প্রতিদিনের সংবাদ ডেস্ক
সংস্কারের পর হবে নির্বাচন
এএফপির সাক্ষাৎকারে ড. ইউনূস
বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, স্বৈরশাসক শেখ হাসিনা ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর ভোটের মাধ্যমে দেশে একটি নতুন সরকার নির্বাচিত করার আগে নানা সংস্কার দরকার। খবর এএফপির।
গত বুধবার বার্তা সংস্থা এএফপিকে এ কথা বলেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস। তিনি বর্তমানে জাতিসংঘের জলবায়ু সম্মেলনে (কপ-২৯) অংশ নিতে আজারবাইজানের রাজধানী বাকুতে অবস্থান করছেন। এ সম্মেলনের ফাঁকে এএফপিকে সাক্ষাৎকার দেন ক্ষুদ্রঋণের এ পথিকৃৎ। শান্তিতে নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, সংস্কারের গতিই ঠিক করে দেবে, নির্বাচন কত দ্রুত হবে। তবে ড. ইউনূস জোর দিয়ে বলেন, তিনি দেশকে একটি গণতান্ত্রিক নির্বাচনের দিকে নিয়ে যাবেন। প্রধান উপদেষ্টা, ‘এটি একটি প্রতিশ্রুতি, যা আমরা দিয়েছি। আমরা প্রস্তুত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই নির্বাচন দেব এবং নির্বাচিত ব্যক্তিরা ক্ষমতা গ্রহণ করে দেশ পরিচালনা করতে পারবেন।’ ড. ইউনূস আরো বলেন, সম্ভাব্য সাংবিধানিক সংস্কারের পাশাপাশি সরকার, জাতীয় সংসদ ও নির্বাচনী বিধিমালার কাঠামোর বিষয়ে দেশে দ্রুত ঐকমত্য দরকার।
প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস বলেন, ‘আমরা অন্তর্বর্তী সরকার। তাই আমাদের মেয়াদ যতটা সম্ভব সংক্ষিপ্ত হওয়া উচিত।’ শিক্ষার্থীদের নেতৃত্বাধীন গণঅভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার পতন হয়। এরপর অন্তর্বর্তী সরকারকে নেতৃত্ব নেওয়ার জন্য প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে ড. ইউনূসের নাম ঘোষণা করা হয়। প্রথমে সরকারি চাকরিতে কোটাব্যবস্থা সংস্কারের দাবিতে লাখো মানুষ প্রতিবাদ-বিক্ষোভে নামেন। পরে তা শেখ হাসিনার ১৫ বছরের কঠোর শাসনের অবসান দাবিতে দেশব্যাপী গণআন্দোলনে রূপ নেয়। গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা হেলিকপ্টারে করে ভারতে পালিয়ে যান। এর আগে অনেক মানুষ নিহত হন, যাদের মধ্যে অনেকে পুলিশের নৃশংস দমন-পীড়নে প্রাণ হারান।
শেখ হাসিনাকে ক্ষমতাচ্যুত করার পর থেকে বাংলাদেশ অস্থিতিশীল পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। তার শাসনামলে ব্যাপক মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা
ঘটেছে। এর মধ্যে তার রাজনৈতিক বিরোধীদের গণগ্রেপ্তার ও বিচারবহির্ভূত হত্যার বিষয়টি আছে। ড. ইউনূস বলেন, ‘যেকোনো সরকারই স্থিতিশীলতার বিষয়টি নিয়ে উদ্বিগ্ন থাকবে। আমরাও উদ্বিগ্ন।’ তিনি বলেন, ‘আশা করছি, আমরা এটি সমাধান করতে পারব এবং শান্তিপূর্ণ আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি পাব।’ নোবেলজয়ী এ অর্থনীতিবিদ বলেন, বিপ্লবের পর মাত্র ৩ মাস পেরিয়েছে। প্রায় ১৭ কোটি মানুষের দেশ বাংলাদেশ। দেশটি আর্থিকভাবে কঠিন পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। চলতি মাসের শুরুর দিকে ভারতীয় শিল্পগোষ্ঠী আদানি প্রায় ৮৫ কোটি মার্কিন ডলার অপরিশোধিত বিল পরিশোধের দাবিতে বাংলাদেশে বিদ্যুৎ সরবরাহ অর্ধেক কমিয়ে দিয়েছে।
