নিজস্ব প্রতিবেদক
ভারতীয় এলওসি
প্রকল্প অসম্পূর্ণ, তবু দিতে হচ্ছে কিস্তি
২০১০ সালের মার্চে ভারতের সঙ্গে প্রথম লাইন অব ক্রেডিট (এলওসি) চুক্তির পর এ ঋণের অর্থছাড় হয়েছে প্রায় ৭৭০ মিলিয়ন ডলার। ১.৩৪ বিলিয়ন ডলার ঋণ প্যাকেজের এক-তৃতীয়াংশ এখনো ছাড় হয়নি। এর মধ্যেই ঋণের ৫ বছরের গ্রেস পিরিয়ড শেষ হয়েছে। বাংলাদেশকে দিতে হচ্ছে ঋণের কিস্তিও, যা ইতোমধ্যে শুরু করেছে। তবে প্রথম এলওসির ১৫ প্রকল্পের মধ্যে এখনো বাস্তবায়ন কাজই শেষ হয়নি দুটি প্রকল্পের। কবে নাগাদ বাকি অর্থ ছাড় হবে তা নিয়েও রয়েছে অশ্চিয়তা। অবশ্য প্রথম এলওসি ঋণ বাংলাদেশকে পরিশোধ করতে হবে ২০৩২ সালের ২৮ মার্চের মধ্যে।
জানা গেছে, প্রথম এলওসি চুক্তি অনুযায়ী, ৫ বছরের গ্রেস পিরিয়ডসহ এ ঋণ পরিশোধ করতে বাংলাদেশ সময় পাবে ২০ বছর। এ ঋণের প্রথম অর্থছাড় হয়- চুক্তি স্বাক্ষরের দুই বছর পর ২৯ মার্চ ২০১২ সালে। অর্থাৎ প্রথম এলওসি ঋণের ছাড় না হওয়া ৩৬৪ মিলিয়ন ডলার যদি আজকেও ছাড় হয়, তাহলেও এটি পরিশোধে বাংলাদেশ সময় পাবে মাত্র ৮ বছর। এভাবেই ভারতীয় তিনটি লাইন অব ক্রেডিটের পরিশোধের সময় কমে আসছে, যেসব ঋণের অধীনে রেল, সড়ক, বিদ্যুৎ, স্থলবন্দর অবকাঠামো ও সরকারি ক্রয়ের জন্য ৭.৩ বিলিয়ন ডলার ঋণ প্রদানের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে ভারত। এ পর্যন্ত তিনটি লাইন অব ক্রেডিট ঋণের অর্থছাড় হয়েছে মাত্র ১.৮ বিলিয়ন ডলার, মোট প্রতিশ্রুতির যা মাত্র এক-চতুর্থাংশ। ২০৩৯ সালের মে নাগাদ সর্বশেষ স্বাক্ষর হওয়া এলওসি পরিশোধ করতে হবে।
লাইন অব ক্রেডিট বা এলওসির অধীনে, ১ শতাংশ সুদ ও ০.৫ শতাংশ কমিটমেন্ট ফিতে এসব সফট লোন দেবে ভারত। কিন্তু তুলনা করলে দেখা যায়, জাপান ও কোরিয়ার সঙ্গে হওয়া এ ধরনের দ্বিপক্ষীয় সফট লোনের চুক্তির চেয়ে ভারতীয় ঋণের শর্তগুলো বেশ কঠিন। জাপান ও কোরিয়ার ঋণ পরিশোধের সময়সীমা ও গ্রেস পিরিয়ড বেশি থাকে বলে উল্লেখ করেন অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) কর্মকর্তারা। ইআরডির তথ্য বলছে, প্রথম এলওসির ৩৪৪ মিলিয়ন ও দ্বিতীয় এলওসির ১৯.২৩৫ মিলিয়ন ডলার এর মধ্যেই পরিশোধ করেছে সরকার এবং তৃতীয়টি পরিশোধ করা হচ্ছে। যদিও এক পর্যালোচনায় দেখা যায়, নানা জটিলতায় এসব এলওসির অধীন নেওয়া ৪০ প্রকল্পের মধ্যে ২৫টি বাস্তবায়ন কাজ শেষ হয়নি। এর মধ্যে আট প্রকল্পের প্রস্তাবই (ডিপিপি) তৈরি হয়নি। আবার বাস্তবায়ন পর্যায়ে যেসব প্রকল্প রয়েছে , তার বেশিরভাগই ঠিকাদার নিয়োগ প্রক্রিয়াই শেষ হয়নি। তাছাড়া দেরি হওয়ায় কিছু প্রকল্প এলওসি তালিকা থেকে বাদও দেওয়া হয়েছে।
