মেহেদী হাসান
প্রকল্প শেষ হওয়ার আগেই মালামাল গায়েব
দেশের কৃষি মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ একটি সেবা সংস্থা ও বহু মাধ্যমভিত্তিক উন্নয়ন যোগাযোগ বিভাগ কৃষি তথ্য সার্ভিস। এ প্রতিষ্ঠানের সেবা বৃদ্ধির লক্ষ্যে ২০১৮ সালে ‘কৃষি তথ্য সার্ভিস আধুনিকায়ন এবং ডিজিটাল কৃষি তথ্য ও যোগাযোগ শক্তিশালীকরণ’ প্রকল্প হাতে নেয় পতিত আওয়ামী লীগ সরকার। প্রকল্পের আওতায় প্রায় ৫০ কোটি টাকায় কেনা হয় পুরোনো মরচেপড়া প্রেস যন্ত্রপাতি, অচল স্বল্পমেয়াদি পুরোনো কম্পিউটার, কপি সফটওয়্যারসহ নানা জিনিসপত্র। সরবরাহকারী প্যাড ভাড়া নিয়ে বিল পাস করে প্রকল্প পরিচালক তাপস কুমার ঘোষ মালামাল না কিনে করেছেন লুটপাট। এ লুটপাটের সহযোগিতায় ছিলেন কৃষি তথ্য সার্ভিসের পরিচালক ড. সুরজিত সাহা রায় এবং প্রধান তথ্য অফিসার বি এম রাশেদুল আলম। তবে শুধু লুটপাটেই ক্ষান্ত হননি দুর্নীতিবাজ এ কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। প্রকল্প শেষ হওয়ার আগেই প্রকল্প পরিচালক ও কৃষি তথ্য সার্ভিসের পরিচালক এবং প্রধান তথ্য অফিসারের যোগসাজশে গায়েব করে দেওয়া হয় কোটি কোটি টাকার মালামাল।
জানা গেছে, ২০২৩ সালের জুনে শেষ হওয়া এ প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয় ১০৯ কোটি ৯১ লাখ টাকা। প্রকল্পের প্রায় ৩০ শতাংশের বেশি টাকায় কেনা হয় আধুনিকায়ন যন্ত্রপাতি। ১২ জেলায় প্রকল্পের মেয়াদ ছিল ২০২৩ সালের জুন পর্যন্ত। প্রকল্পের আওতায় প্রথম ধাপে আটটি আঞ্চলিক অফিস ভবন নির্মাণের পর সেগুলোয় ঢাকা থেকে মালামাল পাঠানো হয়। প্রকল্পের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ টাকায় মালামাল কেনা হয় প্রকল্প সদর দপ্তর ঢাকায়। অনুসন্ধানে জানা গেছে, ২০২৩ সালের ২২ জুন প্রকল্প পরিচালক তাপস কুমার ঘোষ প্রকল্পের আওতায় প্রকল্প সদর দপ্তরে (খামারবাড়ি, ঢাকা) ক্রয়কৃত মালামাল গ্রহণের জন্য চিঠি পাঠায় কৃষি তথ্য সার্ভিসের তৎকালীন পরিচালক সুরজিত সাহা রায়ের কাছে। এরপর ২৬ জুন মেইন স্টোর কিপার প্রশাসনকে মালামাল গ্রহণ করার নির্দেশ দেন সুরজিত সাহা। কৃষি তথ্য সার্ভিসের রাজস্ব খাতে মালামাল হস্তান্তরের ওই চিঠিতে বেরিয়ে আসে মালামাল গায়েবের তথ্য।
