নিজস্ব প্রতিবেদক
ডেঙ্গুতে মৃত্যু-সংক্রমণ দুটোই বাড়তি
আগের বছরগুলোর দিকে তাকালে নভেম্বরের দিকে ডেঙ্গুর প্রকোপ অনেকটা কমে এলেও এবার সম্পূর্ণই ব্যতিক্রম। চলতি মাসের প্রথম সপ্তাহের ডেঙ্গুতে মৃত্যু ও সংক্রমণ আগের মাসগুলোর যেকোনো সপ্তাহের তুলনায় বেশি। এ ব্যতিক্রম শঙ্কা জাগাচ্ছে জনস্বাস্থ্যবিদদের। চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, ডেঙ্গু জ্বরে যথাসময়ে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা না নেওয়ায় অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যু ঘটছে। জনস্বাস্থ্যবিদ, চিকিৎসক ও কীটতত্ত্ববিদদের দাবি, ডেঙ্গুর বৃদ্ধি ঠেকানোর জন্য কার্যকর ব্যবস্থার যথেষ্ট ঘাটতি আছে। আবার চিকিৎসাব্যবস্থাও ঢেলে সাজানো হয়নি।
চলতি মাসের প্রথম সাত দিনে দেশে ডেঙ্গুতে যত মৃত্যু ও আক্রান্ত হয়েছে, তা বছরের কোনো সপ্তাহেই হয়নি। চলতি মাসের ১ থেকে ৭ তারিখ পর্যন্ত দেশে ডেঙ্গুতে ৩৭ জনের মৃত্যু হয়েছে। এ সময় আক্রান্ত হয়েছেন ৭ হাজার ২৫৭ জন। এ বছর এখন পর্যন্ত মাসের হিসাবে ডেঙ্গুতে সর্বোচ্চ সংক্রমণ ও মৃত্যু হয়েছে গত অক্টোবরে। ওই মাসের প্রথম সাত দিনে ডেঙ্গুতে মৃত্যু ও সংক্রমণের সংখ্যা ছিল যথাক্রমে ২২ ও ৫ হাজার ৭২৬। অক্টোবরের শেষ সাত দিনে (২৫ থেকে ৩১ অক্টোবর) ডেঙ্গুতে আক্রান্তের সংখ্যা ছিল ৭ হাজার ১১৫। আর মৃত্যু হয়েছিল ২৮ জনের। আর শুক্রবার ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গুতে ৫ জনের মৃত্যু হয়েছে। আক্রান্ত হয়েছেন ৪৬৬ জন। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের দেওয়া তথ্যমতে, সর্বশেষ ২৪ ঘণ্টায় মারা গেছে ৮ জন। চলতি বছর এখন পর্যন্ত ডেঙ্গুতে ৩৫০ জনের মৃত্যু হয়েছে। এটি যেকোনো বছরে এ রোগে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ মৃত্যু। দেশের ইতিহাসে গত বছর সর্বোচ্চ ১ হাজার ৭০৫ জনের মৃত্যু হয়েছিল। যুক্তরাষ্ট্র থেকে প্রকাশিত জার্নাল অব মেডিকেল এন্টোমোলজিতে প্রকাশিত এক গবেষণায় বলা হয়েছে, বাংলাদেশে ডেঙ্গুর রোগতাত্ত্বিক রেখা বা সংক্রমণের মাসিক বৃদ্ধির গতিপথ ঠিক থাকছে না।
২০২২ সালের ব্যতিক্রম ছাড়া সাধারণত সেপ্টেম্বর থেকেই ডেঙ্গুর প্রকোপ এবং এতে মৃত্যু কমে আসে। ওই বছর অতীতের সব রেকর্ড ভেঙে ডেঙ্গুতে সর্বোচ্চ সংক্রমণ হয়েছিল অক্টোবরে। আর সবচেয়ে বেশি মানুষ মারা গিয়েছিল নভেম্বরে। কিন্তু নভেম্বরে সংক্রমণ কমে গিয়েছিল আগের মাসের তুলনায়। কিন্তু এবার এর ব্যতিক্রম হলো।
আইইডিসিআরের উপদেষ্টা জনস্বাস্থ্যবিদ ডা. মুশতাক হোসেন বলেন, নভেম্বরে সংক্রমণ আগে কখনোই এভাবে বাড়েনি। এখন দেশে ডেঙ্গুর সর্বোচ্চ সংক্রমণ হচ্ছে। এ পরিস্থিতি আরো অন্তত ১৫ দিন চলতে পারে। আর প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা না নিলে মৃত্যুর আরো ঘটনা ঘটতে পারে।
সংক্রামক রোগের বিস্তৃতি অনুসরণ করার একটি পদ্ধতি হচ্ছে মাসিক ‘গ্রোথ ফ্যাক্টর’ বা বৃদ্ধির হার নির্ধারণ করা। এর মাধ্যমে জানা যায়, আগের মাসের তুলনায় বর্তমান মাসে বা বর্তমান মাসের তুলনায় পরবর্তী মাসে কত সংখ্যক মানুষ আক্রান্ত হবে বা মারা যাবে।
যুক্তরাজ্যের কিল ইউনিভার্সিটির গবেষক নাজমুল হায়দার বাংলাদেশের গত ২৩ বছরের ডেঙ্গুর বিস্তারের ওপর ভিত্তি করে মাসিক বৃদ্ধির হার নির্ণয় করেছেন। এ সংক্রান্ত গবেষণা জার্নাল অব মেডিকেল এন্টোমোলজি নামের বিজ্ঞান সাময়িকীতে প্রকাশিত হয়েছে।
