নিজস্ব প্রতিবেদক
বাতিল হচ্ছে সাইবার নিরাপত্তা আইন
অবশেষে বিতর্কিত সাইবার নিরাপত্তা আইন বাতিল করার বিষয়ে নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। মতপ্রকাশ ও মানবাধিকারের জন্য হুমকি হিসেবে সমালোচিত সাইবার নিরাপত্তা আইনটি বাতিলের দাবি ছিল দীর্ঘদিনের। সাংবাদিক, মানবাধিকারকর্মী ও শিক্ষকসহ অনেকেই এই আইনে মিথ্যা মামলার শিকার হয়েছিলেন।
গতকাল বৃহস্পতিবার প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সভাপতিত্বে রাজধানীর তেজগাঁওয়ে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে এ সিদ্ধান্ত হয়। পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান এ তথ্য জানিয়েছেন।
এ বিষয়ে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ জানিয়েছে, উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে সাইবার নিরাপত্তা আইন (রহিতকরণ) অধ্যাদেশ-২০২৪-এর খসড়া নীতিগত অনুমোদন দেওয়া হয়। আইন মন্ত্রণালয়ের আইনি যাচাই (ভেটিং) শেষে চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য পুনরায় উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে উপস্থাপন করা হবে।
বিতর্কিত এ আইন বাতিল বা সংশোধনের বিষয়ে কিছুদিন ধরেই অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টাদের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছিল। এর মধ্যে গত ৩ অক্টোবর ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল বলেছিলেন, ‘অবশ্যই সাইবার নিরাপত্তা আইন বাতিল করা উচিত। সেদিকেই যাব। আলটিমেট এটা বাতিল হবে। পরবর্তী সময়ে যখন নতুন আইন হবে, এটার বেসিক অ্যাপ্রোচ থাকবে সাইবার সুরক্ষা দেওয়া, নাগরিককে সুরক্ষা দেওয়া বিশেষ করে।’
কয়েক দিন আগে তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মো. নাহিদ ইসলাম বলেছিলেন, এ সপ্তাহে এই আইন বাতিল হচ্ছে। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে গত বছর বিতর্কিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিল করে তার বদলে সাইবার নিরাপত্তা আইন করা হয়েছিল। কিন্তু এ আইন নিয়ে সাংবাদিকসহ বিভিন্ন পর্যায় থেকে আপত্তি ওঠে। এ নিয়ে ব্যাপক বিতর্ক ও সমালোচনা হয়। এখন আইনটি বাতিলের বিষয়ে নীতিগত সিদ্ধান্ত নিল অন্তর্বর্তী সরকার।
অন্তর্বর্তী সরকার এরই মধ্যে সাইবার নিরাপত্তা আইনে হওয়া স্পিচ অফেন্স-সম্পর্কিত মামলাগুলো (মুক্তমত প্রকাশের কারণে মামলা) প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এ ছাড়া এসব মামলায় কেউ গ্রেপ্তার থাকলে তিনি আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে তাৎক্ষণিকভাবে মুক্তি পাবেন বলেও জানানো হয়েছে।
এ বিষয়ে গত ৩০ সেপ্টেম্বর আইন মন্ত্রণালয় সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছিল, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন, ২০০৬; ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, ২০১৮ এবং সাইবার নিরাপত্তা আইন, ২০২৩-এর অধীন গত আগস্ট পর্যন্ত দেশের ৮টি সাইবার ট্রাইব্যুনালে মোট ৫ হাজার ৮১৮টি মামলা চলমান। বর্তমানে স্পিচ অফেন্স-সম্পর্কিত মোট ১ হাজার ৩৪০টি মামলা চলমান, যার মধ্যে ৪৬১টি মামলা তদন্তকারী সংস্থার কাছে তদন্তাধীন। ৮৭৯টি মামলা দেশের ৮টি সাইবার ট্রাইব্যুনালে বিচারাধীন।
এসব মামলার মধ্যে ডিজিটাল মাধ্যমে মুক্তমত প্রকাশের কারণে দায়ের হওয়া মামলাগুলোকে ‘স্পিচ অফেন্স’ এবং কম্পিউটার হ্যাকিং বা অন্য কোনো ডিজিটাল ডিভাইসের মাধ্যমে জালিয়াতিকে ‘কম্পিউটার অফেন্স’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। স্পিচ অফেন্স-সম্পর্কিত মামলাগুলোর মধ্যে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনের অধীন ২৭৯টি, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অধীন ৭৮৬টি এবং সাইবার নিরাপত্তা আইনের অধীন ২৭৫টি মামলা চলমান বলে তখন সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ করা হয়েছিল।
বিজ্ঞপ্তিতে আরো বলা হয়েছিল, বর্তমান সরকার স্পিচ অফেন্স-সংক্রান্ত মামলাগুলো দ্রুত প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ১ হাজার ৩৪০টি স্পিচ অফেন্স-সম্পর্কিত মামলার মধ্যে বিচারাধীন ৮৭৯টি মামলা আইন মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সমন্বয়ের মাধ্যমে দ্রুত প্রত্যাহার করা হবে। তদন্তাধীন ৪৬১টি মামলা চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিলের মাধ্যমে দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য তদন্তকারী কর্মকর্তাকে নির্দেশ দেওয়া হবে।
