গাজী শাহনেওয়াজ
পদায়ন আছে বদলি নেই
সড়ক ও মহাসড়ক বিভাগ এবং অর্থ বিভাগে অনিয়মগুলো যেন নিয়মে পরিণত হয়েছে। এ দুই বিভাগে পদায়নের পর বদলি না হওয়া আইনসিদ্ধ হয়ে গেছে। যদি কারও বদলি হয় তা কদাচিৎ। জানা গেছে, সহজেই পদোন্নতি এবং আর্থিকভাবে লাভবান হওয়ার সুযোগ বেশি থাকায় এ দুই বিভাগ থেকে নড়তে চান না কোনো কর্মকর্তা। তারা এক কর্মস্থলেই থাকেন বছরের পর বছর।
সূত্র মতে, ক্ষমতা ও খুঁটির জোরে এসব কর্মকর্তারা বহাল তবিয়তে বছরের পর বছর একই বিভাগে কাটিয়ে দিচ্ছেন। এমনকি তাদের বদলি হয় এক উইং থেকে অন্য উইংয়ে। প্রশ্ন উঠেছে, বদলি না হওয়া আমলাদের খুঁটির জোর কোথায়? এ দুই বিভাগে সব হয় ফোন ও খুঁটির জোরে।
অর্থ ও সড়ক বিভাগের কর্মকর্তাদের বিষয়ে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বদলি না হওয়া আমলাদের খুঁটির জোর খুবই মজবুত বলে জানা গেছে। তাদের ছায়া মন্ত্রী হিসেবে কাজ করেন প্রভাবশালী সাবেক-বর্তমান আমলা ও রাজনৈতিক ব্যক্তিরা। ওই ব্যক্তিদের ম্যানেজ করেই চলছে রামণ্ডরাজত্ব। এর মধ্যে দেখা যায়, কেউ সাবেক অর্থসচিব ও সাবেক বাংলাদেশ ব্যাংকের (বিবি) গভর্নরের আস্থাভাজন, কেউ ওই কর্মকর্তার আস্থাভাজন এবং সাবেক মন্ত্রীদের ঘনিষ্ঠ আবার কেউ কেউ। এদের মধ্যে কারো বদলির প্রসঙ্গ উঠলেই ‘হ্যালো’তে থেমে যায়। এসব অপ্রিয় কথা প্রশাসনিক প্রাণকেন্দ্র বাংলাদেশ সচিবালয়ের মন্ত্রণালয় ও বিভাগে ‘টক অব দ্য কান্ট্রি’।
অন্তর্বর্তী সরকার গত ৮ আগস্ট দায়িত্ব নেওয়ার পর দুই মাস হতে ১০ দিন বাকি। তবে তারা এখনো পুরোপুরি প্রশাসনিক সংস্কার আনতে পারেননি। ফলে এখনো ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে দেশ ছেড়ে ভারতে আশ্রয় নেওয়া শেখ হাসিনা সরকারের প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণে বেশির ভাগ মন্ত্রণালয় ও বিভাগ। যার মধ্যে অর্থ ও যোগাযোগ সর্বাগ্রে এগিয়ে। বদলি নিয়ে নাড়াচাড়া শুরু হলেই সতর্ক হয়ে যান পদ আঁকড়ে থাকা আমলারা। পুরোনো কৌশলেই ধরনা দিচ্ছেন নতুন সরকারের ঘনিষ্ঠদের কাছে।
সরকারি চাকরিতে সর্বোচ্চ তিন বছর একই কর্মস্থলে থাকার বিধান রয়েছে। এ সময় অতিক্রম হলে বদলির ঘণ্টা বেজে যায়। ক্ষণ-গণনা শুরু হয় নতুন কর্মস্থলের জন্য। অথচ অর্থ ও যোগাযোগ বিভাগের পুরো চিত্রই ভিন্ন। এক-দুই বছর না; টানা ১৭ বছরেও মন্ত্রণালয় ছাড়তে হয়নি এমন কর্মকর্তার সন্ধান পাওয়া গেছে। শুধু অর্থ ও যোগাযোগ বিভাগেই ৫ বছরের বেশি সময় ধরে চাকরি করছেন ৬০ জনের বেশি কর্মকর্তা। এ নিয়ে মিশ্র অসন্তোষ রয়েছে দীর্ঘদিন ধরেই। তাতেও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের টনক নড়ছে না।
জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞ ও সাবেক অতিরিক্ত সচিব ফিরোজ মিয়া প্রতিদিনের সংবাদকে এ প্রসঙ্গে বলেন, কোনো মন্ত্রণালয় বা বিভাগে কারিগরি বা টেকনিক্যাল অথবা তথ্যপ্রযুক্তি সংক্রান্ত ইস্যু থাকলে এসবের প্রয়োজনে দুয়েকজন বিশেষজ্ঞ কর্মকর্তার সপদে বহাল রাখা যেতে পারে। তবে ঢালাও বদলি না হওয়া অবাঞ্ছনীয়। তারা সপদে থাকার কারণে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার ক্ষেত্রে দুর্নীতির সুযোগ বাড়ে। তিনি বলেন, একটা সময় পর বদলি করা উচিত। না হলে ওই কর্মকর্তার কাছ থেকে নতুন পরিকল্পনা বা সার্ভিস আশা করা যায় না। পুরাতন চিন্তা ও ধ্যান-ধারণা নিয়েই দায়িত্ব পালন করতে থাকেন। যার ফলে সরকার ওই কর্মকর্তার কাছ থেকে কাঙ্ক্ষিত সেবা বঞ্চিত হয়। তাই জনস্বার্থে বদলি করা বাঞ্ছনীয়।
