দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে আরো কঠোর হওয়া প্রয়োজন
ড. কামাল উদ্দিন আহমেদ
যদিও দু-তিন বছর ধরেই দেশে দ্রব্যমূল্য ঊর্ধ্বগামী; গত এক মাসে ডিম-মুরগি, চাল-ডাল, শাকসবজি থেকে সব ধরনের নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম নজিরবিহীন হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে সাধারণ মানুষের অসহায়ত্বের বিষয় অনুভব করা যায়। দ্রব্যমূলের এ অসহনীয় বৃদ্ধি সব শ্রেণির মানুষের জন্য ভোগান্তি সৃষ্টি করলেও সবচেয়ে অসহায় অবস্থায় রয়েছে সীমিত আয়ের মানুষ। কয়েক বছর ধরেই জীবনযাত্রার ব্যয় সংকুলানে হিমশিম খাওয়া মানুষ এখন দিশাহারা।
বাজারের টালমাটাল পরিস্থিতিতে মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা হিসেবে এসেছে বৃহত্তর কুমিল্লা, নোয়াখালী, রংপুর, ময়মনসিংহের কমপক্ষে ২০ জেলার বন্যা। বন্যায় ফসল ও পোলট্রি খাতের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির ফলে চাহিদার তুলনায় বাজারে জোগান কমে গেছে। যেকোনো অজুহাতকে কাজে লাগিয়ে বাজার অস্থিতিশীল করে তোলে একশ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী। ফলে দ্রব্যমূল্য সহনীয় পর্যায়ে রাখতে সরকারের বিভিন্ন ব্যবস্থা গ্রহণ সত্ত্বেও পরিস্থিতি স্বাভাবিক হচ্ছে না। চলমান মূল্যস্ফীতিতে শহুরে জীবনের নিম্ন ও মধ্যবিত্ত মানুষের নিত্যদিনের অধিকাংশ পুষ্টি চাহিদা পূরণ হয় ডিমের মাধ্যমে। সে ডিমও এখন অদৃশ্য হাতের কারসাজিতে সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে।
জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের পক্ষে ঢাকার কারওয়ানবাজার ও তেজগাঁও আড়তে সরেজমিন দেখা গেছে, ডিমের আড়তদাররা সরকারের বেঁধে দেওয়া দামে ডিম বিক্রি করতে অক্ষমতা, রসিদ দিতে না পারা এবং সরকারের চলমান অভিযান ও জরিমানার প্রতিবাদে ডিম সংগ্রহ ও বিক্রি বন্ধ রেখেছেন। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে যেখানে জনগণের নাভিশ্বাস অবস্থা, সেখানে নতুন এ সংকট বিস্ময়কর এবং অনভিপ্রেত। প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর ফার্মের মুরগির ডিম প্রতিটির সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য নির্ধারণ করে দিয়েছে ১১ টাকা ৮৭ পয়সা। কিন্তু পাইকারি আড়তে ১৩-১৪ টাকার নিচে ডিম বিক্রি হচ্ছে না। আর খুচরা দোকান কিংবা পাড়া-মহল্লায় তা বিক্রি হচ্ছে ১৫ টাকায়।
পরিসংখ্যান বলছে, প্রতিদিন দেশে প্রায় সাড়ে ৪ কোটি ডিম প্রয়োজন। দেশের বিভিন্ন স্থানে উৎপাদিত ডিম দেশের বড় বড় পাইকারি বাজারের মাধ্যমে ছড়িয়ে যায় সারা দেশে। বর্তমান পরিস্থিতিতে নতুন করে এ কৃত্রিম সংকট সৃষ্টির ফলে ডিমের দাম আরো বাড়তে পারে। এর আগে বিভিন্ন প্রতিবেদন থেকে দেখা গেছে, কীভাবে ঢাকাকেন্দ্রিক একটি গোষ্ঠী সিন্ডিকেট করে ডিমের দাম বাড়িয়ে দেয়। সিন্ডিকেটই ডিমের দাম নির্ধারণ করে। এসএমএসের মাধ্যমে সিন্ডিকেট চক্র এ দর নির্ধারণ করে। কিন্তু এর সুফল প্রান্তিক খামারিরা পান না; অন্যদিকে ক্রেতাদের বাড়তি দামে ডিম খেতে হয়। বাড়তি মুনাফায় পকেট ভারী হয় সিন্ডিকেটের।
এ তো গেল ডিমকাণ্ডের চিত্র। বাজারে প্রায় প্রতিটি নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বৃদ্ধির চিত্রও অনেকটা একই রকম। আগে আমরা দেখেছি, কীভাবে ১০ টাকায় উৎপাদিত সবজির বাজারমূল্য ১২০ টাকা হয়। অস্বাভাবিক পরিবহন ব্যয়, রাস্তায় চাঁদাবাজি, উৎপাদনকেন্দ্র থেকে বিক্রয়কেন্দ্র পর্যন্ত দফায় দফায় হাতবদল, আড়তদারি খরচসহ নানা ব্যয়ের কারণে সবজির দাম অস্বাভাবিক হারে বৃদ্ধি পায়। দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে ট্রাকে পণ্য পাইকারি বাজারে আসার পর ফড়িয়াদের মধ্যেই তিন-চারবার হাতবদল করে তা দু-তিনগুণ বাড়িয়ে দেওয়া হয়।