সাইবার সিকিউরিটি আইন বাতিলের দাবি দীর্ঘদিনের : মতপ্রকাশ ও মানবাধিকারের জন্য হুমকি হিসেবে সমালোচিত সাইবার সিকিউরিটি আইন বাতিলের দাবি দীর্ঘদিনের। অন্তর্বর্তী সরকারের ‘রিফর্ম’ আহ্বানের মধ্যে নতুন করে আবারও শুরু হয় সেই দাবি। ভুক্তভোগী ও মানবাধিকারকর্মীরা বলছেন, অন্তর্বর্তী সরকারের দুজন উপদেষ্টা তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন ও ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মিথ্যা মামলার শিকার হয়েছিলেন। আন্দোলনকারীদের মধ্যে অনেক শিক্ষক ও শিক্ষার্থী নাগরিকদের অনেকেই এই আইনে মিথ্যা মামলার শিকার হয়েছেন। তাই তারা দ্রুততম সময়ের মধ্যে এই আইনটি বাতিল চেয়েছেন।
২০২৩ সালে বাংলাদেশে বিতর্কিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন-ডিএসএ পরিবর্তন করে তার জায়গায় ভিন্ন একটি আইন প্রণয়নের অনুমোদন দেয় তৎকালীন মন্ত্রিসভা। এই নতুন আইনটির নাম করা হয় ‘সাইবার নিরাপত্তা আইন-২০২৩।’ সেসময় সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেছিলেন, ‘ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট নাম রহিত করে তার পরিবর্তে সাইবার সিকিউরিটি অ্যাক্ট করা হয়েছে। ব্যাপারটা হচ্ছে, আইনের পরিবর্তন আনা হয়েছে, নামে পরিবর্তন আনা হয়েছে, অনেক জায়গায় সাজার পরিমাণ বেশি ছিল, সেটা কমানো হয়েছে, যেখানে উপধারা দিয়ে পুনরায় অপরাধ করলে সাজা ডবল হয়ে যেতো, সেটা সম্পূর্ণ বিলুপ্ত করা হয়েছে।’
পুলিশ ও সাইবার ট্রাইব্যুনালের হিসাব মতে, ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বরে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন পাস হওয়ার পর থেকে দেশে এই আইনে সাড়ে ৭ হাজারের মতো মামলা হয়েছে।
সাইবার নিরাপত্তা আইনের যে জায়গাগুলোকে সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে এবং জানতে চাইলে আইন বিশ্লেষকরা যে বিষয়গুলো চিহ্নিত করেন তা হলো- আইন ও নীতিমালার অধীনে গঠিত ডিজিটাল নিরাপত্তা এজেন্সির কার্যক্রমের প্রতি স্বাধীন ও নিরপেক্ষ বিচার বিভাগীয় বা সংস্থাগুলো কর্তৃক তত্ত্বাবধানের ব্যবস্থা সম্পূর্ণভাবে অনুপস্থিত থাকা, একই বিষয়বস্তুকে কেন্দ্র করে একাধিক মামলা করার প্রবণতা, বিচার-পূর্ব কারাবাসের সময় সংক্রান্ত সুনির্দিষ্ট নীতির অনুপস্থিতি, বিচার-পূর্ব কারাবাসকে পরবর্তী সময়ে শাস্তি হিসেবে গণ্য করা, অপরাধের বিপরীতে ধারাগুলোর শাস্তির বিধান বেশির ভাগ মাত্রাতিরিক্ত, অসম, অনুপাতহীন এবং অসামঞ্জস্যপূর্ণ থাকা, সাইবার ট্রাইব্যুনালের আদেশ বা রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করার জন্য কোনো নির্দিষ্ট সময়সীমা উল্লেখ না থাকা এবং মিথ্যা হয়রানিমূলক কোনো মামলার প্রতিকার আইনে না থাকা।
এত ধরনের ব্যত্যয়সহ এই আইন বাতিল, নাকি সংস্কার করা দরকার- জানতে চাইলে ‘অন্তর্বর্তী সরকারের মনে রাখা দরকার বর্তমান সাইবার নিরাপত্তা আইন বাতিলযোগ্য, কোনোভাবেই সংশোধনযোগ্য নয়’ উল্লেখ করে মানবাধিকারকর্মী রেজাউর রহমান লেনিন বলেন, ‘সাইবার নিরাপত্তা আইন প্রণয়ন প্রক্রিয়া ছিল অবৈধ এবং বেআইনি, নাগরিকদের অংশগ্রহণবিহীন এই আইনটি প্রস্তাব করা হয়েছিল এবং খুব দ্রুত খসড়াটি আইনে পরিণত করা হয়েছিল। একই সঙ্গে মনে রাখা দরকার, অন্তর্বর্তী সরকারের দুজন উপদেষ্টা তথ্য ও যোগযোগ প্রযুক্তি আইন ও ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মিথ্যা মামলার শিকার হয়েছিলেন এবং যে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে জনসমর্থন পেয়েছেন, সেই নাগরিকদের অনেকেই এই আইনে মিথ্যা মামলার শিকার হয়েছেন।
কেন বাতিল প্রয়োজন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘সাইবার নিরাপত্তা আইনটি জনস্বার্থ-সংশ্লিষ্ট কর্মকাণ্ড এবং অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের মধ্যে পার্থক্য করতে ব্যর্থ হয়েছে। প্রায় সব ধারার সংজ্ঞায়নের ক্ষেত্রে অস্পষ্টতা ও অপ্রতুলতা রয়েছে। আইনে অনেক অপরাধের সংকীর্ণ সংজ্ঞায়ন করা হয়েছে এবং অপরাধের অভিপ্রায় সম্পর্কে পর্যাপ্ত নজর রাখা হয়নি এবং আন্তর্জাতিক সাইবার অপরাধ সংক্রান্ত চুক্তির বিকশিত মানগুলোর সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে করা হয়নি।’
"