প্রধান তথ্য অফিসার বি এম রাশেদুল আলম স্বাক্ষরিত মালামাল গ্রহণের ওই চিঠিতে দেখা যায়, ৩৭ ধরনের মালামাল জমা দেন প্রকল্প পরিচালক তাপস কুমার। মালামালের বেশিরভাগই মেরামত অযোগ্য অকেজো। জমা তালিকায় নেই ২৯ কোটি টাকায় কেনা চার কালার অফসেট প্রিন্টিং মেশিন ২টি (মডেল নং রাপিডা ৭৬-৪ এফএপিসি, ব্যান্ড কোয়িং অ্যান্ড বাউয়ার কেএবি, ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন, সিটিপি মেশিন ১টি, পাইল টার্নার মেশিন ১টি, অটো ফোল্ডিং মেশিন ১টি, গ্যাদারিং মেশিন ১টি, ওয়ার স্পাইরাল বাইন্ডিং মেশিন ১টি অটো গ্লু বাইন্ডিং মেশিন ১টি কোল্ড গ্লু ফিল্ম লেমিনেটিং মেশিন ১টি ডাবল হেড স্ট্রিচিং মেশিন ১টি, ডাই কাটিং মেশিন (২০ী৩০ ইঞ্চি) ১টি, হট স্টেম্পিং মেশিন (২০ী৩০ ইঞ্চি) ১টি, ১টি ইউভি স্পট মেশিনসহ ১৩ ধরনের প্রেসসামগ্রী।
সূত্র জানায়, নিয়মানুসারে কৃষি তথ্য সার্ভিসের সব স্থায়ী মালামাল স্টোর কিপারের (প্রশাসন মেইন স্টোর) কাছে জমা হওয়ার কথা। কিন্তু ২৯ কোটি টাকার প্রেসের এসব যন্ত্রপাতি প্রশাসন মেইন স্টোরের কাছে জমা দেওয়ার কথা থাকলেও তা জানতেই পারেননি। অথচ উল্টো গোপনে সুকৌশলে ঘুষ লেনদেনের মাধ্যমে প্রেস শাখার স্টোর কিপার ইসরাত জামান খান মালামাল গ্রহণ করে। এ বিষয়ে ইসরাত জামান খানকে প্রশ্ন করলে কোনো উত্তর দিতে পারেননি। তড়িঘড়ি করে কৃষি তথ্য সার্ভিসের বর্তমান পরিচালককে ফোন ধরিয়ে দেন। পরে ৩ ঘণ্টা অপেক্ষা করেও দেখা মেলেনি ইসরাতের।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা জানান, জমা তালিকায় মালামাল না থাকা মানে সরকারি খাতায় তা গায়েব করা। যেসব মালামাল জমা দেওয়া হয়েছে তার চেয়ে অনেক বেশি মালামাল কেনা হয়েছে। প্রকল্প শেষ হওয়ার আগেই মালামাল ভাগ-বাঁটোয়ারা করে নিয়েছেন প্রকল্প পরিচালক তাপস কুমার। ভালো জিনিস গায়েব করে দিয়ে খারাপ-অচল মালামাল পুরোনো মার্কেট থেকে কিনে স্টোরে জমা দেন। ২০ হাজার টাকা দামের ল্যাপটপ কিনে বিল করা হয় লাখ টাকার টাকার ওপরে। যে ল্যাপটপ কেনা হয়েছে তা ৬ মাস চলেনি। মাত্র ৬টি প্রিন্টার স্টোরে জমা দেওয়ার তথ্য দিয়েছে কিন্তু সবই নষ্ট। অথচ মেরামতযোগ্য দেখানো হয়েছে ৪টি, সেগুলোও অচল। সব ভিডিও এবং স্টিল ক্যামেরায় কেনা হয় পুরোনো। এছাড়া সাউন্ড সিস্টেম, এসি কেনায় করা হয় সীমাহীন দুর্নীতি। প্রকল্পের টাকা ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে পরিশোধ করলেও সাড়ে ৩ লাখ কল সেন্টারের স্টিকার, ১ হাজার ৩০০ প্রশিক্ষণ ব্যাগ, প্রায় ২০০ উন্নতমানের চেয়ার, ৬২ হাজারের বেশি পোস্টার, এয়ার কন্ডিশনার, ল্যাপটপসহ প্রায় ৫ কোটি টাকার মালামালের কোনো খোঁজ নেই।
