গাজী শাহনেওয়াজ
অবসরের আগে যা পাই লুটেপুটে খাই
চাকরিজীবনের শেষ দিকে এসে মরিয়া হয়ে উঠেছে চট্টগ্রামের জেলা রেজিস্ট্রার (ডিআর) মিশন চাকমা। চাকরি থেকে অবসর যাওয়ার বিষয়টিকে সামনে রেখে তিনি এই টাকার পাহাড় গড়ার অনৈতিক কাজে নেমেছেন। লক্ষ্য একটাই কর্মস্থল থেকে বিদায়ের আগে সুযোগমতো ঘুষ-দুর্নীতির বিষ দাঁত বসিয়ে ‘যা পাই, লুটেপুটে খাই’ এমনই এক বেআইনি কাজে তিনি এখন বেপরোয়া হয়ে পড়েছেন। তার দুর্নীতি ও অনিয়মের খতিয়ান বেশ মোটাসোটা বলেই তথ্য প্রমাণ মিলেছে।
জেলা রেজিস্ট্রারের চাকরির শেষ সময়ে এমন অনৈতিক আর্থিক চাহিদার সঙ্গে খাপ-খাওয়াতে ত্রাহী মধু সূদন অবস্থা তার অধীনস্থদের। একই অঞ্চলে দীর্ঘদিন চাকরির সুবাধে আইনি ফাঁকফোকর ও অবৈধ পথে অর্থ উপার্জনের কৌশল আগেই রপ্ত করা আছে এই কর্মকর্তার। এ বিষয়টি সাব-রেজিস্ট্রি অফিসের পিয়ন থেকে কর্মকর্তা কারো কাছে অজানা নয় আর।
মিশন চাকমার এই টাকা হাতিয়ে নেওয়ার মিশন বাস্তবায়নের ক্যাশিয়ার তারই প্রধান সহকারী জাফর উল্ল্যাহ বলে জানা গেছে। বিভিন্ন দৈনিক, সাপ্তাহিক ও মাসিক ইনকামের ছক অনুযায়ী চট্টগ্রাম জেলার অধীন উপজেলা সাব-রেজিস্ট্রি অফিসগুলো থেকে তিনিই আদায় করেন। আর অবৈধ আয়ের ভাগ-বাঁটোয়ার করে নেন এই দুই কর্মকর্তা মিলে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে চট্টগ্রামের জেলা রেজিস্ট্রার (ডিআর) মিশন চাকমা তার বিরুদ্ধে আনীত সব অভিযোগ অস্বীকার করেন। প্রতিদিনের সংবাদকে বলেন, ‘আমার অবৈধ কোনো সম্পদ নেই। না নিজের, না স্ত্রী-সন্তান, কারো নামেই নেই। এর আগেও এমন অভিযোগ উঠেছিল; কিন্তু আমার অবৈধ সম্পদের প্রমাণ কেউ পাননি। সম্ভব হলে আপনি আমার পুরোনো কর্মস্থল নারায়ণগঞ্জ, লক্ষ্মীপুর ও মেহেরপুরে খোঁজ নিয়ে দেখতে পারেন। যা হোক। আমার চাকরি শেষ হবে চলতি বছরে। এ সময়ে একটা নিউজ করে আমার ক্ষতি করার মানে হয় না।’
অভিযোগ রয়েছে, আধু নগরের সাব-রেজিস্ট্রার ইসমাইল হোসনের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের উৎকোচ নিয়ে তাকে সন্দ্বীপ সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে অতিরিক্ত দায়িত্ব দিয়েছেন জেলা রেজিস্ট্রার মিশন চাকমা। নিয়ম অনুযায়ী, কোনো অফিসে সাব-রেজিস্ট্রারের পদশূন্য থাকলে কাজের সুবিধার্থে নিকটবর্তী অফিসের কর্মকর্তাকে অতিরিক্ত দায়িত্ব প্রদানের রেওয়াজ রয়েছে। কিন্তু বিধি লঙ্ঘন করে দূরে অবস্থান করা সাব-রেজিস্ট্রার ইসমাইলকে সেখানে দায়িত্ব দেওয়া হয়েরেছ। আইজিয়ার অফিসের অনুমোদন ছাড়াই সন্দ্বীপ অফিসের সহকারী মাহফুজুর রহমানের বরখাস্ত (সাসপেন্ড) আদেশ প্রত্যাখ্যান করা হয়। এ ধরনের শাস্তি প্রাপ্ত ব্যক্তির আদেশ প্রত্যাহার করতে হলে আইজিআর (নিবন্ধন কর্তৃপক্ষ) অফিসের অনুমোদন নিতে হয়। এরপরও মাহফুজুর রহমানের বিরুদ্ধে জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগে দুদক মামলা দায়ের করেছে। এই মামলাটি চলমান থাকাবস্থায় মোটা অঙ্কের টাকা নিয়ে সহকারী মাহফুজুরকে সন্দ্বীপ অফিস থেকে চট্টগ্রাম সদরে বদলির জন্য সুপারিশসহ আবেদন পাঠিয়েছেন জেলা রেজিস্ট্রার, যা বিধিবহির্ভূত।
