সাভার (ঢাকা) প্রতিনিধি
আশুলিয়ায় সংঘর্ষে শ্রমিক নিহত, পুলিশসহ আহত ২০
সাভারের আশুলিয়ায় বেতন বাড়ানোর দাবিতে বিক্ষোভরত শ্রমিকদের সঙ্গে যৌথবাহিনীর সংঘর্ষে কাউসার হোসেন খান (২৭) নামে এক শ্রমিক নিহত হয়েছেন। পুলিশের এসপিসহ আহত হয়েছেন ২০ জন। তাদের মধ্যে চারজন গুলিবিদ্ধ অবস্থায় এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন।
গতকাল সোমবার দুপুরে আশুলিয়ার টঙ্গাবাড়ি এলাকার মন্ডল নিটওয়্যার কারখানার সামনে এ ঘটনা ঘটে।
নিহত শ্রমিকের নাম কাউসার আহাম্মেদ (২৬)। তিনি টঙ্গাবাড়ি এলাকার ম্যাংগো টেক্স লিমিটেড কারখানায় সুইং অপারেটর হিসেবে কাজ করতেন। গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন এনাম মেডিকেল কলেজ অ্যান্ড হাসপাতালের জরুরি বিভাগের চিকিৎসক ডা. এনামুল হক মিয়া। গুলিবিদ্ধরা হলেন নয়ন, রাসেল, নাজমুল ও ওবায়দুল মোল্লা।
শ্রমিকরা জানান, সকালে মন্ডল গ্রুপের শ্রমিকদের প্রতিনিধিদের সঙ্গে মালিকপক্ষ ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মিটিং চলছিল। সমঝোতা না হওয়ায় শ্রমিকরা কারখানার বাইরে অবস্থান নেন। পরে অন্য কারখানার শ্রমিকরা সেখানে জড়ো হতে থাকেন। এ সময় দায়িত্বরত পুলিশসহ যৌথবাহিনীর সদস্যরা শ্রমিকদের বুঝিয়ে শান্ত করার চেষ্টা করলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও শ্রমিকরা মুখোমুখি অবস্থান নেয়। পরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা লাঠিচার্জ শুরু করেন। শ্রমিকরা র্যাব, পুলিশ ও সেনাবাহীনির বেশ কয়েকটি গাড়ি ভাঙচুর করেন। হামলায় শিল্প পুলিশের এসপি সারোয়ার আলম গুরুতর আহত হয়েছেন।
পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পুলিশ বিক্ষুদ্ধ শ্রমিকদের লাঠিচার্জ করে ছত্রভঙ্গ করে দেয়। পরে শ্রমিকরা পুলিশকে লক্ষ্য করে ইটপাটকেল নিক্ষেপ করলে পুলিশ বেশ কয়েক রাউন্ড টিয়ার শেল রাবার বুলেট নিক্ষেপ করে। এ সময় উভয় পক্ষের মধ্যে ঘণ্টাব্যাপী চলা সংঘর্ষে পুলিশসহ অন্তত ২০ জন আহত হন। এছাড়া হামলা ও ভাঙচুরে ঘটনায় জড়িত সন্দেহে ঘটনাস্থল থেকে নারীসহ অন্তত ১৫ জনকে আটক করা হয়।
বিক্ষুদ্ধ শ্রমিকরা জানান, গত ২৭ আগস্ট এক নোটিসের মাধ্যমে বার্ডস গ্রুপ লে-অফ ঘোষণা করে নোটিস দেয়। নোটিসে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ ও বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দার কারণে কারখানায় কাজ না থাকায় অব্যাহতভাবে আর্থিক লোকসানের মধ্যদিয়ে ব্যবসায়িক কার্যক্রম পরিচালনা করার কথা জানায়। নোটিসে ২৮ আগস্ট থেকে গ্রুপটির আর এন আর ফ্যাশনস লিমিটেড, বার্ডস গার্মেন্টস লিমিটেড, বার্ডস ফেডরেক্স লিমিটেড এবং বার্ডস এ অ্যান্ড জেড লিমিটেডের সব শাখার কার্যক্রম বন্ধ ঘোষণা করা হয়।
