লালমনিরহাট প্রতিনিধি
ক্ষমতা পেয়েই টাকার কুমির
ছিলেন একজন তামাক ব্যবসায়ী, সেখানে থেকে হয়েছিলেন অটো এমপি, তারপর মন্ত্রী। মন্ত্রিত্ব পেয়েই হাতে চলে আসে আলাদিনের চেরাগ। গড়ে তোলেন সম্পদের পাহাড়। তিনি আর কেউ নন, লালমনিরহাট-২ আসনের অটো এমপি ও সাবেক সমাজকল্যাণমন্ত্রী নুরুজ্জামান আহম্মেদ। বাবার ক্ষমতাকে ব্যবহার করে পিছিয়ে নেই পুত্র রাকিবুজ্জামান আহম্মেদ। বাপ বেটা মিলে দুহাতে যথেচ্ছ কামিয়েছেন, মন্ত্রণালয়কে বানিয়েছিলেন টাকা কামানোর মেশিন। দুর্নীতি, নিয়োগ বাণিজ্য ও কমিশন বাণিজ্যের মাধ্যমে গড়ে তোলেন সম্পদের পাহাড়। নির্যাতনের জন্য মন্ত্রীপুত্র গড়ে তুলেছিলেন টর্চার সেল।
নুরুজ্জামান আহমেদ মন্ত্রী হলেও পিতার সবকিছুই নিয়ন্ত্রণ করতেন পুত্র রাকিবুজ্জামান আহম্মেদ। চাকরি, তদবির, বদলি, দখলবাজি সব জায়গায় ছিল তার হাত। মন্ত্রীপুত্রের অনুমতি ছাড়া মামলাও নিত না থানার পুলিশ। টানা আট বছর মন্ত্রিত্বের দায়িত্ব পালনকালে নুরুজ্জামান এখন টাকার কুমির। নামে-বেনামে ঢাকায় রয়েছে একাধিক ফ্ল্যাট। বিভিন্ন স্বজনের নামে ব্যাংকে রয়েছে শত শত কোটি টাকা। এ ছাড়া ৩ শতাধিক একর জমির মালিক তারা। পট পরিবর্তনের পরপরই গ্রেপ্তার আতঙ্কে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন পিতা-পুত্র দুজনই।
জানা গেছে, সংসদে কবিতা পাঠ করে শেখ হাসিনার মন জয় করে নিয়েছিলেন নুরুজ্জামান আহমেদ। এরপর হয়ে যান সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আস্থাভাজন। মন্ত্রী হওয়ার পর কালীগঞ্জ রেলস্টেশনের পাশে রেলওয়ের জমি দখল করে করেছেন পার্ক ও আয়েশখানা, এছাড়া গড়ে তুলেছিলেন সুইমিং পুল। রেল থেকে নোটিস করলেও কর্ণপাত করেননি। দুদকে অভিযোগ করেও প্রতিকার হয়নি। দুদকের অভিযোগ করলে মিথ্যা মামলায় হয়রানি করা হয় অভিযোগকারীকে।
অভিযোগ রয়েছে- ক্যান্সার ও কিডনি নষ্টের ভুয়া রোগী দেখিয়ে মন্ত্রী নুরুজ্জামান কয়েকশ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় থেকে। মন্ত্রী তার মায়ের নামে তৈরি করেছেন মা ও শিশু হাসপাতাল। সেই হাসপাতালের জমি একোয়ার হলেও ন্যায্য মূল্য পায়নি জমির মালিকরা। ৩৫ কোটি টাকা ব্যয়ের হাসপাতালটি এলাকার গুণিজনের নামে নয়, হয়েছে মন্ত্রীর নিজের মায়ের নামে। লালমনিরহাটের গোটা জেলায় সরকারি চাকরির ভাগ্য নির্ধারণ হতো মন্ত্রীপুত্রের দরবার হলে।