এছাড়া বাঁশখালীর নকলনবিস মায়া রানী বরুড়াকে প্রায় বিশ লাখ টাকার বিনিময়ে টিসি মহরার পদে পদোন্নতি দিয়ে চট্টগ্রাম সদরে বদিল করা হয়েছে। সূত্র মতে, এ অবৈধ লেনদেনের নেপথ্যে জেলা রেজিস্ট্রার অফিসের সহকারী সাইফুলের মাধ্যমে অর্থিক লেনদেন করেন মিশন চাকমা ।
তাছাড়া চাঁটগাও সাব-রেজিস্ট্রার অফিসের সামনের লিজ প্রাপ্ত একটি ভাতের হোটেল ও চায়ের দোকান ভেঙে জনপ্রতি ৫ লাখ টাকা উৎকোচ নিয়ে ২০ জন দলিল লেখকের চেম্বার করার সুযোগ দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে মিশন চাকমার বিরুদ্ধে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, সাব-রেজিস্ট্রি অফিসের দৈনিক ভিত্তিতে নকলনবিসসহ কয়েকটি পদে জনবল নিয়োগ হয়। দৈনিক ৬০ টাকার ভিত্তিতে ওইসব কর্মচারীরা কাজ করেন। মিশন চাকমা তার অধীন জেলা রেজিস্ট্রার অফিস থেকে সাব-রেজিস্ট্রি অফিসগুলো খণ্ডকালীন এই চাকরির জন্য নেন চার থেকে পাঁচ লাখ টাকা বলে কথাবার্তা রয়েছে। সপ্তাহের শেষ কর্মদিবসে প্রতিটি সাব-রেজিস্ট্রি অফিস থেকে এক লাখ টাকা। আর পিয়ন, মহোরার এবং টিসি মোহরার (কর সংগ্রহকারী) বদলি-পদোন্নতিতেও নেন মোটা অঙ্কের টাকা।
জানা যায়, গত সরকারে সমর্থক স্থানীয় এক প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতার বিশেষ আশীর্বাদ পুষ্ট হওয়ার সুবাধে সাব-রেজিস্ট্রারের চাকরির শুরু থেকেই ঘূরে ফিরেই চট্টগ্রাম অঞ্চলেই চাকরি করেছেন মিশন চাকমা। পরে পদোন্নতি পেয়ে জেলা রেজিস্ট্রার হওয়ার পর ওপর মহলকে ম্যানেজ করে চট্টগ্রাম জেলা রেজিস্ট্রার হিসেবে যোগদান করেন। এই পদে বসেই ঘুষের মহৎসবে মেতে উঠেন। এভাবেই অবৈধ ও অনৈতিক পথেই হাতিয়ে নিয়েছেন লাখ লাখ টাকা। এ বিষয়ে নিবন্ধন অধিদপ্তরের মহাপরিদর্শক মো. নূর ইসলাম সাংবাদিকদের জানান, আমি নতুন এসেছি। অভিযোগের বিষয়ে আমি মন্তব্য করতে চাই না।
ছাত্র জনতার অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলেই চট্টগ্রামের জেলা রেজিস্ট্রারের পদটি বাগিয়ে নেন মিশন চাকমা। নিবন্ধন অধিদপ্তরের অনুমতির তোয়াক্কা না করেই মিশন চাকমা এক কলমের খোঁচায় ৮০ জন নকলনবিস নিয়োগ দেন। এই ঘটনায় আইন মন্ত্রণালয় ও নিবন্ধন কর্তৃপক্ষ নড়েচড়ে বসেন। খবরটি সে সময় বেশ হইচই পড়ে যায়। এই অবৈধ নিয়োগ থেকেই তার পকেটে ঢোকে চার কোটি টাকা বেশি।
এক পর্যায়ে এ ইস্যুতে বিতর্ক তুঙ্গে পৌঁছালে এবং চাকরি খোয়ানোর ভয়ে নিয়োগগুলো বাতিল করেন; তবে ঘুষের টাকা ফেরত পাননি বলে তার বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে ভুক্তভোগীদের ।