সূত্র এবং তালিকা ধরে অনুসন্ধান করে জানা যায়, তালিকায় থাকা ৫টি ল্যাপটপের ৪টিই ডেল ভোস্ট্রো কোম্পানির পি৭৫জি, পি৮৮জি, পি১২৯জি মডেলের। অনলাইনে অন্তত ৫টি কোম্পানির সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এ মডেলের ল্যাপটপের সর্বোচ্চ দাম ২৫ হাজার টাকা। অথচ এসব ল্যাপটপের দাম ধরা হয়েছে লাখ টাকার কাছাকাছি। মালামালের বিবরণীতে ১টি কিউস্ক, ৬টি প্রিন্টার (কালার ইনজেক্ট), এসি ৪টি, ২১টি চেয়ার, ৩টি টেবিল, ফাইল কেবিনেট ৬টি, ফটোকপিয়ার ২টি, ডেক্সটপ কম্পিউটার ৫টি যার সবই নষ্ট (যদিও তালিকায় মাত্র ২টি মেরামতযোগ্য চিহ্নিত)।
কৃষি তথ্য সার্ভিসের এক কর্মকর্তা জানান, ৫টি ডেক্সটপ কেনায় খরচ হয়েছে ৪৫ হাজার টাকার কিছু বেশি। বিল ধরা হয়েছে সাড়ে ৪ লাখ টাকার ওপরে। এসব কম্পিউটার কেনা হয়েছে এলিফ্যান্ট রোডের পুরোনো মার্কেট থেকে। যার ওপরে চকচকে কিন্তু ভেতরে সব পুরোনো যন্ত্রাংশ। ৬ মাস যেতে না যেতেই একবারে অচল হয়ে গেছে। ৯ হাজার ডিভিডির বিল করেছে প্রকল্প পরিচালক অথচ আধুনিকায়ন প্রকল্পে ২০ বছর আগের ডিভিডি সিস্টেমের তেমন প্রয়োজন নেই। আধুনিকায়ন প্রকল্পে কোনো কিছু আধুনিক হয়নি। প্রকল্প পরিচালক তাপস ও কৃষি তথ্য সার্ভিসের পরিচালক এবং প্রধান তথ্য অফিসার রাশেদুল আলমের যোগসাজশে কর্মকর্তা-কর্মচারীরা মিলে জনগণের টাকা লুট করেছে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, প্রকল্পের গাড়ি কেনায় করা হয় দুর্নীতি। এর পেছনেও রয়েছে তৎকালীন মনিটরিং অফিসার তাপস কুমারের হাত। একটি মিনি বাস, একটা মিনি ট্রাক ও টয়োটা এল-২০০ মডেলের একটি পিকআপ কেনা হয়। উদ্বোধনের দিনেই অচল হয়ে যায় নতুন দেখানো মিনি বাস এবং মিনি ট্রাক। সূত্র বলছে, এসব গাড়ি কেনায় করা সীমাহীন দুর্নীতি। পুরোনো গাড়ি রং করে নতুন হিসেবে চালিয়ে দেয় প্রকল্প পরিচালক। এমনকি নিয়মানুসারে প্রকল্প শেষে সরকারের পরিবহন পুলে গাড়ি জমা দেওয়ার কথা থাকলেও তা দেয়নি এ প্রকল্প পরিচালক। এছাড়া ২০২৩ সালের ৩০ জুন শেষ হওয়া প্রকল্পের অন্য কোডের ৩২৫৫১০৫ অন্যান্য মনিহারি ১২ লাখ, ৩২৫৬১০৩ কোডে ব্যবহার্য সামগ্রী ২০ লাখ, ৩২৫৮১০১ কোডে মোটরযান মেরামত ১০ লাখ, ৩২৫৮১০৩ কোডে কম্পিউটার মেরামত ২০ লাখ, ৪১১২২০২ কোডে কম্পিউটার ও আনুষঙ্গিক ২০ লাখ, ৪১১২৩০২ কোডে ক্যামেরা ও আনুষঙ্গিক ২০ লাখ, ৪১১২৩০৩ কোডে বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম ১ কোটি ৪৪ লাখ, ৪১১২৩১০ কোডে অফিস সরঞ্জাম ৪২ লাখ, ৪১১২৩১৪ কোডে আসবাবপত্র ৩০ লাখ টাকা অধিকাংশ টাকাই কৃষি তথ্য সার্ভিসের পরিচালক এবং প্রধান তথ্য অফিসার কৃষি মন্ত্রণালয়কে ম্যানেজ করে আত্মসাৎ করেন তাপস কুমার ঘোষ।