নিজস্ব প্রতিবেদক
শিশুর জন্মসনদ পেতে গলদঘর্ম অভিভাবক
দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় শুরু হচ্ছে ভর্তি মৌসুম। রাজধানীর অনেক স্কুলে অক্টোবরের মাঝামাঝি থেকেই নতুন শিক্ষাবর্ষে ভর্তির কার্যক্রম শুরু হয়ে যায় এবং নভেম্বর-ডিসেম্বরের মধ্যে নতুন ভর্তির প্রক্রিয়া শেষ হয়। তবে এ ভর্তিতে চরম বিড়ম্বনার নাম জন্মসনদ।
ঢাকার দক্ষিণ বনশ্রীর বাসিন্দা হৃদয় আহমেদ ও তনিমা নাসরিন (ছদ্মনাম) দম্পত্তি তাদের শিশুসন্তানকে স্কুলে ভর্তি করানোর প্রস্তুতি নিচ্ছেন। তারা জানেন ভর্তি করতে গেলেই সন্তানের জন্মনিবন্ধন সনদ লাগবে। সম্প্রতি খিলগাঁওয়ে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) আঞ্চলিক কার্যালয়ে যান তারা। সেখান থেকে বলা হয়, সন্তানের জন্মনিবন্ধন করাতে হলে মা-বাবার জন্মসনদ লাগবে। কিন্তু এ দম্পত্তির তা নেই। জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) ও পাসপোর্ট আছে। কিন্তু এগুলো দিয়ে হচ্ছে না। আবার নিজেদের জন্মনিবন্ধন করতে গিয়েও নানা কাগজপত্রের ভোগান্তিতে পড়েন এ দম্পতি।
রাজধানীর মিরপুর-১০ নম্বর এলাকার গৃহিণী মহুয়া সুলতানার ছোট দুই সন্তান যমজ। আসছে বছরের শুরুতেই সন্তানদের বিদ্যালয়ে ভর্তি করানোর ইচ্ছা তার। তাই সন্তানদের জন্মসনদের জন্য সেপ্টেম্বর থেকেই দৌড়ঝাঁপ করছেন ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) আওতাধীন মিরপুর-১৪ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর কার্যালয়ে। তবে প্রায় এক মাস হলেও হাতে পাননি জন্মসনদ।
মহুয়া বলেন, আগে জন্মনিবন্ধন করার সময় মা-বাবার জাতীয় পরিচয়পত্র দিয়েই করা গিয়েছিল। এখন মা-বাবার জন্মসনদ লাগছে। তার নিজের ও স্বামীর জন্মসনদ নেই। তাই আগে তাদের স্বামী-স্ত্রীর জন্মসনদ করাতে হবে। এরপর সন্তানদের।
মহুয়া জানান, তিনি ও তার স্বামী সপ্তাহ তিনেক আগে জন্মনিবন্ধনের জন্য আবেদন করেছেন। এখনো সনদ হাতে পাননি। তাই সময়মতো সন্তানদের জন্মসনদ পাওয়া নিয়েও দুশ্চিন্তায় ভুগছেন তিনি।
শুধু হৃদয়-নাসরিন দম্পতি কিংবা গৃহিণী মহুয়া সুলতানাই নন, সারা দেশের অসংখ্য মানুষ নিজের বা সন্তানের জন্মনিবন্ধনের ক্ষেত্রে ভোগান্তির মুখোমুখী হচ্ছেন। কাগজপত্র ও দৌড়ঝাঁপের ভোগান্তির সঙ্গে গুনতে হচ্ছে বাড়তি পয়সা। সুযোগ বুঝে জন্মসনদ সংশোধনের ফির অতিরিক্ত টাকা আদায় করছেন সংশ্লিষ্ট কার্যালয়ের কর্মচারীরা।
জাতীয় শিক্ষানীতি-২০১০ অনুযায়ী, বিদ্যালয়ে ভর্তির সময় শিশুর বয়স শনাক্ত করতে আবেদন ফরমের সঙ্গে জমা দিতে হয় জন্মসনদের ফটোকপি। অন্যদিকে ২০২১ সালের ১ জানুয়ারি থেকে করা সরকারি নিয়মানুযায়ী, ২০০১ সালের পর জন্ম নেওয়া ব্যক্তিদের জন্মনিবন্ধন করাতে হলে মা-বাবার জন্মসনদ থাকা আবশ্যিক। এ কারণে বিদ্যালয়ে ভর্তি ঘিরে প্রতি বছরই সেপ্টেম্বর বা তার আগে থেকেই শিশুর জন্মসনদ সংগ্রহে অভিভাবকদের তোড়জোড় শুরু হয়ে যায়।
তবে এবার পরিস্থিতি কিছুটা ভিন্ন। শিক্ষার্থীদের সরকারবিরোধী আন্দোলনের জেরে জুলাইয়ে দেশজুড়ে জন্মনিবন্ধনের প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হয়েছে। আন্দোলনের সময় ১৮ থেকে ২৩ জুলাই টানা ৫ দিন মোবাইল ও ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট-সংযোগ বন্ধ ছিল। মোবাইল ইন্টারনেট বন্ধ ছিল প্রায় ১০ দিন। গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর বিভিন্ন ওয়ার্ড কাউন্সিলর, ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) চেয়ারম্যানরা আত্মগোপনে চলে যান। কার্যালয়গুলোয় ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ ও হামলা করা হয়। সিটি করপোরেশনের কাউন্সিলরদের অপসারণ করা হয়। এসব কারণে আগস্ট ও সেপ্টেম্বরের বড় অংশজুড়ে অনেক জায়গায় জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধনের কাজ বন্ধ থাকে। সেপ্টেম্বরের শেষ দিকে এসে জন্মনিবন্ধনের আবেদন বাড়তে থাকে।
