মেহেদী হাসান
ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে পোলট্রিশিল্প
সিন্ডিকেটের কারসাজিতে একদিকে মুরগি-ডিমের দাম নিয়ে যেমন ক্রেতার নাভিশ্বাস; অন্যদিকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে চলে গেছে দেশের পোলট্রিশিল্প। কারসাজির কারণে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে প্রান্তিক পর্যায়ের শত শত খামার। প্রান্তিক খামারিদের এভাবে সরিয়ে ফায়দা লুটছে করপোরেট কোম্পানিগুলো। মুরগির খাদ্য-বাচ্চার দাম বাড়িয়ে তারা বছরে লোপাট করছে প্রায় ৬ হাজার কোটি টাকা।
২০২১ সালের শুরুর দিকে ৮ মাসে পোলট্রি খাদ্যের দাম বাড়ে ৪ দফা। সেই সঙ্গে করোনা পরিস্থিতির দোহাই দিয়ে ভ্যাকসিন ও বাচ্চার দাম তিনগুণ ছাড়িয়ে যায়। পোলট্রিশিল্পে জড়িত দেশি-বিদেশি প্রায় ৩০টি কোম্পানি তাদের উৎপাদিত খাদ্য ও বাচ্চার দামে কয়েক বছরে দফায় দফায় বাড়িয়ে লুটে নেয় কোটি কোটি টাকা। করোনা-পরবর্তী সময়ে খামারে শ্রমিকের মজুরি ব্যয় বেড়ে দাঁড়ায় দ্বিগুণ। সব মিলিয়ে গত ৫ বছরে প্রান্তিক খামারিরা তাদের উৎপাদন কমিয়ে দেওয়ার পাশাপাশি ৬০ শতাংশ খামার বন্ধ হয়ে গেছে বলে তথ্য দিয়েছে পোলট্রি সংগঠনগুলো।
প্রান্তিক খামারিদের ব্যবসা থেকে সরিয়ে করপোরেট কোম্পানিগুলো ফায়দা লুটছে বছরজুড়ে। বাংলাদেশ পোলট্রি অ্যাসোসিয়েশনের (বিপিএ) তথ্য বলছে, দেশের পোলট্রি খাতের অসাধু ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেট বাড়তি মুনাফার নামে বছরে লোপাট করছে ৫ হাজার ৯২০ কোটি টাকা লোপাট করছে। এ খাতের পোলট্রি খাদ্য, মুরগির বাচ্চা এবং মুরগি বাড়তি দামে বিক্রি করে এ অর্থ লোপাট করছে ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট।
পোলট্রি সংগঠন ও আন্তর্জাতিক বাজার বিশ্লেষণের তথ্য বলছে, আন্তর্জাতিক বাজারে ২০২২ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত দফায় দফায় পোলট্রি খাদ্য (ফিড) উপাদানের প্রধান কাঁচামাল ভুট্টা ও সয়াবিনের দাম কমলেও দেশে কমেনি খাদ্যের দাম। শিকাগো বোর্ড অব ট্রেডের (সিবিওটি) তথ্যানুযায়ী গত চলতি বছরের আগস্টের শুরুতে সয়াবিনের দাম ১.৩ শতাংশ কমে বুশেলপ্রতি (৬০ পাউন্ড) মূল্য নেমে ১০ ডলার ৩৫ সেন্ট হয়। একই সময়ে ভুট্টার দাম ০.৫ শতাংশ কমে প্রতি বুশেলের মূল্য স্থির হয় ৪ ডলার শূন্য ৮ সেন্টে। এছাড়া ২০২৩ সালের এপ্রিলে বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী বিশ্ববাজারে এক বছর আগের তুলনায় ভুট্টার দাম ১৩ শতাংশ ও গমের দাম প্রায় ৩৪ শতাংশ কমে। বিশ্ববাজারে ২০২২ সাল থেকে ভুট্টা ও সয়াবিনের দাম কমলেও দেশে সেই তুলনায় একই সময়ে দেশে কমেনি দাম। এছাড়া ২০২১ সালের জানুয়ারি মাসের তুলনায় ২০২২ সালে ভুট্টা ২২ শতাংশ ও গম ৪ শতাংশ বেশি দামে বিক্রি হয়েছে। ২০২৩-২৪ সালেও আন্তর্জাতিক বাজারে দফায় দফায় দাম ওঠানামার খবরে দেশের বাজারে দামের ওপর কোনো প্রভাব পড়েনি। বর্তমানে প্রতি বস্তা পোলট্রি খাদ্যের দাম নেওয়া হচ্ছে ৩২০০ থেকে ৩৮০০ টাকা। ২০১৯ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত ৫ বছরে প্রতি বস্তায় (৫০ কেজি) খাদ্যের দাম বেড়েছে ১৫০০ থেকে ১৮০০ টাকা, যা আগে ছিল ১৭০০ থেকে ১৭৫০ টাকা।
