কূটনৈতিক প্রতিবেদক
বন্ধুত্বের কূটনীতির নতুন পথচলা
‘সকলের সঙ্গে বন্ধুত্ব’ বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির এই স্লোগান এতদিন যেন ছিল কেবল মুখে মুখেই। সত্যিকার অর্থে সেই বন্ধুত্বের কূটনীতির নতুন পথচলা শুরু করেছে বাংলাদেশ। আর সেই শুরুটা শুরু হলো অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের হাত ধরেই। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের (ইউএনজিএ) ৭৯তম অধিবেশনে গিয়ে বিশ্বমঞ্চে একদিকে তারুণ্যনির্ভর নতুন বাংলাদেশকে যেমন তুলে ধরেছেন নোবেলবিজয়ী ব্যক্তিত্ব ড. ইউনূস, তেমনি সম্মেলনের ফাঁকে ফাঁকে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনসহ বিশ্বনেতাদের সঙ্গে করেছেন একের পর এক বৈঠক। এসব বৈঠকে বন্ধুত্বের হাত নিজে বাড়িয়ে দিয়েছেন, পেয়েছেন উষ্ণ অভ্যর্থনা।
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের (ইউএনজিএ) ৭৯তম অধিবেশনে অংশগ্রহণ শেষে গতকাল রবিবার ভোরে দেশে ফিরেছেন। চার দিনের যুক্তরাষ্ট্র সফর শেষে প্রধান উপদেষ্টা এবং তার সফরসঙ্গীদের বহনকারী কাতার এয়ারওয়েজের একটি বাণিজ্যিক ফ্লাইট রাত ৩টা ৩২ মিনিটে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে এসে পৌঁছে। এর আগে তিনি ২৩ সেপ্টেম্বর নিউইয়র্ক যান।
জাতিসংঘে গিয়ে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কূটনৈতিক তৎপরতা প্রসঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন কবির বলেন, প্রয়োজনের নিরিখে আমাদের বহুমুখী কূটনীতিকেই অনুসরণ করা উচিত। জাতিসংঘ অধিবেশনে বা সম্মেলনের সাইডলাইনের ড. ইউনূস যাদের সঙ্গে দেখা করেছেন, বৈঠক করেছেন, সেটাই হলো বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির বাস্তবতা। সময়ের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে আমাদের প্রয়োজন অনুসারেই তিনি এই কূটনীতি পরিচালনা করেছেন। এটাই সময়োপযোগী উত্তম কূটনীতি।
প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম জানিয়েছেন, মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনসহ ১২টি দেশের সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধান এবং বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রধানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। সাইডলাইনে ৪০টি উচ্চপর্যায়ের বৈঠকে অংশ নেন ড. ইউনূস। সফরের শুরুর দিনেই মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠক করেন। অন্যদের মধ্যে জাতিসংঘ মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস, ইতালির প্রধানমন্ত্রী জর্জিয়া মেলোনি, পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরিফ, নেপালের প্রধানমন্ত্রী কে পি শর্মা ওলি এবং নেদারল্যান্ডসের প্রধানমন্ত্রী ডিক শুফের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠক করেন ড. ইউনূস।
নিউইয়র্ক অবস্থানকালে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে অন্যদের মধ্যে চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই, ইউরোপীয় কমিশনের প্রেসিডেন্ট উরসুলা ভন ডের লেয়েন, জাতিসংঘের মানবাধিকার হাইকমিশনার ভলকার তুর্ক, মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি জে ব্লিঙ্কেন, জাতিসংঘের হাইকমিশনারের শরণার্থীবিষয়ক কমিশনার ফিলিপ্পো গ্র্যান্ডি, বিশ্বব্যাংক গ্রুপের প্রেসিডেন্ট অজয় বঙ্গ ও ইউএসএইডের প্রশাসক সামান্থা পাওয়ার সাক্ষাত করেন।
