সর্বোচ্চ ৬০ (ষাট) লক্ষ টাকা নির্ধারণ করা রয়েছে।’ তবে প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা কেউই তোয়াক্কা করেননি।
এই আর্থিক অনিয়মের বিষয়ে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিব বরাবর ২০২২ সালের ১৭ জানুয়ারি এআইআর ২০২২ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি তাগিদপত্র এবং ২০২২ সালের ১৫ মার্চ ডিও লেটার ইস্যু করা হলেও প্রকল্পসংশ্লিষ্টদের পক্ষ থেকে নিষ্পত্তিমূলক কোনো জবাব পাওয়া যায়নি।
বৃহত্তর কুমিল্লা জেলায় মৎস্য উন্নয়ন প্রকল্পের দুর্নীতি অনিয়মের বিষয়ে জানতে চাইলে প্রকল্প পরিচালক আবদুস সাত্তার বলেন, আমি প্রকল্পের শেষ সময়ে পরিচালক হই। আমার আগে আরেকজন ছিলেন। পরে ফোন বন্ধ করেন এই প্রকল্প পরিচালক।
"