নিজস্ব প্রতিবেদক
শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা
জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার আন্দোলনে গণহত্যার ঘটনায় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের বিচারকাজ শুরু হয়েছে। শুরুর দিনই সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরসহ ৪৫ জনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছেন ট্রাইব্যুনাল। ১৮ নভেম্বরের মধ্যে শেখ হাসিনাকে গ্রেপ্তার করে ট্রাইব্যুনালে হাজির করার জন্য নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। গতকাল বৃহস্পতিবার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান বিচারপতি মো. গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বে বিচারকাজ আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হয়।
এদিন অন্য আরো যাদের বিরুদ্ধে পরোয়ানা জারি করা হয়েছে তাদের মধ্যে রয়েছেন সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান, সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, সাবেক সমাজকল্যাণমন্ত্রী দীপু মনি, সাবেক তথ্য ও সম্প্রচার প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ আলী আরাফাত, সাবেক তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি (আইসিটি) প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক, সাবেক মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়, লেখক মুহম্মদ জাফর ইকবাল, ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা শাখার (ডিবি) অতিরিক্ত কমিশনার হারুন অর রশীদ প্রমুখ। পরোয়ানা জারির আবেদনের সময় আওয়ামী লীগ সরকারের আমল এবং জুলাই-আগস্টে তাদের ভূমিকা তুলে ধরা হয়।
এই অপরাধগুলো বিস্তৃত মাত্রায়, দেশজুড়ে সংঘটিত হয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম। তিনি বলেছেন, ‘আদালতের কাছে আবেদন জানিয়েছিলাম এই অপরাধের আসামি যারা, তারা অসম্ভব রকমের প্রভাবশালী, তাদের গ্রেপ্তার করা না হলে তদন্ত কার্যক্রম পরিচালনা করাটা অসম্ভব কঠিন। তাদের ভয়ে সাধারণ মানুষ, এমনকি শহীদ পরিবারের সদস্যরা কথা বলতে সাহসী হচ্ছেন না। সুষ্ঠু তদন্তের স্বার্থে আমরা গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির আবেদন জানিয়েছিলাম।’
দ্বিতীয় আরেকটি আবেদনে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের এবং মন্ত্রিপরিষদের সদস্যসহ ৪৫ জনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির আবেদন জানানো হয়েছে। সেটিও মঞ্জুর করেছেন ট্রাইব্যুনাল।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর বলেন, এই অপরাধীদের অনেকে এখনো রাষ্ট্রের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে রয়েছেন। সে কারণে তাদের সবার নামপ্রকাশ করা হচ্ছে না।
এর আগে বেলা সাড়ে ১১টায় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান বিচারপতি মো. গোলাম মর্তুজার নেতৃত্বাধীন বেঞ্চে শেখ হাসিনার শাসন আমলের সব হত্যা, গণহত্যা, বিচারবহির্ভূত হত্যা, পিলখানা হত্যার বর্ণনা আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে তুলে ধরেন চিফ প্রসিকিউটর মো. তাজুল ইসলাম। একই সঙ্গে শেখ হাসিনাসহ ৫০ জনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা চায় ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউশন টিম।
ট্রাইব্যুনালের সূচনা বক্তব্যে চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম বিডিআর বিদ্রোহে ৭৪ জনকে হত্যা, শাপলা চত্বরে হেফাজতের সমাবেশে ‘হত্যা’, র্যাবের বিচারবহির্ভূত হত্যা, জুলাই-আগস্ট ‘গণহত্যা’সহ আওয়ামী লীগের শাসনামলে ‘মানবতাবিরোধী অপরাধের’ সারসংক্ষেপ তুলে ধরেন। শেখ হাসিনাসহ অন্যদের দেশে ফিরিয়ে আনতে ইন্টারপোলের সহায়তা নেওয়ার কথাও তিনি বলেন।
আর গত ১৩ অক্টোবর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর অ্যাডভোকেট তাজুল ইসলাম শেখ হাসিনাসহ পলাতক অন্যদের দেশে ফিরিয়ে আনতে ইন্টারপোলের সহায়তা নেওয়ার কথা জানিয়েছিলেন।
প্রসিকিউটর সুলতান মাহমুদ পরে বলেন, ‘আজ (বৃহস্পতিবার) দুটো পিটিশন দাখিল করেছি আমরা। প্রথমটিতে শুধু শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির আবেদন এবং অন্যটিতে ওবায়দুল কাদেরসহ ৪৫ জনের বিরুদ্ধে। ট্রাইব্যুনাল আমাদের আবেদন মঞ্জুর করেছেন এবং ১৮ নভেম্বরের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলেছেন।
এর আগে মঙ্গলবার নিয়োগের পর প্রথম কর্মদিবসে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে আসেন ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান বিচারপতি গোলাম মর্তুজা মজুমদার। এছাড়া ট্রাইব্যুনালের দুই সদস্য বিচারপতি মো. শফিউল আলম মাহমুদ এবং অবসরপ্রাপ্ত জেলা ও দায়রা জজ মহিতুল হক এনাম চৌধুরী এদিন ট্রাইব্যুনালে আসেন। এ সময় ট্রাইব্যুনালের রেজিস্ট্রার ও অন্য কর্মকর্তারা তাদের অভ্যর্থনা জানান।
গত সোমবার রাতে হাইকোর্টের বিচারপতি গোলাম মর্তুজা মজুমদারকে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান করে প্রজ্ঞাপন জারি করে আইন মন্ত্রণালয়। ট্রাইব্যুনালের সদস্যরা হলেন বিচারপতি শফিউল আলম মাহমুদ ও বিচারক মো. মহিতুল হক এনাম চৌধুরী। এ সময় উপস্থিত ছিলেন চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম, প্রসিকিউটর গাজী মোনাওয়ার হুসাইন তামিম ও বি এম সুলতান মাহমুদ।
একাত্তরে যুদ্ধাপরাধের বিচারের জন্য ২০১০ সালে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুবনাল গঠন করেছিল আওয়ামী লীগ সরকার। এখন ছাত্র-জনতার আন্দোলনের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগ সরকারের চালানো দমনপীড়নকে ‘গণহত্যা’ বিবেচনা করে এ আদালতে বিচারের উদ্যোগ নিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। এর অংশ হিসেবে প্রসিকিউটরদের বদলে ফেলার পর গত সোমবার নতুন তিন বিচারককে দায়িত্ব দিয়ে ট্রাইব্যুনাল পুনর্গঠন করা হয়। বিচারের জন্য আইন সংশোধন ও ভবন মেরামতের কাজও চলমান। গণঅভ্যুত্থানের পর সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগ ও ১৪ দলের নেতা এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সাবেক শীর্ষ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে এখন পর্যন্ত গুম, হত্যা, গণহত্যাসহ ৬০টির বেশি অভিযোগ আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে জমা পড়েছে।
"