নিজস্ব প্রতিবেদক
দেশে উল্টো চিত্র চালের বাজারে
বিশ্ববাজারে চালের দাম কমলেও বাংলাদেশে দেখা গেছে এর উল্টো চিত্র। রাজধানীর কয়েকটি বাজারে প্রায় সব ধরনের চালের দাম খুচরা পর্যায়ে কেজিতে ৪ থেকে ৬ টাকা বেড়েছে। ৫০ কেজির এক বস্তা চালের দাম ৫০ থেকে ১৫০ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। বিশ্বের শীর্ষ চাল রপ্তানিকারক দেশ ভারত রপ্তানিতে বিধিনিষেধ তুলে নেওয়ায় আন্তর্জাতিক বাজারে নিত্যপণ্যটির দাম কমতে শুরু করে।
সরেজমিন গতকাল সোমবার রাজধানীর কয়েকটি বাজারে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মোটা, মাঝারি ও সরু প্রায় সব ধরনের চালের দাম খুচরা পর্যায়ে কেজিতে ৪ থেকে ৬ টাকা করে বেড়েছে। ব্যবসায়ীরা জানান, ৫০ কেজির চালের বস্তায় ১৫০ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। রাজধানীর কাঁচাবাজারে প্রায় সব ধরনের চালের দাম বেড়েছে। বাজারে প্রতি কেজি মোট দানার চাল খুচরা পর্যায়ে পড়েছে ৬৪-৬৫ টাকা। মাঝারি ব্রি-২৮-এর দাম ছিল ৬৬-৬৮ টাকা কেজি এবং সরু দানার (মিনিকেট ও নজিরশাইল) চাল পড়ে ৮৪-৮৫ টাকা। ব্যবসায়ীরা প্রতি বস্তা মিনিকেট চাল ৩ হাজার ২৫০ থেকে ৩ হাজার ৭৫০ টাকায় এবং নাজিরশাইল ৩ হাজার ৩০০ থেকে ৩ হাজার ৮০০ টাকা দরে বিক্রি করছেন। ব্যবসায়ীদের দাবি, ধানের দাম বৃদ্ধি ও রাইস মিল থেকে সরবরাহ কমে যাওয়ায় চালের দাম বেড়েছে।
দাম বাড়ানোর জন্য খুচরা বিক্রেতারা দায়ী করছেন পাইকারদের; আর পাইকাররা দাবি করছেন মিল পর্যায়ে দাম বেড়েছে। রাজধানীর কারওয়ানবাজারের মেসার্স কাইয়ুম এন্টারপ্রাইজের কর্মী সালাম মোল্লা বলেন, বিআর-২৮ ও বিআর-২৯ জাতের চালের দাম গত সপ্তাহে সবচেয়ে বেশি বেড়েছে। এ চালগুলোর দাম প্রতি ৫০ কেজির বস্তায় প্রায় ১০০ থেকে ১৫০ টাকা বেড়েছে। তিনি বলেন, আমরা বিআর-২৮ ও বিআর-২৯ জাতের ৫০ কেজির বস্তা ৩ হাজার থেকে ৩ হাজার ১০০ টাকায় বিক্রি করছি। এক সপ্তাহ আগেও এ চাল বিক্রি করেছি ২ হাজার ৮৫০ থেকে ২ হাজার ৯৫০ টাকায়।
গত সপ্তাহে খুচরা বাজারে চালের দাম প্রতি কেজিতে ১ থেকে ৩ টাকা বেড়ে যাওয়ায় চাপ বাড়ছে ভোক্তাদের ওপর। রাজধানীর ওয়ারী এলাকার শ্রমিক মনসুর আলী বলেন, আমি পাইজাম চাল কিনি। আগে এ ধরনের চালের দাম ছিল ৫৬ থেকে ৫৮ টাকা কেজি। এখন কিনতে হচ্ছে ৬৫ টাকায়। জানা গেছে, বিভিন্ন এলাকায় বন্যা ও অতিবৃষ্টির কারণে চালের সরবরাহ ঘাটতি দেখা দিয়েছ, পরিবহন ব্যয় বেড়েছে। ঢাকায় যেসব আড়তদারদের চাল শেষ হয়েছে বা কমে আসছে, তারা ৫০ পয়সা থেকে ১ টাকা পর্যন্ত কেজিতে চালের দাম বাড়াতে শুরু করেছে।
পাইকাররা জানান, মিল মালিকরা দাবি করছেন, তাদের কাছে পর্যাপ্ত মজুদ নেই। কিন্তু আসলে আছে। তারা সংকটের অজুহাত দেখিয়ে আমাদের কাছ থেকে বেশি দাম নিচ্ছে। মালিবাগ বাজারে কেনাকাটা করতে আসা ময়ুরী আক্তার বলেন, এক সপ্তাহ আগেও বিআর-২৮ চাল কিনেছি ৬২ টাকা কেজিতে। আর আজ (গতকাল) দোকান মালিক এ চালের দাম চাইছেন ৬৫ টাকা। খুচরা ব্যবসায়ী রাকিব হোসেন বলেন, কেজিতে আমরা ৫ থেকে ৬ টাকা লাভ করি। পাইকাররা আমাদের কাছ থেকে বেশি দাম নিচ্ছে বলে দাম বাড়ানো ছাড়া আমাদের কোনো উপায় নেই।
