গাজী শাহনেওয়াজ
তদবিরবাজমুক্ত হচ্ছে সচিবালয়
দেশের প্রশাসনিক সদর দপ্তর বা সরকারি কর্মকাণ্ডের নিয়ন্ত্রণকেন্দ্র হচ্ছে সচিবালয়। স্পর্শকাতর হওয়া সত্ত্বেও সেই বাংলাদেশ সচিবালয়কে তদবির-বাণিজ্যের মহাকেন্দ্র বানিয়ে সেখানে দাপিয়ে বেড়িয়েছেন রাজনৈতিক ধ্বজাধারীরা; যখন-তখন ঢুকে গেছেন তদবিরবাজরা। তবে সচিবালয়কে তদবিরবাজমুক্ত করতে খড়্্গহস্ত হচ্ছে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার। বিগত সরকারের সময়ে রাজনৈতিক বিবেচনায় যেসব পাস দেওয়া হয়েছে, সেগুলো বাতিল করা হচ্ছে।
অভিযোগ উঠেছে, সচিবালয়ে রাজনৈতিক বিবেচনায় দলীয় ব্যক্তিদের পাস দিয়ে তদবির-বাণিজ্যের মহোৎসব তৈরির ক্ষেত্র তৈরি করে দিয়েছিলেন সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল। এসব ব্যক্তি টেন্ডারবাজি থেকে বদলি-পদোন্নতি সবই করতেন। তথ্যসূত্র বলছে, এ পাস নিয়ে তদবির করাই ছিল তাদের প্রধান কাজ। বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে বিভিন্ন স্তরের দলীয় রাজনৈতিক নেতার নামে প্রায় হাজারখানেক পাস ইস্যু করা হয়েছে। তাদের অনেকের রাজনৈতিক প্রভাবে অস্থির থাকতেন মন্ত্রী, সচিব থেকে শুরু করে গুরুত্বপূর্ণ ডেস্কের আমলারা। তদবির না শুনলেই ডেস্ক পরিবর্তন হয়ে যেত অনেক কর্মকর্তার।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, প্রশাসনের কেন্দ্রবিন্দু বাংলাদেশ সচিবালয়ে প্রবেশের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক বিবেচনায় ইস্যু করা পাসগুলো বাতিল করার বিষয়ে নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়েছে। প্রাথমিকভাবে ৫০০ পাস বাতিল হতে পারে। এর বাইরে আরো কারা ক্ষমতার অপব্যবহার করে পাস নিয়েছিলেন, তাদের চিহ্নিত করার কাজও অব্যাহত রেখেছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিবালয়ের নিরাপত্তা শাখা। সূত্র জানায়, যাদের পাস বাতিল হচ্ছে, তারা বেশিরভাগই আওয়ামী শাসনামলে বিভিন্ন পদবির নেতাকর্মী ছিলেন। ছাত্রলীগের শীর্ষ নেতাকর্মী থেকে শুরু করে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগের বিভিন্ন ইউনিটের নেতাকর্মীর নামও রয়েছে এ তালিকায়। আওয়ামী লীগ ও তাদের ছাত্র সংগঠনের নেতাকর্মীরা ঠিকাদারি ক্যাটাগরিতেও এতদিন পাস নিয়ে সচিবালয়ে প্রবেশ করেছেন।
জানা গেছে, চলতি সপ্তাহেই এসব পাস বাদ দেওয়া হচ্ছে। একইসঙ্গে কালো তালিকাভুক্ত করার উদ্যোগও নেওয়া হচ্ছে তাদের। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর কড়াকড়ি তৈরি হয়েছে সচিবালয়ে প্রবেশের ক্ষেত্রে। সাধারণত সচিবালয়ে যুগ্ম সচিব থেকে ততোর্ধ্ব কর্মকর্তারা দৈনিক ৫টি পাস ইস্যু করতে পারতেন। তবে এখন অবৈধ প্রবেশকারী, তদবিরবাজ ও অপ্রয়োজনীয় আগন্তুক ঠেকাতে কর্মকর্তাদের পাস ইস্যু করা বন্ধ রাখা হয়।
