নিজস্ব প্রতিবেদক

  ০৮ অক্টোবর, ২০২৪

দাম নিয়ন্ত্রণে আমদানি শুল্ক কমানোর চিন্তা

সরবরাহের সংকট না থাকলেও বাড়ছে চালের দাম। গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর থেকে কেজিপ্রতি চালের দাম ৪-৮ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে বলে পাইকারি ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন। ভোক্তা অধিকার সংগঠন বলছে, বাজারে সরকারের নজরদারি কম থাকায় ব্যবসায়ীরা সুযোগ নিচ্ছেন। এ অবস্থায় চালের ওপর আমদানি শুল্ক কমানোর উদ্যোগ নেওয়ার চিন্তাভাবনা করছে অর্থ, বাণিজ্য ও খাদ্য মন্ত্রণালয়। সাম্প্রতিক বন্যায় ধান চাষ মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় এ সিদ্ধান্তের বিষয়ে ভাবা হচ্ছে।

অর্থ মন্ত্রণালয় বলছে, চট্টগ্রাম, ফেনী, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর ও কুমিল্লাসহ প্রধান কৃষি এলাকা প্লাবিত হয়েছে। বর্তমানে রংপুর, শেরপুর, লালমনিরহাট, নেত্রকোনা ও ময়মনসিংহ বন্যার কবলে পড়েছে। এই অঞ্চলগুলো দেশের ধান উৎপাদনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। ফলে স্থানীয় বাজারে চালের দাম উল্লেখযোগ্য হারে বেড়ে যাওয়ায় ভোক্তারা সংকটে পড়েছেন।

বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, সম্প্রতি বিভিন্ন ধরনের চালের দাম বেড়েছে ৮-১০ শতাংশ।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক অর্থ মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা বলেন, এ অবস্থায় সরকারের লক্ষ্য চাল আমদানি করে দাম নিয়ন্ত্রণ ও বাজার স্থিতিশীল করা। চালের ওপর আমদানি শুল্ক কমানোর উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। বর্তমানে চাল আমদানিতে ৬২ দশমিক ৫০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করা হয়। এই শুল্ক ৫ শতাংশে নামিয়ে আনতে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআর) অনুরোধ জানিয়েছে খাদ্য মন্ত্রণালয়। গত ২৯ সেপ্টেম্বর যুগ্মসচিব লুৎফর রহমান এনবিআরকে এ-সংক্রান্ত একটি চিঠি পাঠান।

উন্নত ব্যবস্থাপনা এবং নিরাপদ ও পুষ্টিকর খাদ্য সরবরাহের মাধ্যমে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে খাদ্য মন্ত্রণালয় কাজ করছে বলে চিঠিতে উল্লেখ করা হয়। খাদ্য নিরাপত্তা ও কৃষকদের প্রণোদনা দিতে চলতি বোরো মৌসুমে ৫ লাখ টন ধান ও ১ কোটি ৪৭ লাখ টন চাল সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। ৩১ আগস্ট পর্যন্ত সংগ্রহ হয়েছে ২ লাখ ৯৬ হাজার ৯৭০ টন ধান ও ১২ লাখ ৫৫ হাজার ৪৯৭ টন চাল। বর্তমানে সরকারি গুদামে ১২ লাখ ৬৪ হাজার ৭৪০ টন চাল ও ৪ লাখ ৬৩ হাজার ৯২৮ টন গম মজুদ রয়েছে।

পুরান ঢাকার বাবুবাজারের মেসার্স মা-বাবার দোয়া রাইস এজেন্সির মালিক মনির হোসেন জমাদার বলেন, জুলাইয়ের শেষ দিকে পাইকারিতে প্রতি কেজি মিনিকেট চালের দাম ছিল ৫৮-৬৬ টাকা। বর্তমানে তা ৬৩-৭০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। তখনকার ৫৮-৫৯ টাকা কেজির নাজিরশাইল চাল এখন ৬৪-৭৮ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এ ছাড়া ৫১-৫২ টাকার মাঝারি মানের চালের দাম এখন ৫৭-৬০ টাকা কেজি।

খিলগাঁও কাঁচাবাজারের খুচরা চাল ব্যবসায়ী কালাম রাইস স্টোরের মালিক কালাম ব্যাপারী বলেন, মাস দু-এক আগেই প্রতি কেজি মিনিকেট চালের দাম ছিল ৬৮-৭০ টাকা। বর্তমানে তা ৭২-৭৫ টাকায় বিক্রি করছেন। ৭৩-৭৫ টাকার নাজিরশাইল এখন বিক্রি করছেন ৮০ টাকায়। ৫৭-৫৮ টাকার বিআর-২৮ ও বিআর-২৯ চাল এখন ৬২ টাকায় বিক্রি করছেন।

রাজধানীর কারওয়ান বাজারের কিচেন মার্কেটের চাল ব্যবসায়ী জসিম উদ্দিন বলেন, সাম্প্রতিক বন্যার সময় ত্রাণ দেওয়ায় মাঝারি মানের চালের দাম বাড়ে। এরপর আর কমেনি। মিলাররা চালের দাম বাড়ানোর চেষ্টায় আছেন। পরিস্থিতি বুঝে তারা দাম বাড়িয়ে দেবেন।

চালের দাম বাড়ার বিষয়ে পাইকারি ব্যবসায়ীরা বলছেন, দেশের কয়েকটি জেলায় ত্রাণের জন্য চাল কেনা বেড়ে যাওয়ায় মাঝারি মানের চালের চাহিদা অনেক বেড়ে গিয়েছিল। এ কারণে ওই ধরনের চালের দাম অনেকটাই বেড়েছে। সেই প্রবণতা অনুসরণ করে অন্যান্য চালের দামও বেড়েছে।

