গাজী শাহনেওয়াজ
বাড়তি দায়িত্ব ও উপরি আয় কমায় নাখোশ খাদ্য পরিদর্শকরা
খাদ্য ব্যবস্থাপনায় স্বচ্ছতা, জবাবদিহি ও গতি ফিরিয়ে আনার জন্য উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক (উখানি) পদে দায়িত্ব দিয়ে প্রধান সহকারী বা হিসাবরক্ষক বা সুপারিনটেনডেন্টদের ৬৯ জনকে পদায়ন করেছে খাদ্য অধিদপ্তর। জানা গেছে, এই পদায়নসহ এখন পর্যন্ত খাদ্য প্রধান সহকারী সমমানের পদধারীদের ১৪৮টি পদের মধ্যে ১০০ জনকে উখানি পদে দায়িত্ব দেওয়া হলো। এই পদায়নকে ভালোভাবে নেয়নি খাদ্য পরিদর্শক ও সমমানের কর্মকর্তারা। বাড়তি দায়িত্ব মানেই উপরি আয়। এ আয় কর্তৃপক্ষের ওপরে নাখোশ খাদ্য পরিদর্শকরা।
তথ্য বলছে, সপ্তাহে কর্মদিবস পাঁচ দিন হলেও অতিরিক্ত দায়িত্ব পাওয়া অফিসগুলোয় নিয়মিত বসার সুযোগ হয় না খাদ্য পরিদর্শকদের। কারণ একজনের একাধিক অফিসের দায়িত্ব থাকায় ওই নাজুক অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে। ফলে দাপ্তরিক কার্যক্রম চরমভাবে ব্যাহত হয়ে আসছে। অফিস কার্যক্রম গোল্লায় গেলেও তাতে ভ্রুক্ষেপ নেই সংশ্লিষ্টদের। কিন্তু অবৈধ সুবিধার মাধ্যমে পকেট ভারী করার সুবিধার্থে কেউই পদ ছাড়তে নারাজ। তাই চলতি উখানি পদে চলতি দায়িত্ব পাওয়া ব্যক্তিদের বিতর্কিত করতে আন্দোলন ও বিরোধিতায় নেমেছে খাদ্য পরিদর্শকরা। অথচ খাদ্য অধিদপ্তরের প্রস্তাবনার আলোকে খাদ্য মন্ত্রণালয় নিয়মতান্ত্রিক পন্থায় উখানি পদে চলতি দায়িত্ব দিয়ে খাদ্য সহকারী ও সমমানের ব্যক্তিদের পদায়ন করেছে, যা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ নিশ্চিত করেছে। খাদ্য পরিদর্শকদের দায়িত্ব কমিয়ে কেন অন্যদের উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক পদে চলতি দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে এতেই ক্ষুব্ধ তারা।
প্রাপ্ত তথ্য বলছে, বিগত সরকারের আস্থাভাজন সুবিধাবাদী চক্ররা নেপথ্যে থেকে কড়া নাড়ছে। অন্তর্বর্তী সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে কোমর বেঁধে নেমেছে। এত দিন মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরকে ম্যানেজ করে এভাবেই বছরের পর বছর অতিরিক্ত দায়িত্বের নামে আঙুল ফুলে কলাগাছ বনে গেছেন। এখন অতিরিক্ত দায়িত্ব হাতছাড়া ও উপরি উপার্জন কমে যাওয়ায় তারা ষড়যন্ত্রে নেমেছে বলে তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে। চলতি দায়িত্ব পাওয়াদের কাজে বিঘ্ন সৃষ্টি করতে আদালতে গিয়ে স্থগিতাদেশ নিয়ে আসেন। পরে কর্তৃপক্ষ ওই আদেশের বিরুদ্ধে আপিল করলে বিচারক সেটি খারিজ করে দেন। ফলে উখানি পদে চলতি দায়িত্ব পাওয়াদের দায়িত্ব পালনে বাধা কাটে। বর্তমানে মামলাটি চলমান রয়েছে।