কয়েকজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর আমরা সচিবালয়ে প্রবেশে কাউকে পাস দিতে পারছি না। কী কারণে, কেন বন্ধ রাখা হয়েছে, জানি না। এখন কেন্দ্রীয়ভাবে অর্থাৎ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের সচিবালয় নিরাপত্তা শাখা এককভাবে এটি নিয়ন্ত্রণ করছে। কোনো কর্মকর্তার একান্ত পরিচিত কিংবা রাজনৈতিক পরিচয়ধারী কেউ প্রবেশ করতে চাইলে তাকে যেকোনো কর্মকর্তা ওই শাখাকে অনুরোধ জানালে প্রাধিকার অনুযায়ী বর্তমান পাস মিলছে।
জননিরাপত্তা বিভাগের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, পাসের জন্য প্রচুর আবেদন বা অনুরোধ পাচ্ছি। কিন্তু গুরুত্ব বিবেচনায় পাস দেওয়া হচ্ছে। আরেকজন বলেন, শাখাটি খুবই ঝামেলার, তাই দায়িত্ব ছেড়ে দিয়েছি। দর্শনার্থী, ভুক্তভোগী, দালাল ও তদবিরবাজসহ অবৈধভাবে বিভিন্ন লোকের প্রবেশের ফলে সচিবালয়ে নিরাপত্তা নিয়ে অতীতেও প্রশ্ন উঠেছে, এখনো উঠছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, করোনার সময় সচিবালয়ে দর্শনার্থী প্রবেশে কড়াকড়ি আরোপ করা হয়। কিন্তু তদবিরবাজদের তখনো আটকানো যেত না। পুলিশকে ম্যানেজ করে তারা ঠিকই ভেতরে ঢুকে পড়তেন। এখনো অনেক আগন্তুক নিরাপত্তারক্ষীদের ম্যানেজ করে ভেতরে প্রবেশ করছেন বলেও অভিযোগ পাওয়া গেছে।
এছাড়া অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর দুই মাসের বেশি সময় পেরিয়ে যাওয়ায় পরিবেশ-পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হওয়ার পথে। ফলে তদবরিবাজরা আবার সক্রিয় হয়ে উঠেছে। পুরোনো রাজনৈতিক পাস দেখিয়ে তারা ঠিকই তাদের দলীয় মানসিকতার অফিসারদের কাছে পৌঁছে যাচ্ছেন। অর্থাৎ ঢালাও পাস বন্ধ করার পরও মতলববাজ কর্মকর্তাদের আটকানো যাচ্ছে না। এতে উদ্বেগ দেওখা দেওয়ায় পাস ইস্যুর নথি অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসে আওয়ামী লীগ সরকারের রেখে যাওয়া রাজনৈতিক বিবেচনায় পাস ইস্যুর বিষয়টি। পরে আলোচনা করে রাজনৈতিক বিবেচনায় পাস ইস্যু বাতিল করার সিদ্ধান্ত হয়েছে।
জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞ ও সাবেক অতিরিক্ত সচিব ফিরোজ মিয়া প্রতিদিনের সংবাদকে বলেন, রাজনৈতিক বিবেচনায় পাস ইস্যু প্রথা বিলুপ্ত হওয়া জরুরি। যে কেউ রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তার করে সচিবালয়ের মতো স্পর্শকাতর জায়গায় পাস নিয়ে তদবির-টেন্ডারবাজিতে নেমে পড়েন। বদলি-পদোন্নতির তদবির নিয়ে আমলাদের টেবিলের সামনে বসে থাকেন। আমলারা অস্বস্তিবোধ করলেও চাকরি ও বদলির ভয়ে নীরব থাকেন।
বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার যে সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছেন, তা ইতিবাচক। এটা বাতিল হওয়ায় বাঞ্ছনীয়। তবে প্রকৃত প্রয়োজন যাদের রয়েছে, তারা যাতে পাস ইস্যুতে হয়রানির শিকার না হন, সেটিও খুবই গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করতে হবে।
পুলিশের একজন পুলিশ কর্মকর্তা সরকারের এ উদ্যোগকে সাধুবাদ জানান। তিনি বলেন, গেটে যারা দায়িত্ব পালন করছেন, তাদের এখন কাজের চাপ কম। অবৈধভাবে প্রবেশ করে যারা বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তার কাছে তদবির নিয়ে যাচ্ছেন, তাদের চিহ্নিত করে শাস্তির আওতায় আনতে হবে।
"