গবেষণা অনুযায়ী, বাংলাদেশে জুন মাসে ডেঙ্গু বৃদ্ধির হার থাকে সর্বোচ্চ ২ দশমিক ৪২। অর্থাৎ জুন মাসের সংক্রমণের হার জুলাইয়ে গিয়ে প্রায় আড়াই গুণ বাড়তে পারে। অক্টোবরে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা হয় সেপ্টেম্বরে আক্রান্তের অর্ধেক। সেপ্টেম্বরে বৃদ্ধির হার শূন্য দশমিক ৮২ থেকে অক্টোবরে কমে আসে শূন্য দশমিক ৪৫-এ।
গত ২৩ বছরের উপাত্ত অনুসারে বাংলাদেশে আক্রান্ত ডেঙ্গু রোগীর মধ্যে মৃত্যুর সংখ্যা শূন্য দশমিক ৪৫ থেকে শূন্য দশমিক ৫৩। এ হিসাবে নভেম্বর মাসেও শতাধিক মানুষের মৃত্যুর আশঙ্কা আছে।
এ গবেষণায় জলবায়ু পরিবর্তনজনিত অস্বাভাবিক বৃষ্টি এবং মশা বৃদ্ধির হারকে বিবেচনা করা হয়নি। তাই বৃদ্ধির হার যেভাবে দেখা হয়েছে, তা ত্রুটিপূর্ণ বলে মনে করেন আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশের (আইসিডিডিআরবি) বিজ্ঞানী মোহাম্মদ শফিউল আলম।
তবে গবেষক নাজমুল হায়দার বলেন, রোগ বৃদ্ধির হার সব বছর মিলবে না। বিস্ময়কর বিষয় হলো, বাংলাদেশে সংক্রমণ বৃদ্ধির হারের সর্বোচ্চ সংখ্যাও অতিক্রম করে গেছে। যেমন এ বছরের আগস্ট মাসের ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যাকে (৬ হাজার ৫২১) বিবেচনায় নিলে সেপ্টেম্বর মাসের সর্বোচ্চ রোগী হওয়ার কথা ছিল ৮ হাজারের কাছাকাছি। কিন্তু বাস্তবে সেপ্টেম্বর মাসে রোগীর সংখ্যা ছিল ১৮ হাজারের বেশি। এটা ধারণার চেয়ে দ্বিগুণের বেশি। ডেঙ্গু বহু কারণে ঘটা একটি সংক্রামক রোগ। যেমন তাপমাত্রা, বৃষ্টিপাত, পরিবেশে মশার সংখ্যা, মানুষের প্রতিরোধক্ষমতা ইত্যাদির কারণে ডেঙ্গু রোগের সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণহীনভাবে বাড়তে থাকে।
ডেঙ্গুর প্রকোপ নিয়ে ইমেরিটাস অধ্যাপক ডা. এ বি এম আবদুল্লাহ বলেন, আমরা যেকোনো রোগের শুরুতে সতর্ক হই না। ডেঙ্গু জ্বরে প্রথমদিকে সতর্ক না হওয়ায় অনেক রোগী শকে চলে যাচ্ছে। অনেকে যথাসময়ে চিকিৎসা না পেয়ে মারা যাচ্ছেন। এমন পরিস্থিতি থেকে বাঁচতে হলে সবার আগে মশক নিধনে জোর দিতে হবে। কারো জ্বর হলেই বা ডেঙ্গু সন্দেহ হলেই পরীক্ষা করাতে হবে। ডেঙ্গু টেস্টে অবহেলা করা সঠিক সিদ্ধান্ত হবে না।
ডা. এ বি এম আবদুল্লাহ বলেন, দিনের বেলায় মশার কামড় থেকে বাঁচতে হলে সচেতন হতে হবে। প্রয়োজনে ফুলহাতা জামা-প্যান্ট পরিধান করতে হবে। দিনে বা রাতে ঘুমানোর আগে মশারি টাঙাতে হবে। কারো সাধারণ জ্বর, সর্দি-কাশির মতো লক্ষণ দেখা দিলে দেরি না করে ডেঙ্গু পরীক্ষা করাতে হবে। এতে রোগ নির্ণয় ও সঠিক চিকিৎসা নেওয়া সহজ হবে। রোগীর ব্যবস্থাপনায় পরিবার থেকে শুরু করে হাসপাতাল সব জায়গায় শতভাগ প্রস্তুতি থাকতে হবে। এজন্য মানুষকে সচেতন হতে হবে।
আইইডিসিআরের উপদেষ্টা ও সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. মুশতাক হোসেন বলেন, ডেঙ্গুর প্রকোপ কমাতে হলে মশা নিধনে গুরুত্ব দিতে হবে। মশা জরিপের ক্ষেত্রে শুধু প্রাকবর্ষা, বর্ষাকাল ও বর্ষাপরবর্তী মশা জরিপ করলে হবে না। সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোকে প্রতিদিন সার্ভিলেন্স (নজরদারি) করে এডিস মশা প্রজননে হটস্পটগুলো চিহ্নিত করতে হবে। সে অনুযায়ী মশার আবাসস্থল ধ্বংস ও বংশবিস্তার রোধ করতে হবে। ডেঙ্গু রোগীর চিকিৎসাব্যবস্থা বিকেন্দ্রীকরণ করতে হবে।
"