এভাবেই তারা আর্থিকভাবে লাভবান হতেন উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রকরা; যাদের মূল পদ খাদ্য পরিদর্শক বা সমমান। মূলত পদোন্নতি পেয়ে ওই পদে যেতেন। আবার পদোন্নতির জন্য শর্ত ও যোগ্যতা পূরণ না হওয়ার কারণে এত দিন চলতি দায়িত্ব দিয়ে তাদের উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক পদে চলতি বা অতিরিক্ত দায়িত্ব দিয়ে একাধিক অফিসের কাজটি সম্পন্ন করে নিতেন কর্তৃপক্ষ।
খাদ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলছেন, শূন্য পদের বিপরীতে জনবল কম থাকায় একজন কর্মকর্তাকে একাধিক অফিসের অতিরিক্ত দায়িত্ব দিয়ে খাদ্যবান্ধব কর্মসূচিসহ নানা কার্যক্রম চালিয়ে নেওয়া হচ্ছে। এক প্রকার জোড়াতালি দিয়ে বলতে পারেন এত দিন মাঠ পর্যায়ের খাদ্য অফিসগুলোর কার্যক্রম চালিয়ে নেওয়া হয়েছে।
জানা গেছে, পদোন্নতির জন্য শর্ত ও যোগ্যতাপূরণ না হলেও প্রধান সহকারী বা সমমান পদধারীদের উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক পদে চলতি দায়িত্ব দিয়ে পদায়ন করা হয়। উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রকের পদ রয়েছে ৬৫০টি। সংশ্লিষ্ট পদে পদোন্নতি পেতে হলে খাদ্য পরিদর্শক বা কারিগরি খাদ্য পরিদর্শক বা অপারেটর (পেস্ট কন্ট্রোল) পদে কর্মরতদের ন্যূনতম পাঁচ বছর চাকরি করা বাধ্যতামূলক। এই শর্তপূরণ হলে পদ শূন্য হওয়া সাপেক্ষে উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক পদে খাদ্য পরিদর্শকরা পদোন্নতি পান। এর জন্য তাদের কোটা নির্ধারিত আছে ৬৭ শতাংশ অর্থাৎ মূল পদসংখ্যা ৬৫০টির মধ্যে ৪৩৫টি। এরই মধ্যে খাদ্য পরিদর্শক পদে পদোন্নতি পেয়ে ৪০৭ কর্মকর্তা উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। এর বাইরে অবশিষ্ট শূন্য পদে পদোন্নতিপ্রাপ্ত যোগ্য কর্মকর্তাদের মধ্যে থেকে ২৮টি শূন্য পদের বিপরীতে উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক হিসেবে চলতি দায়িত্ব দিয়ে একজনকে একাধিক অফিসে পদায়ন করা হয়েছে।
অন্যদিকে, সম্প্রতি উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক পদে চলতি দায়িত্ব পাওয়া সবাই প্রধান সহকারী বা হিসাবরক্ষক বা সুপারিনটেনডেন্ট বা প্রধান সহকারী-কাম-হিসাবরক্ষক বা সাঁটলিপিকার-কাম-কম্পিউটার অপারেটর এবং সুপারভাইজার। ওই পদে পদোন্নতির জন্য তাদের ন্যূনতম চাকরির বয়স লাগে ১১ বছর। তাদের জন্য কোটা নির্ধারণ রয়েছে ২৩ শতাংশ। যার মধ্যে ১৮ শতাংশ পদ প্রধান সহকারী বা হিসাবরক্ষক বা সুপারিনটেনডেন্ট বা প্রধান সহকারী-কাম-হিসাবরক্ষক বা