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, তাপস কুমারের অনিয়ম-দুর্নীতির পেছনে কৃষি মন্ত্রণালয়ের বেশ কয়েকজন আওয়ামীপন্থি কৃষি ক্যাডারের সম্পর্ক রয়েছে। এছাড়া তাপসের শ্বশুর আওয়ামীপন্থি রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে স্বৈরাচার শেখ হাসিনার পতন হলে সুকৌশলে সেইফ জোনে চলে যান তাপস কুমার। টাঙ্গাইল ও ঢাকায় নামে-বেনামে রয়েছে বেশ কয়েকটি ফ্লাট ও জমি। আত্মীয়স্বজনের নামে খোলা ব্যাংক অ্যাকাউন্টে রেখেছেন নিজের অবৈধ অর্থ।
প্রকল্প সমাপ্তির মালামাল স্টোরে জমা আছে কি না- জানতে চাইলে মেইন স্টোর কিপার প্রশাসন প্রতিদিনের সংবাদকে বলেন, ২৯ কোটি টাকার মালামালের তথ্য আমার কাছে আসেনি। ৩৭ ধরনের জিনিসের তথ্য জমা নিয়েছি। আমার কাছে স্টোরে জমার সব কাগজ আসে না। কীভাবে জমা হয়, জানি না। আমি ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার অনুমতি ছাড়া আপনার সঙ্গে কথা বলতে পারব না।
দুর্নীতি-অনিয়ম নিয়ে সাবেক প্রকল্প পরিচালক তাপস কুমার ঘোষের মোবাইল ফোনে একাধিকবার ফোন করা হলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি। এর আগে তিনি বলেন, প্রকল্পে কোনো অনিয়ম করা হয়নি। মালামাল জমা কমিটিতে অন্য কর্মকর্তারাও ছিলেন। আমি আপনার সঙ্গে এ বিষয়ে কথা বলব না।
জানতে চাইলে কৃষি তথ্য সার্ভিসের প্রধান তথ্য অফিসার বি এম রাশেদুল আলম প্রতিদিনের সংবাদকে বলেন, আমি দুর্নীতি অনিয়ম নিয়ে কিছুই জানি না। আমি প্রকল্পের অনিয়ম-দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত নই। আমার কাছে কাগজ এলে ঠিক আছে কিনা দেখে শুধু সই করি। আপনি চা খেয়ে যাবেন প্লিজ।
এমন দুর্নীতি-অনিয়মের ধারা বন্ধ হবে কি না- জানতে চাইলে সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার প্রতিদিনের সংবাদকে বলেন, অনেক প্রকল্পে ব্যাপক অনিয়ম-দুর্নীতি হয়েছে। এসব দুর্নীতি-অনিয়ম রোধ করতে সুষ্ঠু তদন্ত হওয়া প্রয়োজন। তদন্তের মাধ্যমে দোষীদের বিচারের আওতায় আনতে পারলে দুর্নীতি আর লুটপাট অনেকটাই কমে আসবে বলে মনে করি। এদের শাস্তির আওতায় আনতে হবে।
"