গাজী শাহনেওয়াজ

  ১৮ অক্টোবর, ২০২৪

খাদ্য সিন্ডিকেটের হোতা সাবেক সচিব ইসমাইল হোসেন

অভিযোগ অনেক শাস্তি শুধুই বদলি!

খাদ্য মন্ত্রণালয়ের কেনাকাটা থেকে শুরু করে পদোন্নতি-বদলি সবই হতো সাবেক সচিব ইসমাইল হোসেনের ইচ্ছা মতো। চাল-ধান ও গম সংগ্রহ থেকে বার্ষিক মোটা অঙ্কের বাণিজ্য এমনকি নিম্নমানের গম আমদানির ক্ষেত্রেও তার হাত ছিল। খাদ্য মন্ত্রণালয়ের কেনাকাটা থেকে শুরু করে পদোন্নতি-বদলি সবই হতো সাবেক সচিব ইসমাইল হোসেনের ইচ্ছামতো। তিনি বৈষম্যবিরোধী ছাত্রআন্দোলনের গুরুতরবিরোধী ছিলেন। মন্ত্রণালয়ের এক সভায় কর্মকর্তাদের সঙ্গে ছাত্রদের আন্দোলন নিয়েও করেছিলেন নেতিবাচক মন্তব্য। বলেছিলেন ‘এরা সব পাগল-ছাগল। এভাবে আন্দোলন করে সরকারের পতন ঘটানো যাবে না।’ এমন অনেক অভিযোগ উঠার পরও শাস্তি হিসেবে ইসমাইল হোসেনকে বদলি করা হয়েছে অন্য মন্ত্রণালয়ে। অথচ সাবেক আমলের অনেক সচিব চাকরিচ্যুত হয়েছেন।

এ বিষয়ে সাবেক মন্ত্রীর কাছাকাছি থাকা একজন কর্মকর্তা বলছেন, মন্ত্রী অভিভাবক ছিলেন নামমাত্র; মন্ত্রণালয়ের নাটাই ছিল সচিবের হাতে। ওনার পরামর্শের বাইরে কিছুই ঘটত না। এখন দেখছি সব দোষ মন্ত্রীর! সাবেক খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার খাটছেন জেল। সূত্র জানিয়েছে, ইসমাইল হোসেন সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ে বদলি হলেও দায়িত্বরত উপদেষ্টা তার যোগদানে আপত্তি জানিয়েছেন। ফলে নতুন মন্ত্রণালয়ে যোগদান করতে না পেরে বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের (ওএসডি) মতো এখন এক টেবিল থেকে অন্য টেবিলে ঘোরাফেরার মধ্যেই সময় কেটে যাচ্ছে এই সচিবের।

জানা গেছে, সাবেক খাদ্যমন্ত্রী ও সচিবের ক্যারিয়ার ও ক্যাশিয়ার ছিলেন খাদ্য মন্ত্রণালয়ের সরবরাহ-১ শাখার উপসচিব কুল প্রদীপ চাকমা। অভিযোগ রয়েছে, এই কর্মকর্তার সঙ্গে সচিবের পারিবারিক সম্পর্ক রয়েছে। দুর্নীতি-অনিয়মের ভাগ-বাঁটোয়ায় তিনি সহযোগী হিসেবে মন্ত্রী-সচিবের হয়ে কাজ করতেন। আর সরবরাহ-২ শাখার যুগ্মসচিব মো লুৎফর রহমান কুল প্রদীপের মাস্টারমাইন্ড হয়ে কাজ করেন। এছাড়া অভ্যন্তরীণ চাল-ধান ও গম সংগ্রহ থেকে বার্ষিক মোটা অফঙ্কর বাণিজ্য চলত যা ছিল ‘ওপেন সিক্রেট’। মন্ত্রণালয়ের মতো খাদ্য অধিদপ্তরের মন্ত্রী-সচিব সিন্ডিকেটের সদস্য ছিলেন পরিচালক প্রকিউরমেন্ট মনিরুজ্জামান। তার তত্ত্বাবধানে অভ্যন্তরীণ কেনাকাটায় দুর্নীতির মাধ্যমে হাতিয়ে নেওয়া অর্থও যেত মন্ত্রী-সচিবের পকেটে।