সাঁটলিপিকার-কাম-কম্পিউটার অপারেটর এবং ৫ শতাংশ পদ সুপারভাইজার। কিন্তু উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক পদে চলতি দায়িত্ব পালনের জন্য চাকরির যোগদান থেকে ৫ থেকে ৬ বছর হলে এবং কর্তৃপক্ষ উপযুক্ত মনে করলে উচ্চ পদে নিম্নপদের কর্মকর্তাদের দায়িত্ব দিতে পারেন। এতে আইনের ব্যত্যয় হওয়ার সুযোগ নেই বলে জানান সংশ্লিষ্টরা।
অথচ খাদ্য পরিদর্শক বা সমমানের পদধারীরা কর্মকর্তার একজন এক বা একাধিক অফিসের দায়িত্বে রয়েছেন। একজনের পক্ষে অনেকগুলো অফিস সামলানো কঠিন এবং চ্যালেঞ্জের বলে নানা সময়ে অভিযোগ আসে প্রধান কার্যালয়ে। ফলে প্রায়শ অফিসের সার্বিক কার্যক্রম সুচারুভাবে সম্পন্ন করা সম্ভব হয় না। অনেক ক্ষেত্রে তাদের হিমশিম অবস্থার কারণে খাদ্য ব্যবস্থাপনায় নানা অস্বচ্ছতা ফুটে ওঠে। যার পরিপ্রেক্ষিতে প্রধান সহকারীদের উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক পদে চলতি দায়িত্ব দিয়ে পদায়ন করা হয়েছে। এখন পর্যন্ত ওই পদে ১০০ কর্মকর্তা চলতি দায়িত্ব পেয়েছেন। এখনো কোটানুযায়ী ৪৮টি পদ তাদের প্রাপ্য। বরাদ্দ কোটার ৯০ শতাংশের বাইরে খাদ্য অধিদপ্তরের ১০ শতাংশ অর্থাৎ ৬৫টি পদ সংরক্ষিত থাকে। এই সংরক্ষিত পদে যোগ্য কর্মকর্তাদের মধ্য থেকে কর্তৃপক্ষ চাইলে যে কাউকে সেখানে পদায়ন করতে পারেন।
এদিকে, ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে হাসিনা সরকারের পতনের পর সংস্কারের ধারাবাহিক কার্যক্রমের অংশ হিসেবে খাদ্য মন্ত্রণালয়েও শুদ্ধি অভিযান শুরু হয়। নতুন খাদ্য সচিব মাসুদুল হাসান দায়িত্ব নেওয়ার পর এই শুদ্ধি অভিযানে গতি বেড়েছে বলে জানা গেছে। যদিও সাবেক খাদ্য সচিব ইসমাইল হোসেন খাদ্য ব্যবস্থাপনায় সুষমা ও স্বচ্ছতা আনায়নে সহকারী প্রধান ও সমমান পদের কর্মকর্তাদের চলতি দায়িত্ব দিয়ে উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক পদে পদায়ন করে যান। এর আগে খাদ্য অধিদপ্তর থেকে এ সংক্রান্ত প্রস্তাবনা পাঠিয়েছিল খাদ্য মন্ত্রণালয়। বর্তমান সচিব আগের পদায়ন খতিয়ে দেখে কোনো ধরনের নিয়মের ব্যত্যয় পায়নি বলেও জানা যায়। এমনকি যাদের বিভিন্ন অফিসে উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক হিসেবে চলতি দায়িত্ব দিয়েছিল তাদের কর্মদক্ষতায় অফিসের কাজে গতি ফেরায় আগেই সিদ্ধান্তটি যৌক্তিক বিবেচনায় তা বহাল রাখেন। কারণ প্রধান সহকারীদের পদোন্নতির জন্য ১১ বছর পূর্ণ না হলেও উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক পদে পদায়নে কোনো সংকট বা জটিলতা তৈরি হয়নি।