‘রেজিস্ট্রার জেনারেলের কার্যালয়, জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধন’র তথ্যানুযায়ী, এ বছরের ৬ আগস্ট পর্যন্ত সারা দেশে জন্মনিবন্ধনের আবেদনের সংখ্যা ছিল মাত্র ৩ হাজার ৩৯৮। গত ৩০ সেপ্টেম্বর তা লাফিয়ে বেড়ে দাঁড়ায় ৪৪ হাজার ২৬১টিতে। সর্বশেষ ১০ নভেম্বর জন্মনিবন্ধনের আবেদনের সংখ্যা ছিল ৩৮ হাজার ৫৫। জন্মনিবন্ধন হয়েছে ৩৩ হাজার ৯১৮টি।
এদিকে শিশুদের বিদ্যালয়ে ভর্তির সময় যত এগিয়ে আসছে, ততই ভিড় বাড়ছে নিবন্ধক কার্যালয়গুলোয়। ডিএনসিসির পুরোনো ওয়ার্ড ১ থেকে ৩৬ নম্বর পর্যন্ত ওয়ার্ড কাউন্সিলরের কার্যালয় ও নতুন ওয়ার্ড ৩৭ থেকে ৫৪ পর্যন্ত ডিএনসিসির ১০টি আঞ্চলিক কার্যালয় এবং ডিএসসিসির ১০টি আঞ্চলিক কার্যালয়কে জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধনের নিবন্ধক কার্যালয় হিসেবে ব্যবহার করা হয়। ডিএসসিসির অঞ্চল-২-এর আঞ্চলিক নির্বাহী কর্মকর্তা রেজাউল করিম বলেন, প্রতি বছর বিদ্যালয়ে ভর্তির মৌসুমের শুরু থেকেই অর্থাৎ সেপ্টেম্বর-অক্টোবরে জন্মসনদ সংগ্রহের চাহিদা বেড়ে যায়। ফলে এ সময়ে কাজের চাপও বাড়ে। প্রয়োজনে অতিরিক্ত জনবল দিয়ে হলেও বাড়তি চাপ সামলাতে হয়।
প্রক্রিয়া নিয়ে ক্ষোভ : পেশায় স্থপতি শাহিদ হাসানের সঙ্গে কথা হয় রাজধানীর কাফরুলে অবস্থিত ১৬ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলরের কার্যালয়ে। নিজের ভুলে ভরা বাংলা জন্মসনদ ঠিক করাতে এসেছিলেন। ক্ষোভের সঙ্গেই বললেন, ‘সন্তানের জন্মনিবন্ধন করানোর জন্য আগে নিজের জন্মসনদ সংশোধন করতে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে যেতে বলা হয়েছে। আমাকে নিজে গিয়ে শুনানি করতে হবে কেন? জাতীয় পরিচয়পত্রেই তো সব তথ্য দেওয়া আছে।’ তার মতে, ওয়ার্ড কাউন্সিলরের কার্যালয়ে প্রয়োজনীয় কাগজ জমা দিলেই এ কাজ হওয়া উচিত।
বাড়তি ব্যয়ের অভিযোগ : ডিএনসিসির ১৯ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর কার্যালয় রাজধানীর বনানীর ১২ নম্বর সড়কে। কার্যালয়ের বাইরে ৫ বছরের ছেলেকে নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন এক নারী। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনি বলেন, সন্তানের জন্মনিবন্ধন করতে এসে জানতে পারেন আগে সন্তানের বাবার নামের ভুল সংশোধন করতে হবে। জন্মসনদ সংশোধনের ফি ১০০ টাকা। কিন্তু তার কাছ থেকে ৫০০ টাকা নিয়েছেন ওই কার্যালয়ের এক কর্মী।
ওই কার্যালয়ের এক কর্মীকে ‘জন্মনিবন্ধন করতে চাই’ বলতেই একটি সরু কাগজ ধরিয়ে দিলেন। কাগজে বনানী সুপার মার্কেটের একটি স্টেশনারি দোকানের ঠিকানা লেখা। ঠিকানায় গিয়ে রজনু রহমান নামের এক ব্যক্তির সঙ্গে দেখা হলো। তিনি বললেন, আবেদনকারীদের হয়ে তারা কাজ করে দেন। প্রয়োজনে সংশোধনের জন্য সদরঘাটে ঢাকা জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে গিয়েও কাজ করেন। জন্মসনদ তুলে দেওয়া পর্যন্ত তিন থেকে সাড়ে ৩ হাজার টাকা নেন।
রেজিস্ট্রার জেনারেলের কার্যালয়ের এক নির্দেশিকায় শিশুর জন্মের ৪৫ দিনের মধ্যে জন্মনিবন্ধনের ব্যাপারে তাগিদ দেওয়া হয়েছে। এ সময়ের মধ্যে বিনামূল্যে নিবন্ধন করা যাবে। ৪৬ দিন থেকে ৫ বছর বয়স পর্যন্ত এ খরচ ২৫ টাকা। আর বয়স ৫ বছরের বেশি হলে খরচ ৫০ টাকা। সামগ্রিক বিষয় নিয়ে মিরপুরের কাফরুলের ডিএনসিসির ১৬ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর কার্যালয়ের সচিব শাহ আলম কবির বলেন, সব তথ্য ঠিকঠাক থাকলে জন্মনিবন্ধন আসলে খুবই সহজ বিষয়। সময় ও শ্রম বেশি লাগে না। তবে সনদের তথ্য সংশোধন করতে গেলে কিছুটা সময় লাগে।
"