এখানেই প্রশ্ন আসে পণ্যমূল্য নির্ধারণের যৌক্তিকতার। একটি পণ্যের যৌক্তিক দাম নির্ধারণে সংশ্লিষ্ট সবাই স্টেকহোল্ডারদের বাজার পরিস্থিতি বিবেচনায় নৈতিক অবস্থানে থেকে যৌক্তিক দামের ওপর জোর দিতে হবে। এটি কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করার দায়িত্ব সরকারের। উৎপাদক থেকে ভোক্তা পর্যন্ত সরাসরি কীভাবে পণ্যদ্রব্য পৌঁছানো যায়, সে ব্যাপারে চিন্তাভাবনা করা উচিত। সরকারের নিয়ন্ত্রণ ও মনিটরিং ব্যবস্থার মধ্যে একটি পূর্ণাঙ্গ সাপ্লাই ডিস্ট্রিবিউশন চেইন থাকা উচিত, যেখানে ‘উৎপাদনকারী, পাইকারি বিক্রেতা, খুচরা বিক্রেতা, ভোক্তা’র শক্ত অবস্থানের বাইরে ফড়িয়াদের দৌরাত্ম্য থাকবে না। উৎপাদনকারী, পাইকার, পরিবহন ব্যবসায়ী, খুচরা বিক্রেতাদের মুনাফার হার যৌক্তিকভাবে নির্ধারণ করা উচিত, যেন কোনো অসাধু চক্র নানা অজুহাতে অধিক মুনাফা হাতিয়ে নিতে না পারে। রাজধানীসহ জেলা শহরগুলোয় এটি বাস্তবায়ন করা গেলে বাজার অনেকটা নিয়ন্ত্রণে আসতে পারে।
দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে রেখে মূল্যস্ফীতি কমাতে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে জনগণের প্রত্যাশা অনেক। সে প্রত্যাশার প্রতিফলন ঘটাতে সরকারকে আরো কঠোর অবস্থানে যাওয়া প্রয়োজন। বিভিন্ন সময়ে সরকারদলীয় ছত্রছায়ায় এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর যোগসাজশে পণ্য পরিবহনে এবং বাজারে চাঁদাবাজির প্রভাবে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্যবৃদ্ধির চিত্রও আমরা দেখেছি। বতর্মানে কারা এসব চাঁদাবাজি ও অসাধু কর্মকাণ্ড চালাচ্ছে, সেটি বের করতে নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করা প্রয়োজন। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কেউ কেউ এ কাজে জড়িত থাকলে তাদেরও যথাযথ শাস্তির আওতায় আনতে হবে।
বাজার ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণে প্রয়োজন সরকারের কঠোর পদক্ষেপ। বিভিন্ন সরকারি সংস্থার তৎপরতার ফলে বাজারে সাময়িকভাবে দ্রব্যমূল্য হয়তো কিছুটা কমে। কিন্তু অসাধু চক্র আবার সক্রিয় হয়ে ওঠে। হয়তো কিছু পরিমাণ টাকা জরিমানা দিয়েই পার পেয়ে যায় অনেক অসাধু ব্যবসায়ী। যে পরিমাণ জরিমানা করা হয়, সেটা দেখা যায় তাদের এক দিনের মুনাফার টাকা। ফলে ওই জরিমানা অসাধু ব্যবসায়ীদের গায়ে লাগে না। বাজারে অনিয়ম পেলে প্রয়োজনে জেল দেওয়া এবং ব্যবসা প্রতিষ্ঠান সিলগালা ও লাইসেন্স বাতিল করা প্রয়োজন। সরকার গঠিত টাস্কফোর্সের নিয়মিত মনিটরিংয়ের সুফল পেতে জেলা পর্যায়ে কার কাছে কী পরিমাণ পণ্য মজুদ রয়েছে, সে তথ্য সংগ্রহ করে ডিজিটাল ব্যবস্থায় নিয়ন্ত্রণ করা প্রয়োজন। এতে পণ্য মজুদ করে অতিমুনাফার প্রবণতা কমানো যেতে পারে।
পরিশেষে বলা যায়, আমাদের দেশের বাজারে অব্যবস্থাপনা অনেকদিন ধরেই চলে আসছে এবং সংকট অনেক গভীরে। বাজারে পণ্য সরবরাহ ঠিক ও দাম যৌক্তিক পর্যায়ে রাখার কার্যকর মেকানিজম বা কৌশল না থাকার সুযোগ লুফে নিয়ে একশ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী মুনাফা করে নিচ্ছে। এ সমস্যার স্থায়ী বা দীর্ঘমেয়াদি সমাধানে সংশ্লিষ্ট সবাইকে একসঙ্গে কাজ করা প্রয়োজন। বর্ষাকাল বা বন্যা পরিস্থিতিতে শাকসবজি ও ডিমের দাম কিছুটা বাড়তে পারে; কিন্তু সেটা যৌক্তিক পর্যায়ে থাকা প্রয়োজন। এখন যেভাবে বাড়ছে সেটা অবশ্যই কারসাজি। আর কারসাজির বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকারের কঠোর হওয়ার বিকল্প কী?
লেখক : চেয়ারম্যান, জাতীয় মানবাধিকার কমিশন।
"