নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে চতুর্থ দফা সংলাপ
নির্বাচনী ব্যবস্থা সংস্কারে জোর গণফোরামের
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে সংলাপে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ, আইনশৃঙ্খলা পুনরুদ্ধার, নির্বাচনী ব্যবস্থা সংস্কারসহ বেশ কয়েকটি বিষয়ের ওপর জোর দিয়েছে গণফোরাম। পাশাপাশি বাজার পরিস্থিতি নিয়েও আলোচনা হয়েছে। পরামর্শ দেওয়া হয়েছে সিন্ডিকেট ভাঙার।
গতকাল শনিবার গণফোরামকে দিয়ে চতুর্থ দফা সংলাপ শুরু হয়। এদিন বিকেল ৩টায় রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় প্রধান উপদেষ্টা একের পর এক রাজনৈতিক দলের নেতাদের সঙ্গে সংলাপ করেন। গণফোরামের পর এলডিপির সঙ্গে সংলাপ হয়। এরপর জাতীয়তাবাদী সমমনা জোট, ১২ দল, জাতীয় মুক্তি কাউন্সিল, লেবার পার্টি ও বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি (বিজেপি) আলোচনায় অংশ নেয়। এর আগে গত ৫ অক্টোবর বিএনপিসহ পাঁচটি দল ও তিনটি জোটের সঙ্গে তৃতীয় দফা সংলাপ করেন প্রধান উপদেষ্টা। সংলাপ শেষে বেরিয়ে যমুনার সামনে অপেক্ষমাণ সাংবাদিকদের কাছে গণফোরামের সমন্বয় কমিটির সদস্য সচিব মিজানুর রহমান বলেন, বৈঠকে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ, আইনশৃঙ্খলা পুনরুদ্ধার, নির্বাচনী ব্যবস্থা সংস্কারসহ বেশ কিছু ব্যাপারে পরমার্শ দিয়েছি। সরকার সেটা ইতিবাচক হিসেবে গ্রহণ করেছে। প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে আজ সংলাপে সংবিধান, বিচার বিভাগ, আইনশৃঙ্খলা নিয়ে গণফোরাম নেতা ড. কামাল হোসেন কথা বলেছেন বলে জানান দলটির সমন্বয় কমিটির চেয়ারম্যান মোস্তফা মহসীন মন্টু। তিনি বলেন, সংলাপে বাজার পরিস্থিতি নিয়ে জোর দিয়েছি। সিন্ডিকেট অবশ্যই ভাঙতে হবে।
মোস্তফা মহসীন বলেন, ‘পতিত স্বৈরাচার ও তাদের বিদেশি এজেন্টরা বাংলাদেশকে ধ্বংস করার প্রক্রিয়ার মধ্যে আছে, তাদের থেকে উদ্ধারের জন্য আমাদের সবাইকে জাতীয়ভাবে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে হবে।’
গণফোরাম অবাধ, সুষ্ঠু নির্বাচন চায় জানিয়ে মোস্তফা মহসীন বলেন, ‘সবাইকে একমত হয়ে দেশকে এগিয়ে নিতে হবে। এ সরকার জনগণের সরকার। এ সরকারকে রক্ষার স্বার্থে; অর্থাৎ আমাদের নিজেদের রক্ষার স্বার্থে আগামী দিনে সুষ্ঠু নির্বাচন করতে হবে।’
গণফোরামের এই নেতা বলেন, ‘আমরা সরকারকে সার্বিক সহযোগিতা করব। তিনি (প্রধান উপদেষ্টা) যেকোনো বিষয়ে আমাদের সহযোগিতা চাইবেন। আমরা যেটা উপলব্ধি করব, সেটাই পরামর্শ দেব। জনগণের জন্য দরজা খোলা আছে বলে প্রধান উপদেষ্টা আমাদের বলেছেন।’
নির্বাচন নিয়ে কথা হয়েছে জানিয়ে মোস্তফা মহসীন বলেন, অবাধ, সুষ্ঠু নির্বাচন কমিশন করতে হবে। এটার জন্য সার্চ কমিটি বা কিছু করার প্রয়োজন আছে, ভালো লোক নিয়োগ দেওয়ার দরকার আছে। যাতে অতীতের মতো কোনো সমস্যা না হয়। রোডম্যাপ নিয়ে আলোচনা হয়েছে কি না, এমন প্রশ্নে মোস্তফা মহসীন বলেন, ‘আমরা কোনো তারিখ উল্লেখ করিনি। বলেছি, সংস্কার শেষ দ্রুত নির্বাচন দেওয়ার জন্য।’
সংবিধান সংশোধনের জন্য প্রস্তাব দিয়েছেন কি না, এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, দু-এক দিনের মধ্যে আলোচনা করে লিখিত আকারে দেব। আটটি দিবস বাতিল করা হয়েছে, এ নিয়ে কোনো আলোচনা হয়েছে কি না, এমন প্রশ্নে মোস্তফা মহসীন বলেন, জাতীয় দিবস ছাড়া কোনো দিবসই রাখা উচিত নয়।