সময়মতো শেষ হয়েছে শুধু বাস ও ট্রাক কেনার প্রকল্প। অন্য প্রকল্প বিশেষ করে অবকাঠামো প্রকল্পগুলোয় বিভিন্ন পর্যায়ে ভারতের এক্সিম ব্যাংকের সম্মতি নিতে হতে হয়। যে কারণে খুলনা থেকে দর্শনা রেললাইন নির্মাণ এবং আশুগঞ্জ অভ্যন্তরীণ কনটেইনার নদীবন্দর স্থাপনের মতো অবকাঠামো প্রকল্প বিলম্বিত হয়েছে। প্রকল্প সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, বেশ কয়েকটি কারণে এলওসি প্রকল্পগুলো নির্ধারিত সময়ে বাস্তবায়ন হয় না। এতে অর্থছাড়ও আটকে যাচ্ছে। তারা জানান, প্রকল্পের বিভিন্ন পর্যায়ে ভারতীয় কর্তৃপক্ষের সম্মতি আদায়ে সময়ক্ষেপণ এবং বাস্তবায়ন পর্যায়ে ভারতের নিয়োগকৃত ঠিকাদারের খামখেয়ালি বাস্তবায়ন বিলম্বের মূল কারণ। প্রস্তুতি ছাড়া প্রকল্প নেওয়ার কারণেও বেশকিছু প্রকল্পের বাস্তবায়ন বিলম্বিত হয়। আবার ভারতীয় এলওসিগুলোর শর্তানুযায়ী, দরপত্র প্রক্রিয়ায় শুধু ভারতীয় ঠিকাদাররাই অংশ দিতে পারে এবং প্রকল্পের ৭৫ শতাংশ পণ্য ভারত থেকে কেনার বাধ্যবাধকতা রয়েছে।
বাস্তবায়নের পর্যায়ে ভারতীয় ঠিকাদারদের দীর্ঘ অনুপস্থিতির কারণে বিলম্ব হয়, যার উদাহরণ হিসেবে কুলাউড়া-শাহবাজপুর রেললাইন নির্মাণ প্রকল্পের উদাহরণ দেন কর্মকর্তারা। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ও ভারতীয় হাইকমিশন থেকে কাজ শুরুর জন্য তাগাদা দিয়ে চিঠি দেওয়ার পর একপর্যায়ে ঠিকাদার ফিরে এলেও পুরোদমে কাজ না শুরু করায় বাস্তবায়নের অগ্রগতি হয়েছে সামান্যই। খুলনা-মোংলা রেললাইন নির্মাণ প্রকল্পও একই ধরনের একটি সমস্যার মুখে পড়েছে বলে জানান কর্মকর্তারা। বাংলাদেশের কিছু প্রকল্পের উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব (ডিপিপি) তৈরি করতে না পারাটাও বিলম্বের জন্য দায়ী। ভারতীয় ঋণের আট প্রকল্পে বাংলাদেশ এখনো প্রকল্প প্রস্তাব তৈরি করতে পারেনি, যেখানে ঋণ প্রতিশ্রুতি রয়েছে ১.