প্রান্তিক খামারিরা বলছেন, খাদ্যের ডিলার ও ওষুধের দোকানে বকেয়ার পরিমাণে ‘গলার কাঁটা’ হয়ে দাঁড়িয়েছে পোলট্রি ব্যবসা। এ করুণ পরিস্থিতির জন্য সিন্ডিকেটকেই দুষছেন তারা। কন্ট্রাক্ট ফার্মিয়ের ফাঁদে পা দিয়ে নিজের ধনে নিজেই চোর বনে গেছেন প্রান্তিক খামারিরা। দেশে পোলট্রি খাতে উৎপাদনে তুলনামূলক এগিয়ে রয়েছে রাজশাহী অঞ্চল। এরই মধ্যে রাজশাহীর ৪৫ শতাংশ পোলট্রি মুরগি (ব্রয়লার, লেয়ার ও সোনালি) খামার লোকসানে বন্ধ হয়ে গেছে বলে জানিয়েছে রাজশাহী পোলট্রি ফার্মার্স অ্যাসোসিয়েশন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রাজশাহী জেলার পুঠিয়া, দুর্গাপুর, তানোর ও বাগমারা উপজেলায় দেড় হাজার খামার বন্ধ হয়ে গেছে। এছাড়া রাজশাহী অঞ্চলের ৮ জেলায় (নওগাঁ, জয়পুরহাট, পাবনা, নাটোর) চরম লোকসানের মুখে ৫০ শতাংশ পোলট্রি খামারিরা ব্যবসা পরিবর্তন করেছেন। বন্ধ করেছেন খামার। এর মধ্যে গত ৫ বছরে প্রায় জেলায় ১০০০ বেশি ক্ষুদ্র ও মাঝারি খামারি ঋণের দায়ে পথে বসেছেন। পরিত্যক্ত হয়ে পড়ে আছে মুরগি পালনের শেড, নষ্ট হয়েছে লাখ টাকার কাঠামো। লোকসানে পড়া খামারিদের বাড়িবাড়ি কিস্তির জন্য ঘুরছেন এনজিও কর্মীরা; পালিয়ে বেড়াচ্ছেন খামারিরা।
এ পরিস্থিতির কারণ অনুসন্ধানে খুচরা ও পাইকারি ডিম-মাংস বিক্রেতা, পোলট্রি অ্যাসোসিয়েশনের কর্মকর্তা, খাতসংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, স্থানীয় উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে গড়ে উঠেছে পোলট্রি খাদ্যের ডিলার। তারা খামারিদের অর্ধেক টাকা বাঁকিতে খাদ্য ও এক দিন বয়সি মুরগির বাচ্চা সরবরাহ করে থাকে। খামারিরা সেই বাচ্চা কয়েক মাস পালনের পর বিক্রয় উপযোগী হলে ডিলার মুরগি বিক্রি করে দেয়। এতে যা লাভ আসে তা খামারিকে দেয় ডিলার। তবে শর্ত নির্দিষ্ট ডিলার ছাড়া খাদ্য, ভ্যাকসিন ও খামারের প্রয়োজনীয় পণ্য অন্য কোথাও কিনতে পারবেন না তারা। ফলে সরকারি পর্যায়ে বস্তাপ্রতি ৩০ টাকা বাড়লে সিন্ডিকেট বাড়ায় ৭৫ থেকে ৯০ টাকা।
অন্যদিকে বাঁকি হওয়ায় খামারি পর্যায়ে খাদ্যের প্রতি বস্তায় বাড়ে ১০০ থেকে ২০০ টাকা। শুরুতেই ভ্যাকসিনের দাম ও পরিমাণভেদে কয়েকশ’ টাকা এবং খামার তৈরির উপকরণে ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা লাভ তুলে নেয় ডিলার। এছাড়া কোম্পানির এজেন্ট অথবা অ-রেজিস্টার্ড ভেটেরিনারি চিকিৎসক অপ্রয়োজনীয় ওষুধ ব্যবহারে খামারিদের পকেট কাটে কৌশলে। ডিম ও মাংসের দামের সঙ্গে কুলিয়ে উঠতে না পারায় শত শত খামারি এভাবেই লোকসানে পড়েছেন। মহাজনের টাকা শোধ করতে না পারায় পেশা বদলেছে অনেকেই। ফসলি জমি, ঘর-ভিটা বিক্রি করে মহাজনের টাকা শোধ করেছে এমন খামারিও রয়েছেন।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, ডিলার ছাড়াও বাচ্চা উৎপাদনকারী হ্যাচারি মালিকদের বেশ বড় সিন্ডিকেট রয়েছে। প্রতিপিস সোনালি মুরগির বাচ্চার উৎপাদন খরচ পড়ে ১৪-২০ টাকা। একই বাচ্চা খামারিদের হাতে আসা পর্যন্ত দাম বেড়ে হয় ২৮ থেকে ৪৮ টাকা। খামারিরা বলছেন, পোলট্রিশিল্পে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা পালন করে এ মালিকরা। ডিলারদের সঙ্গে একটা শতাংশ চুক্তিতে খামারি ধরার মিশনে নামে তারা। কাজ করে এলাকাভেদে কিছু এজেন্ট। একবার বাচ্চা খামারে উঠিয়ে দিতে পারলেই তাদের কাজ শেষ। এবার খামারিদের সারা বছর জোঁকের মতো চুষে খায় ডিলার, ভেটেরিনারি চিকিৎসক ও পাইকারি ব্যবসায়ীরা।
