নিজস্ব প্রতিবেদক

  ২৭ সেপ্টেম্বর, ২০২৪

জাসদ ছাত্রলীগ থেকে আমিরে জামায়াত

ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর শীর্ষনেতা ডা. শফিকুর রহমান। ১৯৮৫ সাল থেকে সংগঠনটির একাধিক দায়িত্ব পালন করছেন তিনি। শফিকুর রহমানের নেতৃত্ব, সামাজিক ও কল্যাণমূলক প্রশংসনীয় কাজ তার এ নেতৃত্ব গুণকে আরো দৃশ্যমান করেছে দেশবাসীর সামনে। ১৯৭০ সালের নির্বাচনের পর স্কুলে পড়ার সময় ছাত্রলীগ এবং পরে জাসদ ছাত্রলীগের হাত ধরে রাজনীতিতে অসেন তিনি। দীর্ঘ সময়ের পরিক্রমায় তার চিন্তা ও কর্ম কাঠামোতে এসেছে পরিবর্তন। সুভাষী এই নেতা হয়ে উঠেছেন দেশের প্রভাবশালী রাজনীতিকদের অন্যতম একজন।

গত ৫ আগস্ট ছাত্রজনতার গণঅভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর নতুনভাবে আলোচনায় আসে ডা. শফিকুর রহমানের নাম। দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে বহির্বিশ্বেও সুনাম ছড়িয়ে পড়ে জাসদ ছাত্রলীগ দিয়ে রাজনৈতিক জীবন শুরু করা ৬৫ বছর বয়সি এই রাজনীতিকের। প্রতিদিনের সংবাদের খোঁজে এমনই তথ্য মেলে। সাবেক স্বৈরাশাসকের দেশ ত্যাগের পর সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান জামায়াতের আমিরের নাম উচ্চারণের মধ্য দিয়ে নতুন করে সামনে আসেন ডা. শফিকুর রহমান। অন্তর্বর্তী সরকার গঠন থেকে শুরু করে মন্দিরসহ সংখ্যালঘুদের ঘরবাড়ি পাহারা সব কাজে সামনের সারিতে দেখা যায় জামায়াতকে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় শহীদ পরিবারের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে অর্থ সহযোগিতা এবং সবশেষ বানভাসিদের পাশে দাঁড়িয়ে জামায়াত আমিরের বক্তব্য মন জয় করেছে নেটিজেনদের। বিশেষ করে গণঅভ্যুত্থানের পরপরই জামায়াত নেতার ঘোষণা ‘প্রতিশোধ নয়, ক্ষমা’। বৈষম্যের বিরুদ্ধে বক্তব্য দিয়ে তিনি বলেন, ‘সংখ্যালঘু ও সংখ্যাগুরু শব্দের কবর রচনা হোক, আমাদের পরিচয় হোক বাংলাদেশি।’ ১৯৫৮ সালের ৩১ অক্টোবর মৌলভীবাজারের কুলাউড়ায় সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন শফিকুর রহমান। মোহাম্মদ আবরু মিয়া ও খতিবুন্নেছা দম্পতির পাঁচ সন্তানের মধ্যে তৃতীয় তিনি। ১৯৭৩ সালে স্থানীয় বরমচাল উচ্চবিদ্যালয়ে দশম শ্রেণিতে পড়ার সময়ই রাজনীতিতে হাতেখড়ি হয় শফিকুর রহমানের। ওই বছরই তিনি যোগ দিয়েছিলেন জাসদ ছাত্রলীগে। ১৯৭৪ সালে ওই স্কুল থেকে এসএসসি এবং ১৯৭৬ সালে সিলেট এমসি কলেজ থেকে কৃতিত্বের সঙ্গে এইচএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন শফিকুর রহমান। সিলেট মেডিকেল কলেজে ভর্তির পর তিনি পরিচিত হন বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরের সঙ্গে। ১৯৭৭ সালেই যোগ দেন এই সংগঠনে। পরে সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন সিলেট মেডিকেল কলেজ এবং সিলেট শহর শাখার। ১৯৮৩ সালে এমবিবিএস ডিগ্রি অর্জনের পর চিকিৎসাসেবায় আত্মনিয়োগ করেন ডাক্তার শফিকুর রহমান। পাশাপাশি জামায়াতের রাজনীতির সঙ্গেও একাত্ম হন। ১৯৮৪ সালে জামায়াতে ইসলামীতে যোগদানের মাধ্যমে বৃহত্তর রাজনীতিতে পদার্পণ করেন ডা. শফিকুর রহমান। দায়িত্ব পালন করেন সিলেট শহর এবং জেলা ও মহানগরীর আমির হিসেবে। ২০১৬ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল নিযুক্ত ছিলেন ডাক্তার শফিকুর রহমান।