১ বিলিয়ন ডলারের মধ্যে দ্বিতীয় এলওসির আওতায় নেওয়া হয় তিন প্রকল্প এবং তৃতীয় এলওসির অধীন প্রকল্পের সংখ্যা পাঁচটি। এছাড়া কয়েকটি প্রকল্পের ভূমি অধিগ্রহণে জটিলতা, ঘন ঘন প্রকল্প পরিচালক বদলির কারণেও চলমান অনেক প্রকল্পে অর্থছাড় বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এসব সমস্যা সমাধানে দুই দেশের শীর্ষ পর্যায়ে আলোচনা এবং ভারতীয় এলওসির অধীনে গুচ্ছ প্রকল্প বাস্তবায়নের চেয়ে একক প্রকল্প বাস্তবায়নে জোর দেওয়া দরকার বলে মত দেন বিশেষজ্ঞ ও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।
এলওসির আওতায় নেওয়া প্রকল্পগুলোর অবস্থা কী : ইআরডির তথ্যানুযায়ী, প্রথম এলওসির ১৫ প্রকল্পের মধ্যে এখনো বাস্তবায়ন কাজ শেষ হয়নি দুই প্রকল্পে। এতে করে ঢাকা-টঙ্গী সেকশন এবং টঙ্গী-জয়দেবপুর সেকশনে ডুয়েলগেজ ডাবল লাইন প্রকল্পের কাজ শেষ হবে হবে ২০২৭ সালের জুনে। ২০১২ সালে শুরু হওয়া এ প্রকল্পের জন্য ভারত ২০২৭ সালে যে অর্থছাড় করবে সেই ঋণ পরিশোধে বাংলাদেশ সময় পাবে মাত্র ৫ বছর এবং প্রকল্পে মেয়াদ যদি বাড়ানো হয়, তাহলে ঋণ পরিশোধের সময় আরো কমবে। একই অবস্থা কুলাউড়া থেকে শাহবাজ পর্যন্ত রেললাইন নির্মাণ প্রকল্পেও। একই অবস্থা হচ্ছে ২০১৬ সালের ৯ মার্চ সই হওয়া দ্বিতীয় এলওসির ক্ষেত্রেও। ২০ বছরের পরিশোধ সময়ের মধ্যে এরই মধ্যে ৫ বছর অতিবাহিত হলেও ৭৫ শতাংশ ঋণ ছাড়ই হয়নি। ২.০৮১ বিলিয়ন ডলারের মধ্যে এ পর্যন্ত অর্থছাড় হয়েছে মাত্র ৫২২.২০৭ মিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ ছাড় না হওয়া ১.৫৫৯ বিলিয়ন ডলার পরিশোধে বাংলাদেশ ১৫ বছরেরও কম সময় পাবে। এক্ষেত্রে যত দেরিতে ঋণ ছাড় হবে, তত পরিশোধের সময় কমবে।
দ্বিতীয় এলওসির আওতাধীন ১২ প্রকল্পের মধ্যে বাস ও ট্রাক ক্রয়সংক্রান্ত কেবল দুটি প্রকল্প বাস্তবায়ন শেষ হয়েছে। ৭টির কাজ বাস্তবায়ন পর্যায়ে, বাকি তিন প্রকল্পের প্রকল্প প্রস্তাব এখনো তৈরি হয়নি। তৃতীয় এলওসি ঋণের ৮৭ শতাংশ অর্থছাড় এখনো হয়নি। ২০১৯ সালের ২১ মে প্রথম অর্থছাড়ের পর এরই মধ্যে ঋণ পরিশোধের সময় ৫ বছর পার হয়ে গেছে। ৪,০৫৯.৭ মিলিয়ন ডলারের মধ্যে এই এলওসি ছাড় হয়েছে মাত্র ৫৩৩.৫৩৪ মিলিয়ন ডলার। এই এলওসির কোনো প্রকল্পের কাজই শেষ হয়নি। বাস্তবায়ন কাজ শুরু হয়েছে আট প্রকল্পের। যদিও এসব প্রকল্পের বেশিরভাগেরই এখনো নির্মাণ কাজ শুরু হয়নি এবং ঠিকাদার নিয়োগ পর্যায়ের মধ্যে আছে। পাঁচটি প্রকল্পের প্রকল্প প্রস্তাব এখনো তৈরি হয়নি।