এ ত্রিমুখী সিন্ডিকেটের বিষয়ে জানতে চাইলে পোলট্রি অ্যাসোসিয়েশনের এক নেতা বলেন, এখন বড় বড় কোম্পানি পোলট্রি খাতে বিনিয়োগ করেছে। তারা ইচ্ছামতো খাদ্যের দাম বাড়ায়। কারণ তারা নিজেরাই খাদ্য, বাচ্চা, মাংস ও ডিম উৎপাদন করে। আর এর বাইরে যেসব খামারি থাকেন তাদের ডিলাররা চুষে খায়। বছরের যেকোনো দুই সময় মুরগির মাংস ও ডিমের দাম বাড়ায় তারা। যাতে নতুন খামারি তৈরি হয়। আবার সারাবছর ধরে লোকসান দেয় খামারিরা। পোলট্রি সেক্টরে গরুর মতো হটাৎ বিক্রি করে দেওয়া যায় না। জমি বিক্রি করে হলেও মুরগিকে খাওয়াতে হয়। স্বয়ং সরকারও এ সিন্ডিকেট ভাঙতে ব্যর্থ। প্রতি ডিমের উৎপাদন খরচ ১০ টাকার বেশি পয়সা, বিক্রি হয় ১১ টাকা ২০ পয়সা। চোরাবালিতে আটকে গেছে খামারিরা।
ঘটনার সত্যতা যাচাইয়ে কথা হয় দেড় যুগ আগের পোলট্রি পণ্য ডিলার ‘আদর্শ পোলট্রি, ফিস ও ডেইরি ফিডের’ ব্যবস্থাপনা পরিচালক এ এইচ এম আরিফুজ্জামানের সঙ্গে। তিনি বলেন, সরকার সিন্ডিকেটের কিছুই করতে পারে না। আগে আমার আন্ডারে ৮০ থেকে ৯০ হাজার মুরগি পালন করত খামারিরা। এখন ৩০ হাজারে নেমে এসেছে। প্রতি বস্তায় খাদ্যের দাম ১৫০০ টাকা বেড়েছে। দাম বাড়ার কোনো কারণ নেই। ভুট্টা, সয়ামিল কোনোকিছুর দাম সেই তুলনায় বাড়েনি। সরকারের সঙ্গে লিঙ্ক করে কোম্পানিরা দেশটাকে চুষে খাচ্ছে। খামারিরা ধ্বংশ হয়ে গেল।
বাংলাদেশ পোলট্রি অ্যাসোসিয়েশন (বিপিএ) সভাপতি সুমন হাওলাদার বলেন, আমরা ডিম মুরগির বাজারে স্বস্তি রাখার চেষ্টা করেছি। সবসময় করপোরেট গ্রুপের সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে কথা বলেছি। প্রতিবেশী দেশ ভারতে ১ কেজি ফিডের দাম ৪০-৫০ টাকা, ১টি মুরগির বাচ্চার দাম ২৫-৩৫ টাকা। তাদের ১টি ডিমের উৎপাদনে খরচ ৫ টাকা। আর ১ কেজি ব্রয়লার মুরগির উৎপাদন খরচ ৭৬-৮৬ টাকা। কিন্তু বর্তমানে ডিম মুরগির উৎপাদন খরচ প্রতিবেশী দেশের তুলনায় আমাদের দেশে দ্বিগুণ। বাংলাদেশে ১ কেজি ফিডের দাম ৬০-৭২ টাকা, ১টি মুরগির বাচ্চার দাম ৬০-১০০ টাকা, ডিমের উৎপাদন খরচ ১০.২৯ টাকা, ১ কেজি ব্রয়লার মুরগির উৎপাদন খরচ ১৫৫-১৭০ টাকা, আর ১ কেজি সোনালি মুরগির উৎপাদন খরচ ২৪০-২৬০ টাকা। এখন বর্তমানে উৎপাদন খরচের বিপরীতে প্রতি কেজি মুরগিতে ৪০-৬০ টাকা পর্যন্ত লস গুনতে হচ্ছে। আমরা সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে সরকারকে ব্যবস্থা নেওয়ার অনুরোধ করছি।
কৃষকের সঙ্গে মজুরির সম্পর্ক গড়ার আহ্বান জানিয়ে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ উপদেষ্টা ফরিদা আখতার বলেন, কন্ট্রাক্ট ফার্মিং হলে কৃষকের স্বাধীন সত্তা থাকবে না। কন্ট্রাক্ট ফার্ম কৃষকের সঙ্গে সম্পৃক্ত নয়, কৃষি ধ্বংস করে বড় বড় কোম্পানি কাজ করে যাচ্ছে। এতে কৃষক কতটুকু উপকার পাচ্ছেন, তা আমাদের দেখতে হবে।
"