২০১৯ সালের ১২ নভেম্বর দলের রুকন সম্মেলনে প্রত্যক্ষ ভোটে আমির নির্বাচিত হন তিনি। একই বছর ৫ ডিসেম্বর পরবর্তী দুই বছর মেয়াদে আমিরে জামায়াত হিসেবে ডাক্তার শফিকুর রহমান শপথ নেন। ২০২২ সালের ৩১ অক্টোবর দ্বিতীয় মেয়াদেও আমির নির্বাচিত হন তিনি।

বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীতে উল্লেখযোগ্য দায়িত্বে ছিলেন ডা. শফিকুর রহমান। ১৯৮৫ : নির্বাচিত সদস্য, কেন্দ্রীয় মজলিসে শূরা, জামায়াতে ইসলামী; ১৯৮৬-৮৮ : সেক্রেটারি, সিলেট জেলা জামায়াত; ১৯৮৯-৯১ : নায়েবে আমির, সিলেট জেলা জামায়াত; ১৯৯১-৯৮ : আমির, সিলেট জেলা জামায়াত; ১৯৯৮ : সদস্য, কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদ, জামায়াতে ইসলামী; ১৯৯৮-২০০৭ : আমির, সিলেট মহানগর জামায়াত; ২০১০ : অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি জেনারেল, জামায়াতে ইসলামী; ২০১১ : সদস্য, নির্বাহী পরিষদ, জামায়াতে ইসলামী ২০১১-২০১৬ : ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি জেনারেল, জামায়াতে ইসলামী; ২০১৭-২০১৯ : সেক্রেটারি জেনারেল, জামায়াতে ইসলামী; ২০২০ অদ্যাবধি : আমির, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী।

১৯৮৫ সালে ডা. আমিনা বেগমের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন ডা. শফিকুর রহমান। তার স্ত্রী পরবর্তীতে অষ্টম জাতীয় সংসদের সদস্য হন। দুই মেয়ে ও এক ছেলের বাবা ডা. শফিকুর রহমান। দুই মেয়েই জড়িত চিকিৎসা পেশায়। একমাত্র ছেলেও পড়ছেন এমবিবিএস শেষ বর্ষে।

জাসদণ্ডছাত্রলীগ থেকে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলের এত বড় পদে আসীন হওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আসলে জাসদণ্ডছাত্রলীগ না। প্রকৃতপক্ষে যখন ’৭০-এর নির্বাচন হয়, তখন আমরা স্কুলের ছাত্র। তখন ছিল লেটারপ্রেস, লেখার অক্ষরগুলো বসিয়ে বসিয়ে ছাপাখানায় ছাপত; তখন পোস্টারগুলোও ছাপা হতো। এটা পর্যাপ্ত ছিল না, এটা ছিল শুধু থানা হেডকোয়ার্টারে ছিল। ’৭০-এর নির্বাচনের সময় নৌকার সিল বানিয়ে আনা হয়, আর পোস্টারগুলো আমরা হাতে লিখতাম। আমাদের চেয়ে যারা সিনিয়র তারা সেগুলো লাগাত। সেই অর্থে আমি ছাত্রলীগের ’৭০-এর হাতে লেখা পোস্টারের কর্মী। তখন ছাত্রলীগ কী আর রাজনীতি সে অর্থে বুঝিই না। সবার সঙ্গে স্রোতের তালেই এটা করেছি। আমার বাপ-চাচারা দুজন ছিলেন। চাচা আমার আব্বার ছোট। সেকেন্ড কাজিন যিনি তিনি ইপিআরের তরুণ অফিসার ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধে তিনি অংশগ্রহণ করেন এবং শাহাদতবরণ করেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার অনেক দিন পর নিশ্চিত হয়েছি তিনি আর নেই। পাকিস্তান থেকে যখন বন্দি সবাই চলে আসেন, তখন বুঝতে পারলাম তিনি আর নেই। শেষ পর্যন্ত আমরা খবর পেয়েছি মুক্তিযুদ্ধের তৃতীয় দিনেই ইপিআর আর্মির সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধের সময় চট্টগ্রামের হালিশহর এলাকায় মারা যান। স্বাভাবিকভাবে এ পরিবারের সঙ্গে আমাদের রক্তের সম্পর্ক হয়ে যায়। কিন্তু স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও শ্রমিক লীগ, এই তিনটা লীগই মূলত ছিল। তাদের আর কোনো দল ছিল না। হয়তো কৃষক লীগ ছিল কিন্তু আমরা জানতাম না। ডা. শফিকুর আরো বলেন, আমাদের বাড়ির একদিকে হাওর আরেক দিকে পাহাড়। আমরা দেখেছি পাহাড়ের বড় বড় গাছ কেটে তারা নিয়ে যাচ্ছে; মা-বোনদের ইজ্জত নষ্ট করছে। এগুলো জবাবদিহির কোনো জায়গা ছিল না। এ ধরনের অবস্থায় যখন জাসদ জন্ম নিল, তখন স্বাভাবিকভাবেই দেশের তরুণ প্রতিবাদী মানসিকতার যারা ছিল, তারা ব্যাপকভাবে জাসদণ্ডছাত্রলীগে যোগ দিতে লাগল। আমি তাদের স্রোতেই যোগ দিয়েছি।

