নিজস্ব প্রতিবেদক
ডেঙ্গুতে মৃত্যুহার সর্বোচ্চ এবার
দেশে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে সবচেয়ে বেশি মারা গেছে ২০০৩ সালে। ওই বছরের ১ জানুয়ারি থেকে ৩ অক্টোবর পর্যন্ত মারা গেছেন ১ হাজার ৩০ জন। অন্যদিকে চলতি বছরের ১ জানুয়ারি থেকে ৩ অক্টোবর পর্যন্ত মৃত্যু হয়েছে ১৭৭ জনের। তুলনামূলক চিত্রে, দুই দশকের মধ্যে আক্রান্তের তুলনায় এখন পর্যন্ত এবারই মৃত্যু হার সবচেয়ে বেশি।
মৃত্যুহার বৃদ্ধি নিয়ে উদ্বেগ জানিয়ে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আক্রান্তকে যথাযথ চিকিৎসায় অবহেলা, বিলম্বে হাসপাতালে ভর্তি এবং পুনরায় সংক্রমণের শিকার প্রভৃতি কারণে এবার ডেঙ্গুতে মৃত্যুহার বেশি। দেশে এডিস মশাবাহিত রোগ ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি ও মৃত্যুর তথ্য ২০০০ সাল থেকে রাখছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। এর মধ্যে ২০২৩ সালে ডেঙ্গুতে সবচেয়ে বেশি ৩ লাখ ২১ হাজার ১৭৯ জন হাসপাতালে ভর্তি হয়। ওই বছর ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে মারা যায় ১৭০৫ জন, যা বিগত ২২ বছরে সর্বোচ্চ। আগের বছর ২০২২ সালে দেশে ৬২ হাজার ৯৮ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে মারা যান ২৮১ জন।
চলতি বছর ১ জানুয়ারি থেকে ৩ অক্টোবর পর্যন্ত ৩৪ হাজার ১২১ ডেঙ্গু রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। এর মধ্যে মারা গেছেন ১৭৭ জন। আগের বছর ১ জানুয়ারি থেকে ৩ অক্টোবর পর্যন্ত দেশে ২ লাখ ১১ হাজার ৬৮৩ ডেঙ্গু রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়; এর মধ্যে মারা যান ১ হাজার ৩০ জন। আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি ও মৃত্যুহার বিশ্লেষণে দেখা যাচ্ছে, ডেঙ্গুতে মৃত্যুহার এবার এখন পর্যন্ত ০.৫২ শতাংশে পৌঁছেছে, যা গত বছর ছিল ০.৪৯ শতাংশ। ২০২২ সালের জানুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত মৃত্যুহার ছিল ৩৪শতাংশ এবং তার আগের বছর ওই সময়ে মৃত্যুহার ছিল ৩৮ শতাংশ। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি জরুরি অপারেশন সেন্টার অ্যান্ড কন্ট্রোলরুমের তথ্যানুযায়ী, ২০২৪ সালে ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা তুলনামূলক কম হলেও ৩ অক্টোবর পর্যন্ত মৃত্যুহার সর্বোচ্চ।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব অব্যাহত রয়েছে। ফলে দেশের অধিকাংশ মানুষ ডেঙ্গুতে অন্তত একবার আক্রান্ত হচ্ছে। আর যখনই কোনো ব্যক্তি দ্বিতীয় কিংবা তৃতীয়বার ডেঙ্গু আক্রান্ত হচ্ছে, তখনই তার মৃত্যুঝুঁকি বেড়ে যাচ্ছে। এবারে মৃত্যুহার বেশি হওয়ার এটা অন্যতম একটি কারণ। এ বিষয়ে কীটতত্ত্ববিদ ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. কবিরুল বাশার বলেন, ডেঙ্গুতে মৃত্যুহার বাড়ার পেছনে তিনটি প্রধান কারণ রয়েছে। প্রথম কারণ হচ্ছে, অনেকেই জেনে কিংবা না জেনে আগে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছিল, যারা এবারে দ্বিতীয় কিংবা তৃতীয়বার আক্রান্ত হয়ে অধিক ঝুঁকিতে পড়ছে। এদের মধ্যে মৃত্যু বেশি। দ্বিতীয় কারণ হচ্ছে, অনেকেই জ্বর নিয়ে বাসায় বসে চিকিৎসা নিচ্ছেন কিংবা অবহেলা করছেন, হাসপাতালে যেতে চাচ্ছেন না। এমন সময়ে হাসপাতালে যাচ্ছেন, যখন মৃত্যুঝুঁকি বেড়ে যাচ্ছে।’
তৃতীয় কারণ হিসেবে অধ্যাপক ড. কবিরুল বলেন, দেশে বর্তমানে সিটি করপোরেশনসহ স্থানীয় সরকারের সব পর্যায়ে স্বাস্থ্যসেবা ও ডেঙ্গু প্রতিরোধী কার্যক্রম ভেঙে পড়েছে। ফলে স্থানীয় পর্যায়ে অনেক হাসপাতালই ডেঙ্গু রোগীকে অন্য হাসপাতালে রেফার করে দিচ্ছে। ফলে হাসপাতাল ঘুরে ঘুরে রোগীরা মৃত্যুঝুঁকিতে পড়ছেন। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যানুযায়ী, এ বছর প্রতি মাসেই ডেঙ্গুতে মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে সেপ্টেম্বরে সবচেয়ে ৮০ জন মারা গেছেন। জানুয়ারিতে ১৪, ফেব্রুয়ারিতে ৩, মার্চে ৫, এপ্রিলে ২, মে মাসে ১২, জুনে ৮, জুলাইয়ে ১২ ও আগস্টে ২৭ জনের মৃত্যু হয়েছে ডেঙ্গুতে। অক্টোবরের প্রথম তিন দিনেই ১৬ জনের মৃত্যু হয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) এক বিবৃতিতে জানায়, ২০২১ সাল থেকে প্রতি বছর ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। ২০২৪ সালের প্রথম ৮ মাসেই ১২.৩ মিলিয়নের বেশি ডেঙ্গু সংক্রমণ ও ৭ হাজার ৯০০ জনের মৃত্যু ঘটেছে।
"