এদিকে, গত দুই বছরে চার হাজার কোটি টাকার গম রাশিয়া থেকে আমদানি করা হয়েছে, যার সবই নিম্নমানের এবং দামও বাজারমূল্য থেকে বেশি। সাবেক খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদারের ঘনিষ্ঠ কয়েকজন ব্যবসায়ীকে সুবিধা দিতে ২০২২ সাল থেকে এই ১১ লাখ টন গম আমদানি করা হয়। সাধন চন্দ্রের আগে খাদ্যমন্ত্রী ছিলেন কামরুল ইসলাম। ২০১৫ সালে কামরুল ইসলামের সময় ব্রাজিল থেকে পোকা খাওয়া ও নিম্নমানের গম আমদানি হয়েছিল। এ নিয়ে অনেক সমালোচনার পর সরকার ওই বছর গমের প্রোটিনের সর্বনিম্ন মান বা বিনির্দেশ সাড়ে ১১ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে সাড়ে ১২ শতাংশ করে। কিন্তু সাধন চন্দ্র মজুমদার খাদ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব নেওয়ার পর ২০২২ সালে আবারও ওই বিনির্দেশ কমিয়ে সাড়ে ১১ শতাংশ করা হয়। অর্থাৎ নিম্নমানের গম আমদানির সুবিধা করে দেওয়া হয়। মন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ দুই ব্যবসায়ীর স্বার্থে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় বলে অভিযোগ আছে। এ কাজেও মন্ত্রীর সহযোগী ছিলেন সচিব ইসমাইল হোসেন। এই উদ্দেশে বিতর্কিত রাশিয়ার রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত কোম্পানি প্রডিংটগের অর্থায়নে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের ১৭ জন কর্মকর্তা রাশিয়া ভ্রমণ করেন। রাশিয়া ভ্রমণের সরকারি আদেশে (জিও) এই সফরের উদ্দেশ্য হিসেবে খাদ্য নিরাপত্তাবিষয়ক সেমিনার ও কর্মশালার কথা বলা হয়েছে।

অভিযোগ রয়েছে, সাবেক সরকারের সর্বোচ্চ সুবিধাভোগী দুর্নীতিবাজ ও বিতর্কিত স্থানীয় সরকার বিভাগের সচিব আবু হেনা মোরশেদ জামানকে বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওএসডি) করা হয়েছে। সম্প্রতি এ বিষয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে প্রজ্ঞাপন জারি হয়। এছাড়া শিল্প মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব এস এম আলমকে ওএসডি করা হয়েছে। অথচ খাদ্যের সাবেক সচিব ইসমাইল হোসেনের মন্ত্রণালয় বদলে বিস্মিত ভুক্তভোগীরা। সাবেক মন্ত্রীকে নিয়ে নানা সমালোচনা হলেও ইসমাইল হোসেন ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকায় নানামুখী গুঞ্জন ছড়িয়েছে সচিবালয়ে।

অভিযোগের বিষয়ে সচিব ইসমাইল হোসেন বলেন, মন্ত্রণালয়ের নিয়ম ও সরকারের নির্দেশনার বাইরে আমি কোনো কাজ করিনি। বিদেশ থেকে গম কেনা থেকে শুরু করে অভ্যন্তরীণ ধান-চাল ও গম সংগ্রহ এবং নিয়োগ-বদলি সবই আপনার হাতে ছিল, এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এগুলো বানানো, কাল্পনিক। সচিব হিসেবে যতকুটু করার সেইটুকু করেছি, এই বাইরে আমার কোনো মন্তব্য নেই।

বিদেশ থেকে আমদানি করা পণ্য এবং অভ্যন্তরীণ কেনাকাটায় অনিয়ম দুটিই দুর্নীতি বলে মন্তব্য করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডিন এবং ক্রিমিনোলজি বিভাগের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. জিয়া রহমান। প্রতিদিনের সংবাদকে তিনি বলেন, যেকোনো পণ্য কেনার মাধ্যমে রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যবহার করে জনগণের অর্থের অপচয় করা হয়েছে। এ ধরনের দুর্নীতির বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হওয়া উচিত।

এ প্রসঙ্গে অন্তর্বর্তী সরকারকে উদ্দেশ্যে করে গণ অধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নুর প্রতিদিনের সংবাদকে বলেন, আমাদের বিনয়কে দুর্বলতা ভাববেন না। নতি স্বীকার মনে করবেন না। ছাত্র জনতার অভ্যুত্থানে যে সরকার আপনারা গঠন করেছেন জনগণের চাওয়াকে প্রাধান্য দিয়ে কাজ করবেন। যারা গণহত্যা চালিয়েছিলেন, আওয়ামী লীগের সহযোগী হিসেবে মাঠে ছিলেন এবং যারা সরকারের গন্ডির বাইরে গিয়ে সাবেক সরকারের পক্ষে কাজ করেছেন তাদেরও বিচার করতে হবে। দলবাজ কর্মকর্তাদের আমরা চিনি না। তাদের চিহ্নিতের কাজ চলছে। আশা করি অচিরেই সরকারের বোধদয় হবে এবং সাবেক সরকারের সহায়ক আমলাদের চাকরিচ্যুত করে প্রশাসনকে কলুষমুক্ত করবে।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close