জামায়াত আমির বলেন, এমসি কলেজে থাকার সময় দেখলাম এরাও (জাসদ ছাত্রলীগ) আবার ব্যাংক লুট করা শুরু করল। এরাও আবার থানা ও অস্ত্র লুট করা শুরু করল এবং বিভিন্ন ধরনের অপকর্ম শুরু করল। তখন এদের ওপরও বিতৃষ্ণা এসে পড়ল। কিছু দিন চুপ থাকলাম। কিন্তু আমি তাদের কিছু জানতাম। এই জানার কারণে আমার জীবন ঝুঁকিতে ছিল। তাদের দৃষ্টিতে যাকে বিশ্বাসঘাতক মনে হতো, তাকে তারা মেরে ফেলত। কিন্তু আমি তো বিশ্বাসঘাতক নই। আমি তো ইন্টারেস্ট হারিয়ে ফেলেছি এ রাজনীতিতে। এ রাজনীতি আমি করব না। তো শেষ পর্যন্ত আমি কিছু দিন বাড়িতে চলে গেলাম হোস্টেল থেকে। বড় ভাইদের পরামর্শে এমসি কলেজের হোস্টেলে আর থাকলাম না। তারপর তারা আলাপ-আলোচনা করে আশ্বস্ত করলেন তারা আমার কোনো ক্ষতি করবে না। তারাই নিয়ে গেলেন, আবার আমার ক্লাস শুরু হলো। এ অবস্থায় জাসদ ছাড়লাম আমি। কিশোর-মন তো চঞ্চল থাকে, তাই মানসিক প্রশান্তির জন্য আমি অটোমেটিকেলি কলেজ লাইব্রেরি থেকে পবিত্র কোরআন নিয়ে পড়া শুরু করলাম অর্থসহকারে। এরপর তফসিরে আফসারের ছোট লেখাগুলো পড়া শুরু করলাম। শেষ পর্যন্ত আলহামদুলিল্লাহ আল্লাহতায়ালার মেহেরবানিতে টের পেলাম; আমি যে রুমে থাকি সে রুমের লোকেরা কোনো একটি ইসলামী সংগঠন করে। কিন্তু এটা তারা গোপন রেখে চলতেন। তারা খুবই গোপনীয়তা রক্ষা করতেন। পরে আমি জানতে পেরেছি, তারা একটি ইসলামী ছাত্র সংগঠনের সঙ্গে ছিলেন। তাদের কাছ থেকে আমি আবদার করে দাওয়াত গ্রহণ করেছিলাম। তাদের তখন সতর্কতার প্রয়োজন ছিল, কারণ তাদের জীবনও ঝুঁকির মুখে ছিল। এভাবেই আমার ইসলামী সংগঠনের দিকে ঢোকা এবং এভাবেই সৎ ও ধার্মিক নর-নারীর রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর শীর্ষ পদে এসেছি। আমি ও আমার দল দেশবাসীর সেবা করতে চাই।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close