মিজান রহমান
হরিলুটের অন্যতম উৎস ছিল কুইক রেন্টাল
আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে বিদ্যুৎ খাতে হরিলুটের অন্যতম উৎস ছিল কুইক রেন্টাল নামের ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র। তখন বিনা টেন্ডারে প্রয়োজনের চেয়ে দ্বিগুণের বেশি বিদ্যুৎকেন্দ্রের অনুমোদন দেওয়া হয়। আর বিদ্যুৎকেন্দ্রের ক্যাপাসিটি চার্জের নামে আওয়ামী লীগ সরকার ১৫ বছরেরও বেশি সময় মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার দেশের বাইরে পাচারের সুযোগ করে দেয়। আর এ কাজটি করেছে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে থাকা তৎকালীন মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, উপদেষ্টা, বিদ্যুৎ বিভাগের জ্যেষ্ঠ সচিবসহ এ বিভাগের শীর্ষ কর্মকর্তাদের সিন্ডিকেট। এই সিন্ডিকেট বিশেষ আইনে, বিনা দরপত্রে প্রতিযোগিতা ছাড়াই তৎকালীন সরকারের ঘনিষ্ঠ ও আওয়ামী লীগ সমর্থক ব্যবসায়ীদের রেন্টাল-কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের সুবিধা দেয়। এই নীতিবিরোধী কাজকে দেওয়া হয় আইনগত দায়মুক্তি।
বিদ্যুৎসংকটকে পুঁজি করে ক্ষমতার কেন্দ্রে থাকা একটি সিন্ডিকেট হাতিয়ে নিয়েছিল রাষ্ট্রের হাজার হাজার কোটি টাকা। আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে রেন্টাল-কুইক রেন্টালের আড়ালে অস্বাভাবিক দরে বিদ্যুৎ কেনার নামে বলতে গেলে দেশের বিপুল অঙ্কের টাকা তুলে দেওয়া হয়েছিল ওই সিন্ডিকেটর হাতে, যারা এর বড় অংশই আবার বিদেশে পাচার করেছে। ক্যাপাসিটি চার্জের নামে এরা হাতিয়ে নিয়েছিল প্রায় ২৯ হাজার কোটি টাকা। অন্তর্বর্তী সরকার এসব অনিয়ম খতিয়ে দেখার উদ্যোগ নিয়েছে ঠিকই, তবে তার আগেই দেশের টাকা চলে গেছে বিদেশে। বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত পর্যালোচনা করে এমন চিত্র পাওয়া গেছে।
রেন্টাল-কুইক রেন্টালে লুটপাটগণ-অভ্যুত্থানে ক্ষমতা হারানো আওয়ামী লীগ সরকার জরুরিভিত্তিতে বিদ্যুতের ঘাটতি মেটাতে রেন্টাল-কুইক রেন্টাল (ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র) বিদ্যুৎকেন্দ্র চালু করে। ২০১০ সালে বিনা টেন্ডারে দায়মুক্তি আইন বা বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি (বিশেষ বিধান) আইন করে এসব বিদ্যুৎকেন্দ্রের লাইসেন্স দেওয়া হয়েছিল। শুরুতে তিন বছরের জন্য এসব বিদ্যুৎকেন্দ্রের লাইসেন্স দেওয়া হলেও দফায় দফায় বাড়ানো হয়েছে মেয়াদ। কোনোটি চলছে ১০ বছর, আবার কোনোটি এখন পর্যন্ত চলছেই। এসব তেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদন ব্যয়ও বেশি। এরপরও এসব বিদ্যুৎকেন্দ্রের মেয়াদ কয়েক দফায় বাড়ানো হয়েছে। এসব বিদ্যুৎকেন্দ্রের ক্যাপাসিটি চার্জও নির্ধারণ করা হয় অতি উচ্চ হারে। এর মাধ্যমে বিদ্যুৎ খাত থেকে লুটে নেওয়া হয়েছে বিপুল পরিমাণ অর্থ, যা বিভিন্ন সময়ে উঠে এসেছে।
অন্তর্বর্তী সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে রেন্টাল ও কুইক রেন্টালের আর কোনো বিদ্যুৎকেন্দ্রের চুক্তি নবায়ন করবে না। এরই মধ্যে স্থগিত করা হয়েছে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের দায়মুক্তির আইনটিও, যার মাধ্যমে বিনা দরপত্রে কাজ পাওয়ার সুযোগ নিত বিশেষ একটি মহল। অন্তর্বর্তী সরকারের গঠিত বিদ্যুৎ ও জ্বালানি বিভাগের চুক্তিগুলো পর্যালোচনাসংক্রান্ত জাতীয় পর্যালোচনা কমিটি এ নিয়ে মন্ত্রণালয়ে কয়েক দফা বৈঠকও করেছে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (বিপিডিবি) কর্মকর্তারা জানান, রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোকে ৮০ থেকে ৮৫ শতাংশ সক্ষমতায় ব্যবহার করা হবে এমন শর্তে লাইসেন্স দেওয়া হলেও বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো গড়ে চলেছে ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ। অর্থাৎ এসব বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে বছরের ৭০ থেকে ৭৫ শতাংশ সময় বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়নি, বরং অলস বসেছিল।
