গাজীপুর ও নারায়ণগঞ্জ প্রতিনিধি
বকেয়া বেতন দাবিতে ফের সড়কে শ্রমিকরা
* গাজীপুরে ৫৫ ঘণ্টা পর ঢাকা-ময়মনসিংহ সড়কের যান চলাচল স্বাভাবিক * নারায়ণগঞ্জে অবরোধ, ভাঙচুর
গাজীপুর নগরীর মালেকের বাড়ি এলাকায় বকেয়া বেতনের দাবিতে টিএনজেড অ্যাপারেলসের শ্রমিকরা গতকাল সোমবার দুপুরে ৫২ ঘণ্টা পর মহাসড়ক অবরোধ কর্মসূচি প্রত্যাহার করেছিলেন। তবে ২ ঘণ্টা পর বিকেল ৪টায় আবারও তারা মহাসড়ক অবরোধ করেছেন। কারখানার শ্রমিকরা জানান, এর আগেও তাদের বকেয়া বেতন পরিশোধের আশ্বাস দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বেতন পাননি। তাদের অ্যাকাউন্টে যখন টাকা আসবে, ঠিক তখনই কর্মসূচি প্রত্যাহার করা হবে।
কারখানার শ্রমিক ও শিল্প পুলিশ জানায়, গাজীপুরের মোগরখাল এলাকায় টিএনজেড অ্যাপারেলসের ছয়টি কারখানা আছে। এসব কারখানায় প্রায় ৩ হাজার শ্রমিক কাজ করেন। ৩ মাস ধরে শ্রমিকরা বেতন পাচ্ছেন না। এর আগে শ্রমিকরা বেতনের দাবিতে কয়েক দফা আন্দোলন করলে সে সময় শিল্প পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা বেতন পরিশোধ করার আশ্বাস দেন। এতে শ্রমিকরা কাজে ফিরে যান। কিন্তু পরপর কয়েক দফা বেতন পরিশোধের দিন-তারিখ দিলেও কারখানা কর্তৃপক্ষ তাদের বেতন পরিশোধ করেনি। পরে গত শনিবার সকাল পৌনে ৯টায় শ্রমিকরা ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ শুরু করেন।
গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের উপপুলিশ কমিশনার (ট্রাফিক) ইব্রাহিম খান বলেন, অবরোধ তুলে নেওয়ার ঘোষণা দেওয়ার পর আজ (গতকাল) দুপুর ২টায় যানবাহন চলাচল স্বাভাবিক হয়। কিন্তু বিকেল ৪টায় আবার মহাসড়ক অবরোধ করেন শ্রমিকরা। গাজীপুরের শিল্প পুলিশের সহকারী পুলিশ সুপার মোশারফ হোসেন জানান, টানা শ্রমিক বিক্ষোভ ও ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক অবরোধের খবর পেয়ে শিল্প মন্ত্রণালয়ের শ্রমসচিব এ এইচ এম সফিকুজ্জামান, গাজীপুর সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) এরশাদ মিয়াসহ জেলা প্রশাসন ও সেনাবাহিনীর সদস্যরা ঘটনাস্থলে এসেছিলেন। আগামী রবিবার শ্রমিকদের বেতন পরিশোধ করার আশ্বাস দিলে তারা মহাসড়ক ছেড়ে চলে যান। শ্রমিকরা নিজেদের মধ্যে কথা বলে দুপুরে অবরোধ প্রত্যাহার করেন। তবে আবারও তারা সড়কে অবস্থান নিয়ে অবরোধ করেছেন। এতে যানবাহন চলাচল বন্ধ রয়েছে।
এর আগে বকেয়া বেতনের দাবিতে টানা তিন দিন টিঅ্যান্ডজেডের পাঁচ কারখানা শ্রমিকদের বিক্ষোভ চলার ৫৫ ঘণ্টা পর ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের যান চলাচল স্বাভাবিক হয়েছে। একই দাবিতে নারায়ণগঞ্জে পোশাক কারখানার শ্রমিকরা বিক্ষোভ করেছেন। এ সময় ঢাকা-মুন্সীগঞ্জ সড়কে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। গতকাল সোমবার দুপুর আড়াইটায় গাজীপুর শিল্প পুলিশের সহকারী পুলিশ সুপার মোশাররফ হোসেন এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন। তিনি বলেন, ‘শ্রমিকদের বকেয়া বেতন এখনো পরিশোধ করা হয়নি। তবে এ বিষয়ে আলোচনা চলছে। মালিকপক্ষ ও শ্রমিক প্রতিনিধির সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা চলছে। শিগগির সমস্যার সমাধান হবে বলে আমরা আশা করছি।’ গাজীপুর ট্রাফিক পুলিশ পরিদর্শক আবদুল্লাহ আল মামুন বলেন, ‘শ্রমিকদের সঙ্গে আলোচনা চলছে। শ্রমিকদের বুঝিয়ে সড়ক থেকে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। বর্তমানে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কে যান চলাচল স্বাভাবিক রয়েছে। কিছু কিছু জায়গায় কিছুটা যানজট আছে।’
গাজীপুরে বকেয়া বেতনের দাবিতে মহানগরীর বাসন এলাকায় টিঅ্যান্ডজেড গ্রুপের পাঁচটি কারখানার শ্রমিকরা মহাসড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করছেন। গত দুদিনও তারা একই দাবিতে বিক্ষোভ করেছেন। সকাল ১০টায় গাজীপুর ট্রাফিক পুলিশ পরিদর্শক আবদুল্লাহ আল মামুন বলেন, ‘আজকেও (সোমবার) ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কে প্রায় ১০ কিলোমিটার দীর্ঘ যানজট রয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘যাত্রীদের ভোগান্তি কমাতে ময়মনসিংহ থেকে আসা যাত্রীবাসগুলোকে সালনা থেকে আঞ্চলিক সড়কে বিকল্প পথ ব্যবহার করতে বলা হচ্ছে। এতে গাজীপুরের শিববাড়ী থেকে কালীগঞ্জ হয়ে হয়ে ঢাকা যেতে পাড়ছে বাসগুলো।’ ‘চন্দ্রা দিয়ে ঢাকা যাওয়ার জন্য কিছু যানবাহন চান্দনা চৌরাস্তা থেকে টাঙ্গাইল রুটে পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে’, যোগ করেন তিনি। পুলিশের এ কর্মকর্তা আরো জানান, কিশোরগঞ্জ থেকে আসা বাসগুলো কাপাসিয়া থেকে কালীগঞ্জ হয়ে টঙ্গী দিয়ে ঢাকা পাঠানো হচ্ছে।
গত রবিবার বিকেল ৩টায় গাজীপুর শিল্প পুলিশের সহকারী পুলিশ সুপার মোশাররফ হোসেন বলেছিলেন, ‘বিষয়টি নিয়ে মালিকপক্ষ ও শ্রমিকদের সঙ্গে সমঝোতার চেষ্টা করেছি। একাধিকবার তারিখ দিয়েও মালিক শ্রমিকদের বকেয়া বেতন পরিশোধ করেননি।’ শিল্প পুলিশ জানায়, গত ২৩ অক্টোবর বেতন পরিশোধের দিন নির্ধারণ করা থাকলেও মালিকপক্ষ বেতন পরিশোধ করেনি। পরে গত ২৪ অক্টোবর সেনাবাহিনী, মালিকপক্ষ ও শ্রমিক প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলোচনা হয়। তখন সেপ্টেম্বর মাসের বেতন ৩ নভেম্বর ও অক্টোবর মাসের বেতন ২০ নভেম্বর পরিশোধের সিদ্ধান্ত হয়। কিন্তু নির্ধারিত তারিখে বেতন পরিশোধ করেননি মালিকপক্ষ। এরপর গত বৃহস্পতিবার এক জরুরি নোটিসে সেপ্টেম্বরের বেতন ৭ নভেম্বর বিকাশ অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে পরিশোধ করা হবে বলে জানানো হয়।
এছাড়া অক্টোবর মাসের বেতন ২৮ নভেম্বর পরিশোধ করা হবে বলে জানানো হয়। কিন্তু ৭ নভেম্বরও বেতন পাননি শ্রমিকরা। গার্মেন্টস শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের গাজীপুর জেলার সভাপতি অ্যাডভোকেট জিয়াউল কবির খোকন বলেন, ‘টিঅ্যান্ডজেড শ্রমিকদের অবিলম্বে বকেয়া বেতন পরিশোধ করার দাবি জানাচ্ছি। আজও (সোমবার) বেতন পরিশোধ করা হচ্ছে না। শুনেছি কোম্পানির মালিক পালিয়ে গেছে। বকেয়া বেতন পরিশোধ না করলে আন্দোলনরত শ্রমিকদের সঙ্গে আমরা শিগগিরই একাত্মতা ঘোষণা করব।’ গাজীপুর ট্রাফিক পুলিশের এডিসি অশোক কুমার পাল জানান, ‘জনদুর্ভোগ চরমে। মহাসড়কে গতকালকের (রবিবার) মতো আজও (গতকাল) যানজট রয়েছে।’