এ ছাড়া জমি রেজিস্ট্রির দলিলে নানা ভুলভ্রান্তির কারণে অনেক সময় সাব রেজিস্ট্রাররা দলিলটি করতে রাজি হন না। তখন জেলা রেজিস্ট্রার মিশন চাকমা ত্রুটিসহ দলিলটি রেজিস্ট্রি করতে চাপ প্রয়োগ করেন। চাকরির এসিআরে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার নেতিবাচক মন্তব্য লাগার ভয়, বদলি আতঙ্ক এবং চাকরি হারানোর ভয়ে অনেক জুনিয়র সাব-রেজিস্ট্রার কাগজপত্রে ঘাপলা সত্ত্বেও জমির দলিল রেজিস্ট্রি করতে বাধ্য হন। অনেক সময় বিব্রত হলেও নিরুপায় হয়ে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা মিশন চাকমার চাপে অনৈতিক কাজে সমর্থন দেন। এখান থেকেও মোটা অঙ্কের অর্থ আদায় করে নেন মিশন চাকমা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, চট্টগ্রাম জেলা রেজিস্ট্রারে অধীনে ২২টি সাব-রেজিস্ট্রি অফিস রয়েছে। প্রতিটি অফিস থেকে দলিল প্রতি ৩০০ টাকা, দলিলের নকলপ্রতি ২৫০ টাকা এবং জমি রেজিস্ট্রির কমিশনের অনুমতির জন্য দলিল প্রতি আদায় করা হয় ৩০০০ টাকা।
হিসাব ছাড়া এই ঘুষের মাসোয়ারা তার প্রধান সহকারী ও ক্যাশিয়ার জাফর উল্ল্যাহর মাধ্যমে সপ্তাহের শেষে অধীন সব রেজিস্ট্রি অফিস থেকে জেলা রেজিস্ট্রারে পকেটে ঢোকে। মাসিক বেতনের বাইরে প্রায় ১ কোটি ২০ লাখ টাকা বাড়তি আয় করেন চট্টগ্রামের জেলা রেজিস্ট্রার। এসব অবৈধ আয় ওপেন সিক্রেট হলেও সবাই থাকেন নিশ্চুপ।
বড়কর্তার ঘুষের তল্পিবাহক হিসেবে প্রধান সহকারী জাফল উল্ল্যাহ নিজেও এখন কোটিপতি। মাস থেকে ২২ সাব রেজিস্ট্রি অফিসের কোন একটি থেকে পাঠানো ঘুষের মাসোহারা কম হলে হুমকি-ধমকিও শুনতে হয় সাব-রেজিস্ট্রারদের বলেও জানা গেছে। এতে তার অধীনে কর্মরত অনেকেই কর্মস্থল বদলাতে করছেন স্ব উদ্যোগে তদবির।
দুহাতে এভাবেই টাকা কায়িমে মিশন চাকমা করেছেন একাধিক প্লট-ফ্ল্যাট ও রিসোর্ট। এর মধ্যে ঢাকার কমলাপুর, উত্তরায় ফ্ল্যাট, চট্টগ্রামের চাদগাঁওয়ে আবাসিক বাড়ি এবং নিজ জেলা রাঙামাটিতে বিলাসবহুল আবাসিক হোটেল ও রিসোর্ট গড়ে তুলেছেন বলে জানিয়েছেন একাদিক ভুক্তভোগী। এ ছাড়া রয়েছে নামে-বেনামে জমি। তবে এসব কথা মানতে রাজি নন মিশন চাকমা। যদি এ ধরনের সম্পদের হিসাব কেউ দিতে পারে তাকে ওই সম্পদগুলো দিয়ে দেব; দাবি মিশন চাকমার।
মিশন চাকমার ঘুষ-দুর্নীতির ব্যাপারে এসব অনিয়মের বিরুদ্ধে দুদকে ডজন ডজন অভিযোগ জমা হলেও অর্জিত কালো টাকা দিয়ে কাজ করা কর্তৃপক্ষকে ম্যানেজ করে ফেলা হয় আজ অবধি একটিও অভিযোগ আলোরমুখ দেখেনি।
গত বুধবার তার দপ্তরে এ বিষয়ে কথা হয় নিবন্ধন অধিদপ্তরের সহকারী মহাপরিদর্শক (এআইজিআর) মো. আবদুস ছালাম আজাদের সঙ্গে। চট্টগ্রামের জেলা রেজিস্ট্রারের বিষয়ে জানতে চাইলে প্রতিদিনের সংবাদকে তিনি বলেন, এ ধরনের অভিযোগের বিষয়ে আমার কিছু জানা নেই। বলেন, আপনার করা অভিযোগটির বিষয়ে আমি ওনার সঙ্গে কথা বলব। যদি কোনো অনিয়ম পাওয়া যায়, আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেবে কর্তৃপক্ষ।
"