শ্রমিকরা আরো জানায়, আমাদের আগস্ট মাসের বেতন সেপ্টেম্বরের ১০ তারিখ এবং ৩০ সেপ্টেম্বর সার্ভিস বেনিফিটসহ ক্ষতিপূরণ পরিশোধের দিন ধার্য করা হয়। চুক্তিমতো শ্রমিকদের বেতনের টাকা পরিশোধ করলেও ৩০ সেপ্টেম্বর সার্ভিস বেনিফিটসহ ক্ষতিপূরণের টাকা প্রদানের জন্য রবিবার নতুন করে আরো তিন মাস সময় চেয়ে নোটিস দেয় প্রতিষ্ঠানটি। পরে নির্ধারিত সময়ে টাকা পরিশোধ না করায় শ্রমিকরা সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ শুরু করে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক শ্রমিক নেতা বলেন, ৩০ সেপ্টেম্বর শ্রমিকদের নির্ধারিত পাওনা পরিশোধের কথা ছিল। এই তারিখ পিছিয়ে আরো তিন মাস সময় চান কর্তৃপক্ষ। শ্রমিকদের বুঝিয়ে এই তিন মাস সময় নিয়ে দিতে শ্রমিক নেতারা ২০ লাখ টাকা দাবি করেন কারখানা কর্তৃপক্ষের কাছে। পরে ১২ লাখ টাকায় রফা-দফা হয়। গতকাল ২৯ সেপ্টেম্বর ৪ শ্রমিক নেতা কারখানার আইনজীবী ‘আমেনার’ সঙ্গে মিটিং করার পর বার্ডস গ্রুপের পক্ষ থেকে তিন মাস সময় চেয়ে একটি নোটিস দেওয়া হয়। নোটিসের খবর শ্রমিকদের মাঝে ছড়িয়ে পড়লে শ্রমিকরা উত্তেজিত হয়ে সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ শুরু করেন।
এছাড়া ডংলিয়ন পোশাক কারখানার শ্রমিকরা জানায়, কয়েক দিন পর পর কারখানা কর্তৃপক্ষ ১৩(১) ধারায় বন্ধ ঘোষণা করে। এ পর্যন্ত প্রায় ৩ বার কারখানা অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করেছে কর্তৃপক্ষ। সোমবার থেকে আবার ১৩ (১) ধারায় কারখানা বন্ধের নোটিস দেওয়ায় বন্ধ কারখানা খুলে দেওয়ার দাবিতে সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেছে শ্রমিকরা।
চালু থাকা রাইজিং গ্রুপের অ্যাকটিভ কম্পোজিট মিলস লিমিটেড কারখানার এইচআর এবং প্রশাসনিক কর্মকর্তা মো. তৌহিদুজ্জামান বলেন, সরকার এবং বিজিএমইএ এর নির্দেশনা অনুযায়ী আমরা সব দাবি মেনে নেওয়ায় আমাদের শ্রমিকরা শান্তিপূর্ণভাবে কাজ করছে। কিন্তু পাশের বন্ধ থাকা লুসাকা গ্রুপের শ্রমিকরাসহ বহিরাগত লোকজন এসে গেটে ইটপাটকেল নিক্ষেপ করে ভাঙচুর চালায়। তখন বাধ্য হয়েই কারখানায় ছুটি ঘোষণা করা হয়।
জিরাবে এলাকার পিএমকে হাসপাতালের অ্যাডমিন ম্যানেজার নাজিম উদ্দিন বলেন, আমাদের হাসপাতালে চারজন শ্রমিককে আহত অবস্থায় আনা হয়েছে। তাদের মধ্যে দুজনের পায়ে গুলি লেগেছে। তাদের চিকিৎসা চলছে।
ন্যাচারাল ডেনিম কারখানার এইচআর অ্যাডমিন কর্মকর্তা সবুজ হাওলাদার বলেন, আমাদের কারখানায় কোনো সমস্যা ছিল না। সকাল থেকেই শ্রমিকরা শান্তিপূর্ণভাবে কাজ করছিল। হঠাৎ শ্রমিকদের কাছে গুজব আশপাশের মন্ডল গার্মেন্টসের শ্রমিক মারা গেছে। এটা শুনেই সব শ্রমিক একসঙ্গে কারখানা থেকে বেরিয়ে মন্ডল গার্মেন্টসের সামনে চলে যায়। পরে ওখানে কী ঘটেছে আমার জানা নেই।
আশুলিয়া শিল্প পুলিশ-১ এর পুলিশ সুপার সারোয়ার আলম জানান, সকাল থেকে কঠোর নিরাপত্তার মধ্যে তৈরি পোশাক শ্রমিকরা শান্তিপূর্ণভাবে কাজ করছে। দুপুরের দিকে মন্ডল নিটওয়্যার কারখানার শ্রমিকদের আলোচনা করার সময় পার্শ্ববর্তী ম্যাঙ্গো টেক্স ও ন্যাচারাল ডেনিম কারখানার শ্রমিকরা আমাদের ওপর হামলা করে। তাদের ছত্রভঙ্গ করতে লাঠিচার্জসহ টিয়ার শেল নিক্ষেপ করা হয়।
তিনি জানান, শ্রম আইনের ১৩ (১) ধারায় ১১টি কারখানা বন্ধ আছে এবং ৭টি কারখানায় সাধারণ ছুটি ঘোষণা করেছে কর্তৃপক্ষ। এছাড়া যেকোনো ধরনের অপ্রীতিকর পরিস্থিতি এড়াতে শিল্প পুলিশ, এপিবিএনসহ সেনাবাহিনীর সদস্যরা দায়িত্ব পালন করছেন।
"