বিশেষ প্রতিবেদক
বিদ্যুৎ সরবরাহ ৬০ ভাগই কমাল আদানি পাওয়ার
আদানি পাওয়ার গুরুত্বপূর্ণ হলেও এটি একমাত্র উৎস নয় : বিশ্লেষক
বাংলাদেশে বিদ্যুৎ সরবরাহ আরো কমিয়ে দিয়েছে ভারতের আদানি গ্রুপ। নতুন করে ১০ শতাংশ কমানো হয়েছে বলে জানা গেছে। ফলে মোট ৬০ শতাংশ বিদ্যুৎ আসা বন্ধ হয়ে গেল ভারত থেকে। কিছুদিন ধরে শোনা যাচ্ছিল, বাংলাদেশের কাছ থেকে পাওনা অর্থ (৮০০ মিলিয়ন ডলারের বেশি) আদায়ের চেষ্টা করছে আদানি গ্রুপ। এর মধ্যেই জানা গেল এই খবর।
বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে গত শুক্রবার বিদ্যুৎ সরবরাহ কমিয়ে দেওয়ার তথ্য জানায় বিষয়টির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট দুটি সূত্র। এ ছাড়া বাংলাদেশের বিদ্যুৎ সঞ্চালনের ডেটা থেকেও এই তথ্য নিশ্চিত হওয়া গেছে। গত মাসের শেষ দিকে বাংলাদেশে বিদ্যুৎ সরবরাহ ৫০ শতাংশ কমিয়ে দেয় আদানি। এখন নতুন করে আরো ১০ শতাংশ কমিয়েছে তারা।
শুধু বাংলাদেশে বিদ্যুৎ পাঠাতেই ঝাড়খণ্ডের গোড্ডায় ১ হাজার ৬০০ মেগাওয়াটের বিদ্যুৎকেন্দ্র তৈরি করে আদানি গ্রুপ। গত আগস্টেও এই কেন্দ্র থেকে বাংলাদেশে ১ হাজার ৪০০ থেকে ১ হাজার ৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ পাঠিয়েছে গ্রুপটি। কিন্তু বকেয়া জমে যাওয়ায় অক্টোবরের শেষ দিকে সরবরাহ ৭০০ থেকে ৭৫০ মেগাওয়াটে নামিয়ে আনে তারা। আর গত বৃহস্পতিবার বাংলাদেশে মাত্র ৫২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আসে আদানির বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে।
বাংলাদেশের বিদ্যুৎ ও জ্বালানি উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফওজুল কবির খান বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে বলেছেন, ‘আমরা ধীরে ধীরে বকেয়া পরিশোধ করছি। কেউ যদি বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ করে দেয় তাহলে আমরা বিকল্প ব্যবস্থা গ্রহণ করব। আমরা কোনো বিদ্যুৎ সরবরাহকারীকে আমাদের জিম্মি করতে দেব না।’
বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (বিপিডিবি) এক কর্মকর্তা রয়টার্সকে জানিয়েছেন, আদানির বকেয়া পরিশোধের সময়সীমা তুলে দেওয়া এবং বাংলাদেশের বকেয়া পরিশোধের চেষ্টা ত্বরান্বিত করার পরও আদানির কাছ থেকে কম বিদ্যুৎ আসছে। বিদ্যুৎ সরবরাহ কমিয়ে দেওয়ার ব্যাপারে জানতে আদানির সঙ্গে যোগাযোগ করেছিল রয়টার্স। তবে গ্রুপের পক্ষ থেকে সরাসরি কোনো জবাব দেওয়া হয়নি। কিন্তু আদানির একটি সূত্র জানিয়েছে, বাংলাদেশের চাহিদা এবং একই সঙ্গে বকেয়ার বিষয়টি মাথায় রেখে সরবরাহ কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। ২০২২ সালে রাশিয়া-ইউক্রেনের মধ্যে যুদ্ধ বাধার পর কয়লার দাম বেড়ে গেলে জ্বালানির মূল্য পরিশোধে হিমশিম খাওয়া শুরু করে বাংলাদেশ। এরপর গণআন্দোলনের মুখে শেখ হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার পর বকেয়ার পরিমাণ আরো বেড়ে যায়। মিডিয়াতে কথা বলায় নিষেধাজ্ঞা থাকায় বাংলাদেশের বিদ্যুৎ কর্মকর্তা এবং আদানি গ্রুপের সূত্রটি নাম প্রকাশ না করার শর্তে রয়টার্সের সঙ্গে কথা বলেন।
এখন প্রশ্ন উঠছে, যদি আদানি পাওয়ারের কাছ থেকে বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায়, তবে বাংলাদেশে কী ধরনের প্রভাব পড়বে?
তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, আদানি পাওয়ার থেকে আসা বিদ্যুৎ বাংলাদেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ হলেও, এটি একমাত্র উৎস নয়। আদানি পাওয়ার বাংলাদেশের জন্য ১,৪৯৬ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সরবরাহ করছিল, তবে গত সপ্তাহে তাদের একটি ইউনিট বন্ধ হয়ে যাওয়ার কারণে সরবরাহ কমে ৭০০ মেগাওয়াটে নেমে এসেছে। তবে, বাংলাদেশ এখনো অন্যান্য উৎস থেকেও বিদ্যুৎ পেয়ে থাকে। যেমন- ভেড়ামারা এবং ত্রিপুরা থেকে আমদানি করা বিদ্যুৎ এই ঘাটতি কিছুটা পূরণ করে। বর্তমানে বাংলাদেশের নিজস্ব উৎপাদন ক্ষমতা ১০,২৫১ মেগাওয়াট, যদিও কয়লা, গ্যাস এবং তেলের সংকটের কারণে বেশ কিছু বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ বা আংশিক বন্ধ রয়েছে।
এটা স্পষ্ট যে, যদি আদানি পাওয়ারের বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায়, বাংলাদেশে কিছুটা চাপ সৃষ্টি হবে, কারণ আদানি থেকে এখনো ৭০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আসে। তবে, দেশের বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যবস্থার অন্য উৎসগুলো (যেমন- গ্যাস, তরল জ্বালানি, এবং সৌরবিদ্যুৎ) এই ঘাটতি কিছুটা পূরণ করতে সক্ষম। বর্তমানে, শীতকাল শুরু হওয়ার কারণে বিদ্যুতের চাহিদা কিছুটা কমেছে, ফলে পরিস্থিতি এখনো নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রয়েছে।
আসলে এখন উৎপাদনে তেমন ঘাটতি নেই। তবে যে লোডশেডিং হচ্ছে তা সিস্টেমের কারণে। সামনে শীতকাল আসছে। তখন বিদ্যুতের চাহিদা কমে যাবে। বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) সূত্রে জানা গেছে, দেশের বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো জ্বালানি সংকটে আছে। তার মধ্যে ১,১৫০ মেগাওয়াট সক্ষমতার মাতারবাড়ি কয়লাভিত্তিক কেন্দ্রটি কয়লা সংকটের কারণে পুরোপুরি বন্ধ রয়েছে। কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র রামপাল ও এস আলম গ্রুপের এসএস পাওয়ারের একটি করে ইউনিট কয়লার অভাবে বন্ধ রয়েছে। রামপালে ১,২৩৪ মেগাওয়াট সক্ষমতার কেন্দ্রটির সরবরাহ অর্ধেকে নেমেছে। ১,২২৪ মেগাওয়াট সক্ষমতার এসএস পাওয়ারের গড় উৎপাদন ৬১২ মেগাওয়াট। গ্যাস সংকটে মোট ২২টি বিদ্যুৎকেন্দ্র পুরোপুরি বা আংশিক বন্ধ রয়েছে। জ্বালানি তেলের সংকটে ২৭টি ফার্নেস অয়েল ও ডিজেলচালিত কেন্দ্র পুরোপুরি বা আংশিক বন্ধ রয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে নভেম্বরে কম চাহিদার সময়েও দেশে লোডশেডিং করতে হচ্ছে।
বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের পরিচালক মোহাম্মদ শামীম হাসান বলেন, ‘আসলে এখন উৎপাদনে তেমন ঘাটতি নেই। তবে যে লোডশেডিং হচ্ছে তা সিস্টেমের কারণে। সামনে শীতকাল আসছে। তখন বিদ্যুতের চাহিদা কমে যাবে।’ তিনি বলেন, ‘এখন গ্যাসের সংকট আছে। কয়লার সংসকট আছে। এলএনজিও পর্যাপ্ত পাওয়া যায় না। কয়লার সংকটের কারণে বড় বড় বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ আছে। আদানির বিদ্যুৎ এখন কম আসছে। অর্ধেকে নেমে গেছে।’ আদানি সত্যিই বিদ্যুৎ বন্ধ করে দিলে আমরা এটা মোকাবিলা করার জন্য প্রস্তুত আছি। গ্রাহকরা যাতে ভোগান্তির মধ্যে না পড়ে, সে জন্য আমরা বিকল্প ব্যবস্থা নিচ্ছি।
অধ্যাপক ড. এজাজ হোসাইন একজন জ্বালানি বিশেষজ্ঞ। তিনি বলেন, আমরা যে পথে চলছি, তাতে ২০৩০ সাল নাগাদ বিদ্যুতের জন্য প্রয়োজনীয় জ্বালানির ৯২ ভাগ আমদানি করতে হবে। আর এতে ডলারের ওপর চাপ অনেক বেড়ে যাবে। তার কথা, আমাদের গ্যাস আছে, কিন্তু উত্তোলন করছি না। আবার কয়লাও আমাদের আছে, তাও নানা কারণে উত্তোলন করা যাচ্ছে না। আবার সরাসরি আমরা বিদ্যুৎ আমদানিও করছি। এসব কারণে বিদ্যুৎখাত বলতে গেলে পরনির্ভর হয়ে পড়েছে। এটা অব্যাহত থাকলে এই সংকট থাকবেই। তিনি বলেন, আবার আমরা যে বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো নির্মাণ করেছি, তা অপরিকল্পিত। সেগুলো বসিয়ে বসিয়ে ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হচ্ছে। আদানির সঙ্গে চুক্তির সময়ও আমরা দক্ষতার পরিচয় দিতে পারিনি। ফলে এখন আমরা সেটা নিয়ে ভুগছি।
"