এই সংলাপে গণফোরামের ইমেরিটাস সভাপতি ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে ৯ সদস্যের প্রতিনিধিদলে ছিলেন গণফোরামের সমন্বয় কমিটির চেয়ারম্যান মোস্তফা মহসীন মন্টু, কো-চেয়ারম্যান এস এম আলতাফ হোসেন, সুব্রত চৌধুরী, সদস্য সচিব মিজানুর রহমান, সদস্য এ কে এম জগলুল হায়দার আফ্রিক, মহিউদ্দিন আবদুল কাদের, মোশতাক আহমেদ ও সুরাইয়া বেগম।
সংলাপ শেষে ডেমোক্রেটিক পার্টির (এলডিপি) প্রেসিডেন্ট কর্নেল (অব.) অলি আহমেদ বলেছেন, আমরা ২৩টি প্রস্তাব দিয়েছি। বাংলাদেশের জনগণের জন্য যা প্রয়োজন প্রস্তাবে সেগুলো রয়েছে। আগামীতে সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচন, সুন্দর প্রশাসন চালানোর জন্য, ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার জন্য, দ্রব্যমূল্যের জন্য মানুষ কষ্ট পাচ্ছে, তাদের সহযোগিতা করার জন্য আমাদের প্রস্তাবগুলো দেওয়া হয়েছে। এদিন এলডিপির প্রেসিডেন্ট অলি আহমদের নেতৃত্বে মহাসচিব ড. রেদোয়ান আহমেদ, প্রেসিডিয়াম সদস্য নূরুল আলম তালুকদার সংলাপে অংশ নেন।
পরে ১২ দলীয় জোটের সমন্বয়ক ও জাতীয় দলের চেয়ারম্যান সৈয়দ এহসানুল হুদা জানান, সংলাপে তারা শিগগির নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণার দাবি ছাড়াও সম্প্রতি পদত্যাগকারী পাবলিক সার্ভিস কমিশনকে আওয়ামী লীগ দলীয় আখ্যা দিয়ে তাদের সুপারিশ করা ৪৩তম বিসিএসের নিয়োগ প্রজ্ঞাপন এবং ৪৪, ৪৫ ও ৪৬তম বিসিএস পরীক্ষার সব প্রক্রিয়া বাতিলের দাবি জানিয়েছি। সাবেক সরকারের দোসরদের গ্রেপ্তার ও বিচারের আওতায় আনার দাবি জানিয়েছি। এ ছাড়া বর্তমান ইস্যু দ্রব্যমূল্য, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিসহ আরো বেশ কিছু বিষয়ে আলোচনা হয়েছে।
জাতীয়তাবাদী সমমনা জোটের আহ্বায়ক ফরিদুজ্জামান ফরহাদ বলেন, ‘রাষ্ট্র সংস্কারের সঙ্গে সঙ্গে নির্বাচনী রোডম্যাপ প্রকাশ এবং সংস্কার নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে শেষ কররার কথা জানিয়েছি। আর স্থানীয় সরকার নির্বাচনে দলীয় প্রতীক না রাখার পরামর্শ দিয়েছি।’
ফরিদুজ্জামান আরো বলেন, ‘সংস্কার কমিশনগুলোর কাজ নির্ধারিত ৯০ দিনের মধ্যেই শেষ করার কথা জানিয়েছি। সময় বাড়ানো যাবে না। বাজার মনিটরিং এবং আইনশৃঙ্খলা উন্নতির বিষয়ে পরামর্শ দিয়েছি।’ সংবিধান পরিবর্তন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আমরা বলেছি, সংবিধানে বড় ধরনের কোনো পরিবর্তন করতে পারে না অন্তর্বর্তী সরকার। এটা নির্বাচিত সরকার করবে।’ প্রধান উপদেষ্টার কাছে ২০০৯ থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত সব ধরনের রাজনৈতিক গায়েবি মামলা প্রত্যাহারেরও আহ্বান জানায় জাতীয়তাবাদী সমমনা জোট।
৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার রক্তক্ষয়ী অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার ভারতে আশ্রয় নেওয়ার পর অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব নেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস। এ সময় নতুন সরকার তিন দফা রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপ করেছে। আগের তিন দফা সংলাপে আওয়ামী লীগ ও তার জোটের দলগুলোকে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি। অন্তর্বর্তী সরকার জানিয়েছে, আগামীতেও তাদের আমন্ত্রণ জানানো হবে না।
"