বিশ্ববাজারে দাম নিম্নমুখী : ভারত সম্প্রতি আধাসেদ্ধ চাল রপ্তানিতে শুল্ক প্রত্যাহার করে নেওয়ায় বিশ্ববাজারে তার ইতিবাচক প্রভাব পড়েছে। বিশেষ করে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ও আফ্রিকায় চালের দাম কমছে। থাইল্যান্ডের চাল রপ্তানির গড় মূল্য গত সপ্তাহে টনপ্রতি ৫২৯ ডলারে নেমে এসেছে। এ দাম আগের মাসের চেয়ে ৮ শতাংশ কম। এছাড়া চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে থাই চালের রপ্তানিমূল্য ১৫ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ পর্যায়ে উঠেছিল। সেই তুলনায় এখন দাম কমেছে ২১ শতাংশ। সে সঙ্গে ভারতেও ৫ শতাংশ খুদযুক্ত সেদ্ধ চালের দাম গত সপ্তাহে ছিল টনপ্রতি ৪৫০ থেকে ৪৮৪ ডলার, গত বছরের আগস্টের পর যা সর্বনিম্ন। ভারতের ৫ শতাংশ খুদযুক্ত সাদা চালের দাম আগের সপ্তাহে ছিল টনপ্রতি ৪৬০ থেকে ৪৯০ ডলার।
ভিয়েতনাম ফুড অ্যাসোসিয়েশনের তথ্যানুযায়ী, গত সপ্তাহে দেশটিতে চালের দাম গত বছরের জুলাইয়ের পর সর্বনিম্ন পর্যায়ে নেমেছে। ভিয়েতনামে গত বৃহস্পতিবার ৫ শতাংশ খুদযুক্ত চাল টনপ্রতি ৫৩২ ডলারে বেচাকেনা হয়েছে, আগের সপ্তাহে যা ছিল ৫৩৭ ডলার। ২০২২ সালে বিশ্বে যত চাল রপ্তানি হয়েছিল, তার ৪০ শতাংশই করেছে ভারত। সেই হিসাবে ভারত পৃথিবীর সবচেয়ে বড় চাল রপ্তানিকারক দেশ। ওই বছর বিশ্ব রপ্তানি বাজারে ৫ কোটি ৫৪ লাখ টন চাল বেচাকেনা হয়েছিল। এর মধ্যে শুধু ভারতের চালই ছিল ২ কোটি ২২ লাখ টন।
চালের আন্তর্জাতিক বাজারে ভারতের পরের চারটি অবস্থানে রয়েছে থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম, পাকিস্তান ও যুক্তরাষ্ট্র। ২০২৩ সালে এ চার দেশ সম্মিলিতভাবে যত চাল রপ্তানি করে, ভারত একাই তার চেয়ে বেশি রপ্তানি করে। ভারত সব মিলিয়ে ১৪০টি দেশে চাল রপ্তানি করে। সেজন্য ভারতের চাল রপ্তানির সিদ্ধান্ত বিশ্ববাজারে চালের দামে প্রভাব ফেলে। ২০২৩ সালে ভারত চাল রপ্তানিতে বিধিনিষেধ আরোপ করলে বিশ্ববাজারে চালের দাম বেড়ে যায়। ভারত চাল রপ্তানিতে নানারকম বিধিনিষেধ দেওয়ার কারণে এশিয়া ও আফ্রিকার ক্রেতারা এ শস্য কিনতে ছোটেন থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম, পাকিস্তান ও মিয়ানমারে। চাহিদা হঠাৎ বেড়ে যাওয়ার কারণে এসব দেশে চালের রপ্তানির মূল্য গত ১৫ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছে যায়।
রপ্তানিকারক দেশের প্রতিযোগিতামূলক দামের কারণে ভিয়েতনামে চালের দাম কমেছে। এছাড়া গত সপ্তাহে ইন্দোনেশিয়ার বুলোগ চাল ক্রয়ের টেন্ডার বাতিল করেছে। চালের দামে তার প্রভাবও পড়েছে। এদিকে থাইল্যান্ডে গত সপ্তাহে ৫ শতাংশ খুদযুক্ত চালের দাম ছিল টনপ্রতি ৫১০ ডলার, আগের সপ্তাহে যা ছিল ৫২৫ ডলার। গত সেপ্টেম্বর মাস থেকেই চাল রপ্তানিতে ভারত বিধিনিষেধ শিথিল করছে। ফলে গত মাসের শেষ দিক থেকেই বিশ্ববাজারে চালের দাম কমছে। সেই ধারা এখনো অব্যাহত আছে।
"