অথচ নিম্নপদ থেকে কিছু কর্মকর্তাকে উচ্চ পদে চলতি দায়িত্ব দেওয়ায় ক্ষেপেছেন সুবিধাভোগী একাধিক অফিসের অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করা খাদ্য পরিদর্শক সমমান পদের কর্মকর্তারা। তাদের যোগ্যতা ও কর্মদক্ষতা নিয়েও প্রশ্ন তোলা হচ্ছে বলেও অভিযোগে জানিয়েছে প্রধান সহকারী সমমান পদে কর্মরতরা। অথচ বিএসএস ফুড ক্যাডারে চাকরি পেয়ে সহকারী খাদ্য নিয়ন্ত্রক পদে যোগদান করেন। কিন্তু অতীত অভিজ্ঞতা না থাকা সত্ত্বেও তাদের চলতি দায়িত্ব দিয়ে জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক (আরসি) করা হয়। এসব কর্মকর্তারা তাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব সুচারু ও খাদ্য ব্যবস্থাপনায় শৃঙ্খলা আনয়নে কার্যকরী ও মুখ্য ভূমিকা পালন করার মাধ্যমে সরকারের ভাবমূর্তিকে উজ্জ্বল করে আসছেন বলেও খাদ্য ব্যবস্থাপনার সঙ্গে জড়িত দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা জানান।
এদিকে, প্রাপ্ত কোটার আলোকে প্রধান সহকারী বা হিসাবরক্ষক বা সুপারিনটেনডেন্টদের উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক পদে চলতি দায়িত্ব দেওয়া ইস্যুতে চরম অরাজক অবস্থা তৈরি করছে খাদ্য পরিদর্শক সমমান পর্যায়ের কর্মকর্তারা। এর নেপথ্যের মূল কারণ ব্যক্তিগত সুবিধা কমে যাওয়া, মূল দায়িত্বের বাইরে একাধিক অফিসের অতিরিক্ত দায়িত্বে কাটছাঁট হওয়া এবং এর মাধ্যমে অবৈধভাবে যে আর্থিক সুবিধা পেতেন ওই ভাগবাঁটোয়ারায় কমতি দেখা দিয়েছে অন্য পদের কর্মকর্তাদের চলতি দায়িত্ব প্রদান করায়। এখন খাদ্য কার্যক্রমে ব্যাহত ঘটনানো পায়তায় নেমেছে খাদ্য পরিদর্শকরা। নিম্নপদের কর্মকর্তাদের উচ্চ পদের দায়িত্ব দেওয়াকে কেন্দ্র করে নানা বিভ্রান্তিমূলক অপপ্রচার চালিয়ে আর্থিক ফায়দা হাসিলের চেষ্টা চালাচ্ছেন নিজেদের বঞ্চিত দাবি করা খাদ্য পরিদর্শকরা বা উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রকরা। এ বিষয়ে কয়েকজন মূল পদের অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করা খাদ্য পরিদর্শক কর্মকর্তার কাছে জানতে চাইলে গণমাধ্যমের কাছে পরিচয় প্রকাশ করে মন্তব্য করতে রাজি হননি। অথচ তাদের বঞ্চিত করা হচ্ছে বলেও জানান। কিন্তু এ প্রতিবেদনের অনুসন্ধানে এ ধরনের কোনো অনিয়মের তথ্য পাওয়া যায়নি।
খাদ্য অধিপ্তরের পরিচালক আবদুল সালাম প্রতিদিনের সংবাদকে বলেন, অফিসের কাজের সুবিধার্থে কর্তৃপক্ষ যাকে যোগ্য মনে করবেন তাদের পদায়ন বা চলতি দায়িত্ব দিতে পারেন। এতে নিয়মের ব্যত্যয় হওয়ার সুযোগ নেই। কোটানুযায়ী কে কী প্রাপ্য সেটি আইন ও বিধি দ্বারা নির্ধারিত আছে। এরপরও প্রশাসন এ বিষয়টি আরো ভালো করে বলতে পারবেন বলে জানান ওই পরিচালক।
"