গত ৭ অক্টোবর দেশের প্রথম সারির একটি গণমাধ্যমে সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস। সাক্ষাৎকারে তিনি বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে নিজের অবস্থান ধরেছেন। কীভাবে তিনি প্রধান উপদেষ্টা হলেন, সে তথ্যও দর্শকদের দিয়েছেন। তিনি সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘আমার অফিস থেকে আমার সঙ্গে যারা যোগাযোগ রাখে তারা বলছিল, ‘স্যার এখন ফিরবেন না, এখন অবস্থা ভালো না। এলেই বোধ হয় আপনাকে জেলে নিয়ে যাবে। আপনি একটু দূরে থাকেন। পরিস্থিতি বুঝে আপনাকে বলব, কখন আসতে হবে।’ কাজেই আমি পরিকল্পনা করছিলাম বার্লিনে যাব, বার্লিনের পর রোমে যাব। তারপর ব্রাজিল যাব ইত্যাদি। দেশে ফিরে আসব এবং এরকম একটা দায়িত্ব নিতে হবে, এটা একদম মাথায় ছিল না। এ সময় ছাত্রদের একজন আমার অফিসকে জানাল, আমার সঙ্গে আলাপ করতে চায়। ছাত্রদের কথা এই প্রথম শুনলাম। জানতে চাইলাম, কী আলাপ করতে চায়। তখন আমাকে জানানো হলো, আপনাকে সরকারের দায়িত্ব নিতে হবে।
আমি বললাম, এটা তো ভিন্ন কথা। তাকে বললাম, তোমার সঙ্গে আলাপ হয়েছে? সে জানাল, আলাপ হয়েছে। আমি বললাম, ঠিক আছে আমিও আলাপ করি, কী বলে দেখি। সে যোগাযোগ করিয়ে দিল, আমি আলাপ করলাম। তাদের বোঝানোর চেষ্টা করলাম যে আমাকে এ দায়িত্ব দিয়ো না। বরাবরই আমি এ দায়িত্ব থেকে দূরে সরে থেকেছি। এ দায়িত্ব নেওয়া ঠিক হবে না। তোমরা অন্য একজনকে ভালো করে খুঁজে দেখ। তারা বলল, না স্যার, আর কেউ নেই। আপনাকেই দায়িত্ব নিতে হবে। আমি তাদের আবার বললাম, তোমরা খোঁজ কর। খোঁজ করার পর আমাকে বল, কী দাঁড়াল। তখন সে আমাকে জানাল, ঠিক আছে স্যার, কাল আপনাকে জানাব। পরদিন আবার সে ফোন করল। সে জানাল, স্যার, উপায় নেই। আপনাকেই আসতে হবে। আপনাকে দায়িত্ব নিতে হবে। অবিলম্বে আসতে হবে। একেবারে দ্রুতগতিতে সবকিছু ঘটেছে। আমি ফিরে এলাম। সেদিন রাতেই শপথ গ্রহণ করলাম। সব ওলট-পালট। দেশে ফিরে এসে কোথায় জেলে যাব, এখন অন্যদিকে চলে গেলাম! কী করতে হবে? এরা কারা? শপথ গ্রহণে কারা কারা থাকবে? সবকিছুই নতুন! সবকিছু ভিন্ন পরিস্থিতি।
ড. মুহাম্মদ ইউনূস প্রধান উপদেষ্টা : আমি তখন জানালাম, আমি তো এখন হাসপাতালে। আমি তো অত তাড়াতাড়ি আসতে পারছি না। আমি ডাক্তারের সঙ্গে আলাপ করে দেখি, কী বলেন উনি। তবে তোমরা যখন এত প্রাণ দিয়েছ এবং বলছ, আমাকে দায়িত্ব নিতে হবে, যতই আমার আপত্তি থাকুক, আমি এ ব্যাপারে সম্মতি দিলাম। তবে আমি ডাক্তারের সঙ্গে আলাপ করে বলতে পারব, আমি কখন আসতে পারব। সে বলল, না স্যার, আপনাকে তাড়াতাড়ি আসতে হবে। আমি হাসপাতালে ডাক্তারের সঙ্গে আলাপ করলাম। ডাক্তার বললেন, আপনার তো আগামী দিনও হাসপাতালে থাকার কথা। আমরা চেষ্টা করি, আপনাকে আগামীকাল ছেড়ে দিতে পারি কি না। পরদিন সকালে ওঠার পর ডাক্তার বললেন, আপনি চাইলে চলে যেতে পারেন। ডাক্তার ছেড়ে দিলেন। আমি দেশে চলে এলাম।
"