প্রতিদিনের সংবাদ ডেস্ক
তিস্তা অববাহিকায় বন্যার পদধ্বনি
তিস্তা নদীর পানি বেড়ে রবিবার ভোরে বিপৎসীমার ওপরে প্রবাহিত হলেও পরে কমতে শুরু করে। নীলফামারী জেলার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়ে পাঁচ হাজারের বেশি পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়ে। এছাড়া রংপুর, কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা ও লালমনিরহাটের ওপর দিয়ে প্রবাহিত তিস্তা, দুধকুমার, ধরলা ও ব্রহ্মপুত্র নদ-নদীর তীরবর্তী নিম্নাঞ্চলে পানি ঢুকতে শুরু করেছে। পানি বাড়ছে যমুন নদীতেও। প্রতিনিধিদের পাঠানো খবর-
নীলফামারী : রবিবার সকাল ৬টার দিকে লালমনিরহাটের দোয়ানীতে অবস্থিত তিস্তা ব্যারাজ পয়েন্টে তিস্তা নদীর পানি বিপৎসীমার ২ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। পরে সকাল ৯টায় পানি কমে বিপৎসীমার ১ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। গত শনিবার সন্ধ্যা ৬টার দিকে বিপৎসীমার ৫ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে পানি প্রবাহিত হয়ে রাত ১২টায় বিপৎসীমা অতিক্রম করে। এই পয়েন্টে তিস্তা নদীর পানির বিপৎসীমা ৫২ দশমিক ১৫ মিটার।
সংশ্লিষ্ট পানি উন্নয়ন বোর্ড জানিয়েছে, নীলফামারীর ডালিয়া পয়েন্টে রবিবার সকাল ৯টায় বিপৎসীমার ১ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে, দুপুর ১২টায় বিপৎসীমার ৩ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে এবং দুপুর ৩টায় বিপৎসীমার ৮ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল।
স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও লোকজনের ভাষ্য, তিস্তার পানি বাড়ার কারণে নীলফামারীর ডিমলা উপজেলার পূর্বছাতনাই, পশ্চিম ছাতনাই, টেপাখড়িবাড়ি, খালিশাচাপানী, ঝুনাগাছ চাপানী, গয়াবাড়ি, খগাখড়িবাড়ি ইউনিয়নের তিস্তা নদীবেষ্টিত ১৫টি চর গ্রামের পাঁচ হাজারের বেশি পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে।
পূর্বছাতনাই ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান আবদুল লতিফ খান বলেন, তার ইউনিয়নের পূবছাতনাই ও ঝাড়সিংহেরস্বর মৌজার প্রায় ১ হাজার ২০০ পরিবার পানিবন্দি হয়েছে পড়েছে। লোকজন আতঙ্কে আছেন।
খালিশাচাপানী ইউনিয়নের ৪ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য মো. রবিউল ইসলাম বলেন, পূর্ব ও পশ্চিম বাইশপুকুর গ্রামে দেড় শতাধিক পরিবার পানিবন্দি হয়ে মানবেতর জীবন কাটাচ্ছে।
তিস্তার চরবেষ্টিত ডিমলা উপজেলার টেপাখড়িবাড়ি ইউপি চেয়ারম্যান মো. রবিউল ইসলাম বলেন, তিস্তা নদীর পানি বাড়ার কারণে ইউনিয়নের চার শতাধিক পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ড ডালিয়া ডিভিশনের বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র সূত্রে জানা যায়, পানি উন্নয়ন বোর্ড ডালিয়া ডিভিশনের নির্বাহী প্রকৌশলীর দায়িত্বে থাকা পানি উন্নয়ন বোর্ড নীলফামারী ডিভিশনের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আতিকুর রহমান বলেন, রবিবার সকাল ৬টায় তিস্তা নদীর পানি বিপৎসীমার ২ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হলেও সকাল ৯টায় ৩ সেন্টিমিটার কমে বিপৎসীমার ১ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হয়। পূর্বাভাস অনুযায়ী পানি বাড়ার সম্ভাবনা নেই। পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে তিস্তা ব্যারাজের সব কটি (৪৪টি) জলকপাট খুলে দেওয়া হয়েছে।
রংপুর ব্যুরো অফিস জানিয়েছে, রংপুর পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী রবিউল ইসলাম বলেন, পানির চাপ সামলাতে তিস্তার ৪৪ জলকপাট খোলা রাখা হয়েছে। আর ঝুঁকিপূর্ণ জায়গা রক্ষায় জিওব?্যাগসহ সব ধরনের প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে।
