নিজস্ব প্রতিবেদক
কর্মক্ষেত্রে এক দশকে মৃত্যু সাড়ে ৫ হাজার
মো. এমদাদুল হক, পেশায় ছিলেন রাজমিস্ত্রি। ২০১৯ সালে নির্মাণাধীন ভবন থেকে পড়ে গিয়ে পঙ্গু হয়ে যান। পাঁচ বছর হয়ে গেলেও ভবন মালিক অথবা কন্সট্রাকশন কোম্পানি থেকে পায়নি কোনো ক্ষতিপূরণ। আর শারীরিকভাবে অক্ষম এমদাদুলের পরিবারের নিয়তি শুধুই অনিশ্চয়তা।
মো. এমদাদুল বলেন, ‘হক জরিমানা বলতে আমি যে মেডিকেলে ভর্তি হয়েছি, সেটাও দিতে পারেনি। আমার স্ত্রী বাড়ি থেকে ২০ হাজার টাকা ধার করে এনে ভর্তি করেছে।’ এদিকে, স্ত্রী নাজমা বেগম পুরো পরিবারের ভার নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছে। পঙ্গু স্বামীকে দেখাশোনা করা এবং একই সঙ্গে নিজেই চাকরি করে সংসার চালাচ্ছে। পাশাপাশি শ্রমিক দুর্ঘটনা মামলা নিয়ে আদলতের দৌড়ঝাঁপ। হাঁপিয়ে উঠলেও সন্তান-স্বামীর ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে সব করে যাচ্ছেন দশভুজা নাজমা বেগম।
নাজমা বেগম বলেন, ‘এখন রোজকার করতে পারলে খাওয়া-দাওয়া করতে পারব, না হলে পারব না। আমি যদি এখন বিছানায় পড়ে যাই, তাহলে দেখার মতো কেউ নেই, সাহায্য করার মতো কেউ নেই।’
একই ঘটনা বাবুল বাবুরও। ছয় বছর আগে ইন্টারনেটের সংযোগ দিতে কোনো ধরনের নিরাপত্তা ছাড়াই মালিক তাকে উঠিয়ে দেন বহুতল ভবনে। বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে বর্তমানে পঙ্গু তিনি। আর এ ঘটনার পর পঙ্গু স্বামীকে ছেড়ে বাপের বাড়ি চলে যান স্ত্রী। শ্রম আদালতে মামলা করলেও মালিকের পক্ষ থেকে পাননি কোনো জরিমানা। মা, বড় ভাই আর তাদের সংসারে নিজেকেই বোঝা ভাবেন বাবুল।
বাবুল বাবু বলেন, ‘আমার মালিক মার হাতে ধরে বলতেছে আমি খুবই অসুবিধায় আছি এখন দিতে পারছি না টাকা। আমি এখন আসলে কোনো কিছু করতে পারছি না।’
এমদাদুল, বাবুলের মতো এমন ঘটনা নিত্যদিনের। এভাবে শুধু কর্মক্ষেত্রেই বিভিন্ন দুর্ঘটনায় এক দশকে প্রায় সাড়ে ৫ হাজার শ্রমিকের প্রাণহানি হয়েছে। আহত কয়েক হাজার। এদের বেশির ভাগই মালিকপক্ষ থেকে কোনো ধরনের সহযোগিতা বা ক্ষতিপূরণ পাননি। আর শ্রম আদালতে ঝুলে আছে প্রায় ২০ হাজার মামলা।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রয়োজনীয়সংখ্যক আদালত, বিচারক নিয়োগ এবং সহায়ক জনবলসংকট দূর করা গেলে শ্রমিকরা তাদের অধিকার ফিরে পাবে। আর শ্রম উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ বলছেন, শ্রমিকদের স্বার্থ রক্ষায় কাজ করছে অন্তর্বর্তী সরকার।
গবেষণা তথ্য বলছে, এ বছর প্রথম ৬ মাসেই ৪২০টি দুর্ঘটনায় মারা গেছে ৪৭৫ শ্রমিক। আর আহত হাজার দুয়েকের বেশি। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি মারা গেছে কনস্ট্রাকশন, পরিবহন আর সেবা খাতে। ২০২৩ সালে একই সময়ে সারা দেশে ২৮৭টি দুর্ঘটনায় ৩৮৯ জন শ্রমিক নিহত হয়েছিল।
আর বিগত বছর দেশে কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনায় ৮৭৫ জন শ্রমিক নিহত হয়। হিসাব বলছে, গত ১০ বছরে প্রায় সাড়ে ৫ হাজার শ্রমিক নিহত হয়েছে। আর এ সময় কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনা ঘটেছে ৪ হাজার ৭১টি।
সেইফটি অ্যান্ড রাইটসের নির্বাহী পরিচালক সেকান্দার আলি মিনা বলেন, ‘একজন শ্রমিক নিহত হলে মালিককে যে যে শাস্তি দেওয়া হতো, তা যদি সবগুলো সঠিকভাবে দেওয়া যেত, তাহলে মালিক ক্ষতিপূরণ দিতে বাধ্য থাকত।’
শ্রম মন্ত্রণালয়ের তথ্য মতে, দেশের ১৩টি শ্রম আদালতে ২০ হাজারের বেশি মামলা বিচারাধীন। শ্রমিকদের অধিকার ও আইন নিয়ে কাজ করছে বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট। সংস্থাটির মতে, প্রয়োজনীয়সংখ্যক আদালত, বিচারক ও সহায়ক জনবলসংকটের অভাবে বছরের পর বছর ধরে এসব মামলা ঝুলে রয়েছে। এ ছাড়া প্রাথমিক মামলা করার ক্ষেত্রে নিকটস্থ আদালতে মামলা করারও পরামর্শ দেয় সংস্থাটি।
ব্লাস্টের পরিচালক বরকত আলী বলেন, ‘মালিক পক্ষ যদি দুর্ঘটনা বিষয়ে শ্রম আদালতকে জানায় ক্ষতিপূরণ দেওয়ার বিষয়ে ও ক্ষতিপূরণ যদি ডিপোজিট করে তাহলে মামলা দ্রুত নিষ্পত্তি হতে পারে।’
এদিকে অভিযোগ আছে, কর্মক্ষেত্রের দুর্ঘটনায় যেসব মামলা হয়ে থাকে, সেগুলোয় সরকার মালিকপক্ষের স্বার্থই বেশি দেখে থাকে। এমন অভিযোগ অস্বীকার করেনি শ্রম উপদেষ্টাও। শ্রম আদালতসহ অন্য সংস্থাগুলো জবাবদিহির আওতায় আনা হবে বলেও আশ্বাস দেন তিনি।
শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া বলেন, ‘শ্রম আদালতসহ আরো যে দপ্তর রয়েছে, সেগুলো কীভাবে সক্রিয় করা যায়, তা নিয়ে আমরা কাজ করছি।’
এ ছাড়া মালিককে কর্মক্ষেত্রে শ্রমিকের নিরাপত্তা নিশ্চিত করাকে দায় নয়, বিনিয়োগ মনে করতে হবে বলেও মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
"