ময়মনসিংহ থেকে আসা নূরুন্নবী মিয়া জানান, ‘সকালে ভোগড়া বাইপাস মোড়ে বাস থেকে নেমে ঢাকায় যাওয়ার কোনো যানবাহন না পেয়ে দুই সন্তান, স্ত্রী ও দুটি ব্যাগ নিয়ে অনেক কষ্ট করে ১ কিলোমিটারের মতো পথ হেঁটে এসেছি। এখন আর পারছি না। জানতে পারলাম আরো ১ কিলোমিটার পথ হেঁটে পার হলে কিছু একটা পাওয়া যেতে পারে।’ জেএস ট্রাভেল চালক রফিক মিয়া বলেন, ‘রাস্তায় গাড়ি চলছে না। আমি ঝুঁকি নিয়ে চলছি। ময়মনসিংহগামী এক বাসের চালক লিয়াকত আলী বলেন, ‘জয়দেবপুর থেকে ময়মনসিংহ অভিমুখে তেমন যানজট নেই।’ শিল্প পুলিশ জানায়, ‘টিঅ্যান্ডজেড অ্যাপারেলস লিমিটেড, বেসিক ক্লোথিং লিমিটেড, অ্যাপারেলস প্লাস, বেসিক নিটওয়্যার লিমিটেড ও অ্যাপারেল আর্ট লিমিটেডের প্রায় ২ হাজার শ্রমিক সড়কে বিক্ষোভ করছে। গাজীপুর শিল্প পুলিশের সহকারী পুলিশ সুপার মোশাররফ হোসেন বলেন, ‘বিক্ষোভ এখনো চলছে।’
নারায়ণগঞ্জে শ্রমিক বিক্ষোভ, ঢাকা-মুন্সীগঞ্জ সড়ক অবরোধ : বকেয়া বেতনের দাবিতে নারায়ণগঞ্জের বিসিক শিল্পাঞ্চলে ‘ক্রোনী গ্রুপের’ দুটি পোশাক কারখানার শ্রমিকরা বিক্ষোভ করেছেন। গতকাল সোমবার সকাল সাড়ে ১০টায় কয়েকশ শ্রমিক সড়কে নেমে বিক্ষোভ করেন। তারা ঢাকা-মুন্সীগঞ্জ আঞ্চলিক সড়কটি অবরোধ করেন। বিক্ষোভ শুরুর পর শ্রমিকদের একটি দল বিসিক শিল্পাঞ্চলের ভেতরে কয়েকটি কারখানায় ভাঙচুর চালালে অধিকাংশ কারখানার বন্ধ ঘোষণা করে শ্রমিকদের ছুটি দেয় কারখানা কর্তৃপক্ষ। বিসিক শিল্পনগরী কর্মকর্তা মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘নারায়ণগঞ্জ বিসিক শিল্পাঞ্চলে ৪৩২টি কারখানা রয়েছে। শ্রমিক অসন্তোষের মুখে অধিকাংশ কারখানায় লাঞ্চের আগেই শ্রমিকদের ছুটি দিয়ে দেওয়া হয়। বেলা সাড়ে ১১টায় কথা হয় ‘আর-ফোর’ নামে একটি পোশাক কারখানার শ্রমিক মাহনূর ইসলামের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘আমাদের লাঞ্চ হয় সাড়ে ১২টায়। কয়েকটি কারখানায় ভাঙচুর করায় ভয়ে কারখানা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।’
এদিকে বিশৃঙ্খলা এড়াতে পুলিশ ও বিজিবি সদস্যরা বিসিক শিল্পাঞ্চলে অবস্থান করছেন। ক্রোনী গ্রুপের অবন্তী কালার টেক্স পোশাক কারখানার সুইং সেকশনের শ্রমিক ফাতেমা আক্তার বলেন, ‘গত বছর থেকে কারখানার মালিক বেতন নিয়ে গড়িমসি করে আসছে। গত অগাস্ট মাস থেকে আমার বেতন বকেয়া। বেতন না দিয়েই গতমাসে কারখানা লে-অফ ঘোষণা করে। ‘অনেকের কাছে আমরা গেছি, কোনো সমাধান পাইনি। তাই সড়কে নামছি আমরা। গত বছরের ডিসেম্বর থেকে ক্রোনী গ্রুপের কারখানা দুটিতে বেতন পরিশোধ নিয়ে অসন্তোষ চলছে। গত এপ্রিলে বকেয়া বেতনের দাবিতে গ্রুপের অবন্তী কালার টেক্স শ্রমিকরা বিক্ষোভ করেন। এ সময় শ্রমিক পুলিশ সংঘর্ষে অন্তত ৬০ জন আহত হন।
"