রংপুর আবহাওয়া অফিসের ইনচার্জ আবহাওয়াবিদ মো. মোস্তাফিজার রহমান জানান, শনিবার রাত ৮টা পর্যন্ত রংপুরে ২০০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। তবে মাঝারি ধরনের ভারী বৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। আগামী ২৪ ঘণ্টা ব্রহ্মপুত্র-যমুনা নদ-নদীর পানি সমতলে স্থিতিশীল থাকতে পারে।
তিস্তা বাঁচাও, নদী বাঁচাও সংগ্রাম পরিষদের সভাপতি অধ্যক্ষ নজরুল ইসলাম হক্কানি বলেন, অসময়ের বন্যা ও ভাঙনে প্রতি বছর এক লাখ কোটি টাকার সম্পদ তিস্তার গর্ভে চলে যায়। এ সমস্যার স্থায়ী সমাধানের জন্য নদী খনন, সংরক্ষণ ও তিস্তা মহাপরিকল্পনার বাস্তবায়ন করা ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। এদিকে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের (বেরোবি) অধ্যাপক ও নদীবিষয়ক সংগঠন রিভারাইন পিপলের পরিচালক ড. তুহিন ওয়াদুদ বলেন, বন্যার হাত থেকে রক্ষায়, তলদেশ ভরাট হয়ে যাওয়া তিস্তা নদীকে বিজ্ঞান সম্মতভাবে খনন করে শাখা নদীগুলোর মুখ উন্মুক্ত করা দরকার।
রংপুর, নীলফামারী, লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম ও গাইবান্ধার নিম্নাঞ্চলে পানি ঢুকতে শুরু করেছে। নদী ভাঙনের ঝুঁকিতে পড়েছে বসতবাড়ি ও রাস্তাঘাট। আগাম শীতকালীন শাকসবজি ও বীজতলাসহ বিভিন্ন ফসলি জমিতে পানি প্রবেশ করেছে।
জানা গেছে, রংপুরের পীরগাছা উপজেলার ছাওলা ইউনিয়নের গাবুড়া, নয়ারহাট, কিসমত ছাওলা পাওয়ার প্লান্ট, গংগাচড়া উপজেলার লক্ষ্মীটারী, নীলফামারীর ডিমলা উপজেলার কালিগঞ্জ, ঝাড়সিংহেশ্বর, খগারচর, জুয়ার চর, বাংলাপাড়া, উত্তর খড়িবাড়ী, বাইশপুকুর ও জলঢাকা উপজেলার ফরেস্টের চর, ভাবনচুর, ডাউয়াবাড়ী, লালমনিরহাটের পাটগ্রামের দহগ্রাম, হাতীবান্ধার গড্ডিমারী, দোয়ানী, ফকিরপাড়া, সানিয়াজান ইউনিয়নের নিজ শেখ সুন্দর, বাঘের চর, সিঙ্গামারি ইউনিয়নের ধুবনী, সিন্দুর্না, পাটিকাপাড়া, ডাউয়াবাড়ি, কালীগঞ্জ উপজেলার ভোটমারী, শৈইলমারী, নোহালী, চর বৈরাতি, আদিতমারী উপজেলার মহিষখোচা, পলাশী ও সদর উপজেলার ফলিমারীর চর খুনিয়াগাছ, রাজপুর এবং গোকুণ্ডা ইউনিয়নের নিম্নাঞ্চলে পানি প্রবেশ করতে শুরু করেছে।
কাউনিয়া (রংপুর) : কাউনিয়ার ঢুষমারা, তালুক শাহবাজ, পূর্ব নিজপাড়া, গোপীডাঙ্গা, আরাজি হরিশ্বর, চর প্রাননাথ, শনশনিয়া, চর হয়বতখাঁ, চর গনাই, আজমখাঁর চর, চর নাজিরদহ ও নাজিরদহ গ্রামে পানি উঠতে শুরু করেছে। শতাধিক পুকুর ও মৎস্য খামারের মাছ ভেসে গেছে।
উপজেলা কৃষি অফিসার আবু মো. মনিরুজ্জামান বলেন অতিবৃষ্টিতে রোপা আমন ৭০ হেক্টর ও সবজি ফসল ২ হেক্টর আক্রান্ত হয়েছে। ৯টি পরিবার তিস্তার ভাঙনের কবলে পড়েছে।
উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো. মহিদুল হক বলেন, আমি বন্যাকবলিত টেপামধুপুর ইউনিয়নের বন্যা কবলিত এলাকা পরিদর্শন করেছি। ত্রাণের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা রয়েছে। আমরা সব সার্বক্ষণিক খোঁজখবর নিচ্ছি।
সিরাজগঞ্জ : যমুনা নদীর পানি সিরাজগঞ্জ গত ২৪ ঘণ্টায় শহরের হার্ড পয়েন্টে ৩৫ সেন্টিমিটার ও কাজিপুরের মেঘাই পয়েন্টে ৫১ সেন্টিমিটার পানি বৃদ্ধি পেয়েছে। রবিবার সকালে হার্ড পয়েন্টে পানি সমতল রেকর্ড করা হয়েছে ৯ দশমিক ৯০ মিটার (ঝড়ন)। অন্যদিকে কাজিপুর মেঘাই পয়েন্টে পানি সমতল রেকর্ড করা হয়েছে ১১ দশমিক ৬৪ মিটার (ঝড়ন)। সিরাজগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপবিভাগীয় প্রকৌশলী মো. নাজমুল হোসাইন এ তথ্য নিশ্চিত করেন।
"