দরকার শীর্ষ পর্যায়ে আলোচনা : বিদেশি ঋণের বিষয়ে আলোচনার জন্য সরকারের দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থা ইআরডি এসব সমস্যার সমাধান করে অর্থছাড়ে গতি এনে ভারতীয় এলওসির অর্থের সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করতে চাইছে। দ্বিপক্ষীয় আলোচনায় বাংলাদেশের কর্মকর্তারা বারবার তাদের ভারতীয় সমকক্ষদের সঙ্গে বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা করেছেন এবং এসব সমাধানের জন্য বেশ কয়েকটি প্রস্তাবও দিয়েছেন- যাতে করে ভারতীয় ঋণের মাধ্যমে বাস্তবায়িত প্রকল্পগুলো গতি পায়। এর মধ্যে একটি প্রস্তাব হচ্ছে, ঋণের আওতায় গুচ্ছ প্রকল্প না নিয়ে প্রতিটি প্রকল্পের জন্য আলাদা ঋণ চুক্তি করা। ইআরডির একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা এ প্রসঙ্গে বলেন, এটা তারা গ্রহণ করলে, প্রতিটি চুক্তির শর্ত হবে ভিন্ন; যা অর্থছাড়, ঋণের গ্রেড পিরিয়ড ও পরিশোধের সময় সংক্রান্ত সমস্যাগুলো কাটিয়ে ওঠার ক্ষেত্রে সহায়তা করবে। ভারতীয় ঋণের অর্থ ছাড়ের বিলম্বের জন্য ডলারভিত্তিক ঋণের সুদহারের ওঠানামাকেও একটি কারণ বলে মনে করেন আরেকজন কর্মকর্তা। যেমন বর্তমানে সিকিউরড ওভারনাইট ফাইন্যান্সিং রেট (সোফর) সুদহার হচ্ছে ৪.৪ শতাংশ, যেটা কিছুদিন আগেও ছিল ৫ শতাংশ। ভারত আমাদের ১ শতাংশ ডিসকাউন্ট রেটে ডলারে ঋণ দিচ্ছে। যদিও তাকে আরো বেশি রেটে ডলারের ব্যবস্থা করতে হচ্ছে।
বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) সাবেক মহাপরিচালক মুস্তফা কে মুজেরী বলেন, ভারতীয় এলওসি ঋণগুলোর বর্তমানে যে অবস্থা, তাতে অর্থ ছাড়ে আরো দেরীর সম্ভাবনা আছে, তাই এগুলো পরিশোধের সময় বাড়ানো অত্যাবশ্যক। নাহলে কার্যকরভাবে ভারতীয় ঋণের ব্যবহার নিশ্চিত করা চ্যালেঞ্জিং হয়ে উঠবে। ঋণের জটিলতাগুলো সমাধানে দুদেশের মধ্যে উচ্চপর্যায়ে আলোচনা অপরিহার্য বলে মতপ্রকাশ করেন তিনি। মুজেরী বলেন, ভারতীয় এলওসির প্রকল্পগুলোর বিষয়ে দুই দেশের মধ্যে বার্ষিক সভা হলেও অনেক বছর ধরে এসব সমস্যা রয়েই গেছে। তাই অর্থ ছাড়ের প্রক্রিয়া দ্রুততর করার স্বার্থে ফলপ্রসূ আলোচনার দরকার। তিনি সমস্যাগুলোকে পুনরায় চিহ্নিত করা এবং প্রয়োজন হলে ভারতীয় ঋণ চুক্তিগুলোর বিভিন্ন শর্ত সংশোধনের ওপরও গুরুত্ব দেন। মুজেরী বলেন, বিলম্বের কন্য দায়ী ভারতের কর্তৃপক্ষ ও ঠিকাদারদের অবশ্যই জবাবদিহির মুখোমুখি করতে হবে। এছাড়া এগুলো নিয়ে বাংলাদেশের মধ্যে থাকা যেকোনো সমস্যারও সমাধান করতে হবে।
"