কাকিনার এন্তাজুল ইসলাম জানান, সমাজসেবা মাঠকর্মীর জন্য ১০ লাখ টাকা দাবি করলেও ৫ লাখ জোগাড় করেছিলেন, বাকি টাকা দিতে না পারায় চাকরিটা পায়নি। অনেক বেকার যুবকের স্বপ্ন ভেঙে দিয়েছে মন্ত্রীপুত্র। রাকিবুজ্জামানের বিরুদ্ধে দুদকে রয়েছে একাধিক অভিযোগ। রাকিবুজ্জামান কালীগঞ্জে সরকারি কর্মকর্তাদের নির্যাতনে কালীগঞ্জ রেলস্টেশনের পাশেই তৈরি করেছিলেন টর্চার সেল। ওই টর্চার সেলে যারা কথা শুনত না, তাদের ধরে এনে নির্যাতন করা হতো। কালীগঞ্জ উপজেলা নেসকোর সাবেক নির্বাহী প্রকৌশলী রবি চন্দ্র রায় জানান, তাকেও টর্চার সেলে মানসিক নির্যাতন করেছিলেন রাকিবুজ্জামান।
কালীগঞ্জ ও আদিতমারীতে রাকিব-এপিএস মিজানের হুকুম ছাড়া মামলা রেকর্ড হতো না। ওদিকে মন্ত্রীর জামাতা জিল্লুর রহমান সরকারের যুগ্ম সচিব। শ্বশুর মন্ত্রী হওয়ার সুবাদে তাকে বাংলাদেশ স্থলবন্দর চেয়ারম্যান করা হয়েছে। জিল্লুর রহমানের বাড়ি সুনামগঞ্জের গৌরাঙ্গে। সেখানে তৈরি করেছেন সরকারি লুটের টাকায় এতিমখানা, বাবা আবদুস সালাম নামে জামে মসজিদ, নুরুজ্জামান আহম্মেদ নামে গ্রন্থাগার, নিজ নামে জেড রহমান অ্যান্ড ভাইবোন দাতব্য চিকিৎসালয় এবং জিল্লুরের স্ত্রীর নামে পরমিতা নারী প্রশিক্ষণ কেন্দ্র। এ ছাড়া মন্ত্রীর নাতির নামে ঐশ্বর্য কম্পিউটার সেন্টার তৈরি করেন। জিল্লুর রহমানের বিরুদ্ধে দুদকেও হয়েছে অভিযোগ। ওদিকে মন্ত্রী থাকাকালীন পুষ্প বাংলাদেশ এনজিও মাধ্যমে এলাকার দরিদ্র বেকার যুবকদের ভাগ্য পরিবর্তনে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন প্রশিক্ষণের নামে কয়েক কোটি টাকা নয়ছয় করেছেন।
লালমনিরহাট নবাগত পুলিশ সুপার মো. তরিকুল ইসলাম জানালেন, আসামিদের বিরুদ্ধে যেহেতু বিভিন্ন থানায় মামলা হয়েছে। অবশ্যই তাদের আইনের আওতায় আনা হবে। তবে কিছু কিছু বিষয়ে দুদক দেখছে। তারা সহয়তা চাইলে সবাকে আইনের আওতায় আনা হবে।
লালমনিরহাট জেলা প্রশাসক মো. এইচ এম রাকিব হায়দার জানালেন কোনো দুর্নীতিবাজ ছাড় পাবে না। আইন অনুযায়ী নেওয়া হবে ব্যবস্থা। অন্যদিকে দুর্নীতি দমন কমিশন কুড়িগ্রাম সমন্বিত উপপরিচালক সিরাজুল ইসলাম জানালেন, আসামিদের বিরুদ্ধে এরই মধ্যে তদন্ত শুরু হয়েছে। দুদকের হাত থেকে কোনো দুর্নীতিবাজ ছাড় পাবে না। সাবেক সমাজকল্যাণমন্ত্রী নুরুজ্জামান আহম্মেদ ও তার পুত্র রাকিবুজ্জামান দুটি হত্যা মামলায় পলাতক থাকায় তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি।
"