নওগাঁ জেলা ধান-চাল আড়তদার সমিতির সভাপতি নীরদ বরণ সাহা বলেন, গত এক সপ্তাহের ব্যবধানে তাদের পাইকারি বাজারে মাঝারি মানের চালের দাম কেজিপ্রতি ৪ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। তবে অন্যান্য চালের দাম অপরিবর্তিত রয়েছে। আগে মাঝারি মানের প্রতি কেজি চালের দাম ছিল ৫২-৫৪ টাকা। বর্তমানে তা ৫৬-৫৮ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।

নীরদ সাহা বলেন, দেশের কোথাও ধান-চালের সংকট নেই। আগামী আমন মৌসুমের ধান ওঠা পর্যন্ত সংকট হওয়ার কোনো সম্ভাবনাও নেই। আমন মৌসুমের ধানের জন্য বৃষ্টির চাহিদা ছিল, সেটিও পূরণ হয়ে গেছে।

চালের দাম বাড়ার বিষয়ে ভোক্তা অধিকার সংগঠন কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সহসভাপতি এস এম নাজের হোসাইন বাজারে সরকারের নজরদারির অভাবের কথা বললেন। তিনি বলেন, ‘ব্যবসায়ীরা এখন মনে করছেন, বাজারে সরকারের কিছু করার নেই। এ কারণে তারা ইচ্ছেমতো দাম বাড়াচ্ছেন। কারণ, সরকার পরিবর্তন হলেও সিদ্ধান্ত নেওয়ার কর্তাব্যক্তিরা অনেকে এখনো বহাল আছেন। এ কারণে ব্যবসায়ীরাও কাউকে ভয় পাচ্ছেন না।

খাদ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, ২৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সরকারি গুদামে চালের মজুদ ছিল ১৩ লাখ ৭ হাজার ২৫৭ টন। মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালের ১ জুলাই থেকে ২৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে বিদেশ থেকে আদৌ চাল আমদানি করতে হয়নি। তবে বন্যার পর উৎপাদন, পাইকারি ও খুচরাপর্যায়ে চালের দাম ব্যাপক হারে বেড়েছে। এ কারণে খাদ্য মন্ত্রণালয়, খাদ্য অধিদপ্তর, জাতীয় ভোক্তা অধিকার অধিদপ্তর এবং স্থানীয় প্রশাসন দাম নিয়ন্ত্রণে বাজার নজরদারি বাড়িয়েছে। সুষ্ঠু বাজার পর্যবেক্ষণের পাশাপাশি অবৈধ মজুদের বিরুদ্ধে অভিযান চলছে। এর পরও খাদ্যশস্যের দাম বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে।

খাদ্য মন্ত্রণালয় আরো জানায়, সম্প্রতি ১৪টি জেলায় বন্যায় আউশ, আমনের চারা এবং আমনের বীজতলার ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। চালের চাহিদা বাড়ার সঙ্গে সরবরাহ কমে গেলে দাম আরো বাড়তে পারে। উপরন্তু ভারতের গম রপ্তানি নিষেধাজ্ঞা, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে গম আমদানির পরিমাণ কমে যাওয়া এবং বিশ্বব্যাপী খাদ্যের দাম বৃদ্ধি শস্যের দাম বৃদ্ধিতে ভূমিকা রেখেছে।

এরই প্রেক্ষাপটে চালের বাজার স্থিতিশীল করা এবং সরকারের মজুদ বাড়ানো অপরিহার্য। বেসরকারি পর্যায়েও চাল আমদানির প্রয়োজন হতে পারে। এরই মধ্যে পাঁচ লাখ টন চাল আমদানির অনুমোদন পেয়েছে সরকার। যদিও বর্তমানে স্থানীয় বাজারের তুলনায় বৈশ্বিক বাজারে চালের দাম বেশি, তবে বিদ্যমান চালের আমদানি শুল্ক ৬২ দশমিক ৫০ থেকে ৫ শতাংশে কমানোর সিদ্ধান্তকে দাম স্থিতিশীল রাখতে একটি জরুরি পদক্ষেপ হিসেবে দেখা হচ্ছে। বর্তমানে চালের আমদানিতে ২৫ শতাংশ কাস্টমস শুল্ক, ২৫ শতাংশ নিয়ন্ত্রণ শুল্ক, ৫ শতাংশ অগ্রিম আয়কর, ৫ শতাংশ অগ্রিম ট্যাক্স, ১ শতাংশ বিমা, ১ শতাংশ ল্যান্ডিং চার্জ এবং শূন্য দশমিক ৫ শতাংশ ডিএফ ভ্যাট প্রযোজ্য।

সম্প্রতি ভারত তাদের চাল রপ্তানি শুল্ক ২০ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১০ শতাংশ করেছে। বাংলাদেশ যদি তার আমদানি শুল্ক ৫ শতাংশে নামিয়ে আনে, তাহলে ভারত থেকে চাল আমদানির ক্ষেত্রে ১৫ শতাংশ সম্মিলিত শুল্ক প্রযোজ্য হবে।

খাদ্য মন্ত্রণালয়ের চিঠিতে জোর দিয়ে বলা হয়েছে, এই শুল্ক হ্রাস আমদানিকারকদের অভ্যন্তরীণ চাহিদা মেটাতে উৎসাহিত করবে। সরকারি-বেসরকারি আমদানিতে বাসমতী ছাড়াই অন্যান্য সেদ্ধ চাল ও সুগন্ধি ছাড়াই আতপ চালের শুল্ক কমাতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে এনবিআরকে অনুরোধ জানিয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close