সদ্য পদোন্নতি পেয়ে সরকারের অতিরিক্ত সচিব হয়েছেন বেগম নাসরিন সুলতানা। যার পরিচিতি নং-৫৮৪৫। এক-এগারো সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধয়াক সরকারের সময়ে বদলি হয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগে যোগদান করেন। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের পুরো সময় ছিলেন এ বিভাগে। বর্তমান সরকার পরিচালনায় ড. মুহম্মাদ ইউনুস থাকলেও সপদে বহাল তিনি। এ বিভাগেই ১৭ বছর দুই মাস চলছে এ কর্মকর্তার। আর ৯ মাস পর চাকরি থেকে অবসরে যাবেন। তাই এখান থেকে যেতেই চালাচ্ছেন লবিং-গ্রুপিং। আর ১২ বছর ৭ মাস ধরে অর্থবিভাগে আছেন সুলেখা রাণী বসু। আর ১০ বছর ১ মাস চাকরি করছেন আবুল মনসুর। সাবেক বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আবদুর রউফ তালুকদারের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ ও আস্থাভাজন অফিসার সিরাজুন নূর চৌধুরী। বাজেট-১ শাখার অতিরিক্ত সচিব এ কর্মকর্তার পরিচিতি নং-৬৩৬২। টানা ৯ বছর ৪ চাকরি করার সুবাধে পুরো সিন্ডিকেট গড়ে তুলেছেন এ কর্মকর্তা বলে অভিযোগ রয়েছে। সিন্ডিকেট কিং হিসেবে সিরাজুন অর্থ বিভাগের অভ্যন্তরীণ পদায়ন ও বিদেশে ট্রেনিং ও প্রজেক্ট অফিসার নিয়োগসহ গুরুত্ব কাজ নিয়ন্ত্রণ করেন তিনি। আর আওয়ামী লীগ আমলের ডিসি ও ইউএনও মোহাস্মদ মানজারুল মান্নানও টানা ৯ বছর ৪ মাস কাটিয়ে দিয়েছেন এ অর্থবিভাগে। এখনো বদলিও কোনো সম্ভাবনা দেখছেন না তারই সতীর্থ কিছু আমলা বলে জানান। আর আবদুর রউফ তালুকদারের ঘনিষ্ঠ যুগ্ম সচিব রওনক জাহান ও তনিমা তাসনিম এ বিভাগে রয়েছেন ১১ বছর ধরে। ড. মো. মতিউর রহমান ১০ বছর, বিলকিস জাহান রিমি ৯ বছর ১০ মাস, মুন্সী আবদুল আহাদ ৮ বছর ১১ মাস, হাসানুল মতিন ৮ বছর ৩ মাস, মনুজুরুল হক ও নজরুল ইসলাম ৯ বছর ধরে, দিল আফরোজ, মুহাম্মদ আনিসুর রহমান ও মোহাম্মদ আনিসুজ্জামান ৮ বছর ধরে, ৭ বছর ধরে অর্থবিভাগে রয়েছেন ড. আবদুর রহিম, সৈয়দ মুহাম্মদ, মোহাম্মদ আজাদ ছাল্লাল, মিলিয়া শারমিন, আবু দাইয়ান, মোহাম্মদ ফারুক উজ জামান, হোসেন আহহেম, মো. তাজুল ইসলাম, ফৌজিয়া রহমান, মো. ফিরোজ ও নুরউদ্দিন আল ফারুক। আর ছয় বছর ধরে আছেন ড. মোহাম্মদ আবু ইউছুফ, রহিমা বেগম, সাহানা, আবুল কাসেম, ড. জিয়াউল আবেদীন ও ড. মো ফেরদৌস আলম (সাবেক অর্থমন্ত্রী লোটাস কামালের একান্ত সচিব-পিএস)।
এদিকে সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয়ে ২০১৩ সালের ৬ মে উপপ্রধান কর্মকর্তা হিসেবে যোগদান করেন মো. জাকির হোসেন। এখানেই আরো দুটি পদোন্নতি পেয়ে তিনি এখন অতিরিক্ত সচিব। দীর্ঘ ১১ বছর এ মন্ত্রণালয়ে চাকরি করলেও আলোচনা নেই বদলির। বরং এখানেই থাকতে করছেন তদবলি ও লবিং। মো. মাহবুবের রহমান ২০০৯ সালের ২ ডিসেম্বর এ বিভাগে যোগদান করেন সিনিয়র সহকারী প্রধান হিসেবে। এখন পর্যন্ত চারটি পদোন্নতি পেয়ে সরকারের অতিরিক্ত সচিব তিনি। এখনো বহাল তবিয়তে এ মন্ত্রণালয় বা বিভাগে। ২০১০ সাল থেকে এখন পর্যন্ত এ বিভাগে রয়েছেন সাবেক একজন মন্ত্রীর পিআরও। তিন বছর পেরিয়েছে নীলিমা আফরোজের। আর আবদুল্লাহ আল মাসুম এ বিভাগে যোগদান করেন ২০১৯ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি। আর শ্যামল রায় ২০১৫ সালের ১৭ মে এ বিভাগে যোগদান করেন; এখনো বহাল তবিয়তে রয়েছেন। বছরের পর বছর একই মন্ত্রণালয় বা বিভাগে চাকরি করছেন। বদলি না হওয়া নিয়েই রয়েছে তাদের বিরুদ্ধে নানা অনিয়ম ও স্বজনপ্রীতির অভিযোগ। তবুও কেন বদলির আদেশ জারি হয় না, এ নিয়েও অভিযোগের অন্ত নেই। বলা হয়, প্রভাবশালীদের হ্যালোতেই সব হিসাব-নিকাশ বদলে যায়। থেমে যায় বদলির আলোচনা।
"