আওয়ামী লীগ সরকারের শেষ তিন মেয়াদে বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোকে ১ লাখ ৬ হাজার কোটি টাকার বেশি ক্যাপাসিটি চার্জ দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে ৩২টি রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রকে ক্যাপাসিটি চার্জ বাবদ দেওয়া হয়েছে ২৯ হাজার কোটি টাকা। বিদ্যুৎ না কিনলেও চুক্তি অনুসারে সরকারকে নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ পরিশোধ করতে হয় কেন্দ্র মালিকদের, এটি ক্যাপাসিটি চার্জ। গত ছয় অর্থবছরে এসব রেন্টাল-কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে ২১ হাজার কোটি টাকার বিদ্যুৎ কিনেছে বিপিডিবি।
রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিষয়ে কনজিউমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্বালানি উপদেষ্টা ও জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. এম শামসুল আলম বলেন, ‘বিনা টেন্ডারে পছন্দের লোকদের বিদ্যুৎকেন্দ্র দিয়ে ব্যবসা করার সুযোগ দেওয়া হয়েছিল। এটা এক ধরনের লুণ্ঠন ছাড়া আর কিছু নয়। এ খাতে কোথায় কত টাকা খরচ করেছে, কত লাভ করছে তা নিয়ে প্রশ্নও তোলার সুযোগ রাখেনি। আইন করে দায়মুক্তি দিয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘এসব রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের মেয়াদ বাড়ানোর আর কোনো প্রয়োজন নেই, কারণ এসব কেন্দ্রে জ্বালানি খরচ অত্যধিক বেশি হয়। রেন্টাল-কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎ খাত উন্নয়নে একটি কলঙ্কজনক অধ্যায়, জনগণ এতে জ্বালানির অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। নো ইলেকট্রিসিটি নো পেমেন্ট নীতির বিষয়টিও কারিগরিভাবে গ্রহণযোগ্য হওয়ার কথা নয়।’
এই দায়মুক্তি আইনের অধীনে ৭২টি রেন্টাল ও ইনডিপেনডেন্ট পাওয়ার প্রডিউসার (আইপিপি) কেন্দ্রের অনুমতি দেওয়া হয়। বিনা দরপত্রে প্রতিযোগিতা ছাড়াই এসব বিদ্যুৎকেন্দ্রের বড় অংশই পেয়েছেন তৎকালীন সরকারের ঘনিষ্ঠ ও প্রভাবশালী ব্যবসায়ীরা। এর মধ্যে সামিট, ওরিয়ন, দেশ এনার্জি, ডরিন পাওয়ার, ইউনাইটেড, এনার্জিপ্যাক অন্যতম। সে সময় বিনা দরপত্রে বিদ্যুৎকেন্দ্র পাওয়ার শীর্ষে ছিল সামিট গ্রুপ।
বিপিডিবির তথ্যানুযায়ী, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর ক্যাপাসিটি চার্জ ছিল প্রায় ৩২ হাজার কোটি টাকা, যার বড় একটি অংশ গেছে রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রে। এর আগে ২০২২-২৩ অর্থবছরে এর পরিমাণ ছিল ২৮ হাজার কোটি টাকা, যা ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ছিল ৫ হাজার ৬০০ কোটি টাকা।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, ‘২০০৯-১০ সালের বিদ্যুৎ খাত এবং এখনকার বিদ্যুৎ খাত এক নয়। তখন জরুরিভিত্তিতে বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর সঙ্গে চুক্তি করা হয়েছিল। চুক্তিগুলো ছিল তিন থেকে পাঁচ বছরের, কিন্তু এরপর এগুলোর সঙ্গে একই শর্তে কেন চুক্তি নবায়ন করা হলো তা আমি বুঝতে পারছি না। দেশ এখন একটি অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। এখন এগুলোকে বসিয়ে বসিয়ে ভাড়া দেওয়া অর্থনীতির বড় বিপর্যয়ের কারণ হতে পারে।’
অন্তর্বর্তী সরকারের বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান বলেন, ‘নতুন করে কুইক রেন্টাল চুক্তি নবায়ন করা হবে না। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে করা চুক্তিগুলো দুটি কমিটি পর্যালোচনা করছে। কমিটির পরামর্শের ভিত্তিতে আমরা কাজ করব। এ বিষয়ে যথাযথ চিন্তা করেই বিপিডিবিকে সিদ্ধান্ত বলে দিয়েছি।’
"