এসব বিষয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন বলেছেন, দেশ এখন নিজস্ব গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে এবং আমরা আমাদের বৈদেশিক নীতির কতিপয় ক্ষেত্রে দেশের স্বার্থ সমুন্নত রাখতে কারো কোনো পরামর্শে বিচ্যুত হব না। আমরা আমাদের নিজস্বতা ও মর্যাদা বজায় রেখে প্রতিবেশীসহ সব দেশের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রেখে এগিয়ে যাব। ছাত্র-জনতার আকাঙ্ক্ষা পূরণ এবং দেশের স্বার্থ রক্ষায় আমরা বদ্ধপরিকর।
প্রধান উপদেষ্টা নিউইয়র্ক সময় গত শুক্রবার জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে ভাষণ দেন। সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে ভাষণে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস বিশ্বনেতাদের টেকসই উন্নয়ন ও একটি সুন্দর বিশ্ব গড়তে নিজ নিজ দেশের তরুণদের পেছনে বিনিয়োগের আহ্বান জানিয়েছেন।
জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ৭৯তম অধিবেশনে তিনি বলেন, দারিদ্র্য, জলবায়ু পরিবর্তন ও বৈষম্যের মতো বড় বৈশ্বিক সমস্যা সমাধানে বাংলাদেশসহ বিশ্বের তরুণরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। এই উদ্দেশ্যে, তাদের ক্ষমতায়ন করতে হবে এবং আরো অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং স্থিতিশীল বিশ্ব গড়ে তুলতে তাদের দক্ষতা ব্যবহার করতে হবে।
তিনি বলেন, জুলাই-আগস্ট মাসে বাংলাদেশে যে ঐতিহাসিক পরিবর্তন হয়েছে তার জন্যই তিনি অ্যাসেম্বলিতে দাঁড়িয়ে জাতিসংঘে ভাষণ দিতে পারছেন। জনগণের শক্তি, বিশেষ করে যুবসমাজ বাংলাদেশকে একটি স্বৈরাচারী ও অগণতান্ত্রিক শাসনের হাত থেকে বাঁচিয়েছে। যুব নেতৃত্বাধীন আন্দোলনের মাধ্যমে বাংলাদেশ রাজনৈতিক সচেতনতার এক নতুন যুগে প্রবেশ করেছে।
মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, এই পরিবর্তনের সঙ্গে অনেক সমস্যা এসেছে, কিন্তু তরুণদের দৃঢ় সংকল্প দেশে আরো সমান ও সমৃদ্ধ ভবিষ্যতের ভিত্তি তৈরি করছে।
গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ বজায় রাখা এবং সব নাগরিকের মানবাধিকার নিশ্চিত করার ওপর গুরুত্ব আরোপ করে তিনি বলেন, তার দেশ শান্তি, উন্নয়ন ও অধিকারের প্রতি অঙ্গীকার বজায় রাখবে। স্বাধীনতা এবং মর্যাদার নীতিগুলো বাংলাদেশ সরকার এবং এর আন্তর্জাতিক অবস্থানের কেন্দ্রবিন্দু।
বাংলাদেশের মানুষ অসামান্য সাহসিকতার সঙ্গে স্বাধীনতা ও তাদের অধিকারের জন্য লড়াই করেছে এবং তরুণরা আজ ন্যায়বিচার, সাম্য ও ভবিষ্যতে তাদের ভূমিকার জন্য লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে। তাদের এমন একটি পরিবেশ খুঁজে পাওয়া উচিত যেখানে তারা বেড়ে উঠতে পারে, উদ্ভাবন করতে পারে এবং নেতৃত্ব দিতে পারে।
তারুণ্যের ক্ষমতায়ন এবং টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জনের মধ্যে আন্তঃসম্পর্কের বিষয়ে কথা বলতে গিয়ে মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, সমসাময়িক সমস্যা সমাধানের জন্য সিদ্ধান্ত গ্রহণে তরুণদের অর্থপূর্ণ এবং জোরালো অংশগ্রহণ প্রয়োজন।
তিনি বলেন, বাংলাদেশের স্বাধীনতা থেকে যে শিক্ষা নেওয়া হয়েছে তা এখনো দেশের তরুণদের কর্ম ও উচ্চাকাঙ্ক্ষার প্রতিফলিত হচ্ছে। দ্রুত পরিবর্তনশীল বিশ্বে বাংলাদেশের তরুণরা তাদের মূল্যবোধ ধরে রেখেছে। তারা প্রমাণ করেছেন যে স্বাধীনতা, মর্যাদা এবং বৈষম্য ছাড়া সব মানুষের অধিকার সমুন্নত রাখা কেবল উচ্চাকাঙ্ক্ষা হয়েই থাকতে পারে না- এটি পদ-ভেদাভেদ নির্বিশেষে সবার প্রাপ্য।
"