বদরুল আলম মজুমদার
জনসমুদ্র নয়াপল্টন
অন্তর্বর্তী সরকারকে কোনোভাবেই ব্যর্থ হতে দেওয়া যাবে না বলে মন্তব্য করেছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। তিনি বলেছেন, দেশ-বিদেশ থেকে নানারকম উসকানিতেও বাংলার জনগণ অন্তর্বর্তী সরকারকে ব্যর্থ হতে দেবে না। তবে অন্তর্বর্তী সরকার যাতে নিজেরাই নিজেদের ব্যর্থতার কারণ হয়ে না দাঁড়ায়, সে ব্যাপারে তাদেরও সতর্ক থাকতে হবে। গতকাল মঙ্গলবার বিকেলে রাজধানীর নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে আয়োজিত সমাবেশে লন্ডন থেকে ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে প্রধান অতিথির বক্তব্যে এসব কথা বলেন তারেক রহমান। আন্তর্জাতিক গণতন্ত্র দিবস উপলক্ষে এ সমাবেশের আয়োজন করে বিএনপি। সমাবেশ ঘিরে নয়াপল্টনসহ আশপাশের এলাকা ও সড়কজুড়ে জনসমুদ্র তৈরি হয়।
গতকাল দুপুর থেকেই নয়াপল্টনে শুরু হয় বিএনপির সমাবেশ। তীব্র রোদ উপেক্ষা করে খণ্ড খণ্ড মিছিল নিয়ে সমাবেশ ঘিরে রাজধানীর নয়াপল্টনে জড়ো হন লাখো নেতাকর্মী। স্লোগানে স্লোগানে মুখর হয়ে ওঠে পুরো এলাকা। ঢাকা ও ঢাকার বাইরে থেকে আসা বিএনপির নেতাকর্মীরা মাথায় জাতীয় পতাকা বেঁধে এবং হাতে জাতীয় ও দলীয় পতাকা নিয়ে উল্লাস করতে করতে সমাবেশস্থলে উপস্থিত হন। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার হাজারো শহীদের রক্তের বিনিময়ে, লাখকোটি জনতার গণ-অভ্যুত্থানের ফসল উল্লেখ করে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বলেন, এ সরকারের কোনো কোনো কার্যক্রম সবার কাছে হয়তো সাফল্যমণ্ডিত হিসেবে বিবেচিত নাও হতে পারে। কিন্তু আমাদের সবার মনে রাখতে হবে- এ সরকারের ব্যর্থতা আমাদের সবার ব্যর্থতা। বাংলাদেশের পক্ষে গণতন্ত্রকামী জনগণের ব্যর্থতা। বাংলাদেশ কিংবা যেকোনো দেশেই গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে গঠিত সরকার অবশ্যই জনগণের সরকার। তাই জনগণ অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি সহযোগিতা অব্যাহত রেখেছে, রাখবে।
তারেক রহমান বলেন, কোনো একপর্যায়ের অন্তর্বর্তী সরকারের জবাবদিহিও নির্বাচিত সংসদের মাধ্যমে নিশ্চিত করা হয়। সুতরাং জনগণের রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের মাধ্যমে একটি নির্বাচিত সংসদ এবং সরকার প্রতিষ্ঠায় অন্তর্বর্তী সরকারের সব সংস্কার কার্যক্রমের প্রথম এবং প্রধান টার্গেট হওয়া জরুরি। তিনি বলেন, এজন্য আমরা মনে করি, অগ্রাধিকার ভিত্তিতে জনগণের ভোটে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের দ্বারা জবাবদিহিমূলক সরকার ও সংসদ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য সামনে রেখেই সংস্কার কার্যক্রম এগিয়ে নেওয়া দরকার। এর আগে দুপুর আড়াইটায় নয়াপল্টনস্থ বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে পবিত্র কোরআন তেলাওয়াতের মধ্য দিয়ে সমাবেশ শুরু হয়। আন্তর্জাতিক গণতন্ত্র দিবস উপলক্ষে আয়োজিত এ সমাবেশে নেতাকর্মীদের ঢল নামে পল্টন এলাকায়।
সভাপতির বক্তব্যে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, সরকার ও আমলাদের মধ্যে আওয়ামী ফ্যাসিস্ট সরকারের অনেক প্রেতাত্মা অবস্থান করছে, তারা চক্রান্ত করছে। এ চক্রান্ত রুখে দাঁড়াতে হবে। গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনতে হবে। তিনি বলেন, শুধু ৫২ কিংবা ৭১ নয়, সেই ব্রিটিশ আমল থেকে গণতন্ত্রের জন্য লড়াই-সংগ্রাম চলছে। শেখ হাসিনা গত ১৫ বছর বাংলাদেশের মানুষের ওপর স্টিমরোলার চালিয়ে গেছে, সেটাকে উপেক্ষা করে আজ আমরা একটা মুক্ত পরিবেশে এসেছি। গণতন্ত্র আর বিএনপি সমার্থক উল্লেখ করে মির্জা ফখরুল বলেন, বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান একদলীয় শাসন থেকে বহুদলীয় শাসন চালু করেছেন। আর দেশনেত্রী খালেদা জিয়া রাষ্ট্রপতি শাসন থেকে সংসদীয় গণতন্ত্র চালু করেছেন।
সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য খালেদা জিয়া তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা চালু করেছেন বলে দাবি করেন মির্জা ফখরুল। তিনি বলেন, ২০১৬ সালে খালেদা জিয়া ভিশন-২০২১ দিয়ে গণতন্ত্র টেকসই করার কথা বলেছেন। আর ২০২৩ সালে বিএনপি আবার ৩১ দফা দিয়েছে। গত ১৬ বছরে বিএনপির অনেক নেতাকর্মী প্রাণ দিয়েছে উল্লেখ করে মির্জা ফখরুল বলেন, অনেকে কারাগারে গেছেন। অনেকে গ্রামে না থাকতে পেরে ঢাকায় এসে রিকশা চালিয়েছেন। গতকাল (সোমবার) আমি পঙ্গু হাসপাতালে গিয়ে দেখেছি, ১৩ বছরের একটি ছেলের গুলি লেগে পা হারিয়েছে। সমাবেশে উপস্থিত তরুণ নেতাকর্মীদের উদ্দেশে মির্জা ফখরুল বলেন, আপনারা হচ্ছেন সেই ভ্যানগার্ড, আজ আবার কেউ গণতন্ত্রকে বিপথে নিতে চাইলে রুখে দাঁড়াবেন। তিনি আরো বলেন, তারেক রহমান দেশে ফিরে আসবেন। দেশনেত্রী খালেদা জিয়া চিকিৎসার জন্য বিদেশ যাবেন এবং ফিরে আসবেন। এ সময় গণ-অভ্যুত্থানে আহত-নিহতদেরর ক্ষতিপূরণ দেওয়ার দাবি জানান মির্জা ফখরুল।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন অন্তর্বর্তী সরকারের উদ্দেশে বলেন, আপনারা নানা সংস্কারের কথা বলছেন। কিন্তু সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ ভোট সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন। অন্তর্বর্তী সরকারকে অনুরোধ করতে চাই, অবিলম্বে ভোটের ব্যবস্থা করতে হবে। জনগণ ভোট দিয়ে তাদের প্রতিনিধি সংসদে পাঠাবে। বিএনপির এ নেতা বলেন, এত বড় একটি পরিবর্তনের পর স্বৈরাচার সরকার যেসব অন্যায়, অত্যাচার, দুর্নীতি করেছে, তার বিচার অবিলম্বে চাই। প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন, সব সেক্টর ধ্বংস করে গেছে শেখ হাসিনা। অনতিবিলম্বে সব সেক্টরে সংস্কার করতে হবে; যাতে মানুষ নিরাপদে থাকতে পারে, নিজের ভোট দিতে পারে, সেই ব্যবস্থা করতে হবে। খালেদা জিয়া পালাননি, পালিয়েছেন শেখ হাসিনা- এমন মন্তব্য করেছেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস। তিনি বলেন, দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া দেশ থেকে পালিয়ে যাননি। কিন্তু হাসিনা তার নেতাকর্মীদের ফেলে রেখে ভারতে পালিয়ে গেছেন। আবার বলে হুট করে চলে আসবেন। কিন্তু আপনি আমাদের যেভাবে জেলে রেখেছেন, সেভাবে আমরা আপনাকে জেলে রাখব না, শুধু বিচার করব।
বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আবদুল মঈন খান বলেন, ছাত্র-জনতার জনস্রোতে স্বৈরাচার শেখ হাসিনা ভেসে গেছেন। এক্ষেত্রে তারেক রহমানের সুযোগ্য নেতৃত্বে দেশ স্বৈরাচারমুক্ত হয়েছে। মঈন খান বলেন, বাংলাদেশের মুক্তিকামী ছাত্র-জনতা যে ইতিহাস তৈরি করেছে; তা পুরো পৃথিবীর ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। ছাত্র-জনতার জনস্রোতে স্বৈরাচার হাসিনা ভেসে গেছেন। সমাবেশে বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব হাবিব-উন-নবী খান সোহেল বলেন, যদি ঢাকা শান্তিতে না থাকে, দিল্লিও শান্তিতে থাকতে পারবে না। সোহেল বলেন, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার চলমান আন্দোলনে আমরা বিজয়ের খুব কাছাকাছি আছি। আর একটু বাকি। আশা করছি, আমাদের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের দিকনির্দেশনায় জনগণকে সঙ্গে নিয়ে এ রাস্তাটুকু সফলভাবে অতিক্রম করব।
অন্তর্বর্তী সরকারের উদ্দেশে বিএনপি সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে উল্লেখ করে দলটির যুগ্ম মহাসচিব শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানি বলেন, প্রশাসনে ফ্যাসিবাদের যত প্রেতাত্মা আছে, তাদের চিহ্নিত করতে হবে। তিনি বলেন, জনগণের টাকা লুটপাট করেছে, সব টাকা ফেরত আনতে হবে। আমাদের দীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রাম ছিল নির্দলীয়-নিরপেক্ষ সরকারের দাবিতে। জনগণের সরকার প্রতিষ্ঠা করার জন্য উদ্যোগ নিতে হবে। এটা আমাদের দাবি, জনতার দাবি। সমাবেশে বক্তব্য দেন বিএনপির বিভিন্ন পর্যায়ের গুরুত্বর্পূ নেতারা। সমাবেশে ঢাকা ও আশপাশের বিভিন্ন সংসদীয় আসনের মনোনয়নপ্রত্যাশী নেতারা ব্যাপক শোডাইন করেন। ১৫ সেপ্টেম্বর এ সমাবেশ হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার কারণে তারিখ পরিবর্তন করা হয়।
উত্তরা : রাজধানীর উত্তরা থেকে সমাবেশে যোগ দেন বিপুলসংখ্যক বিএনপির ও অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মী। সকালের পরপরই উত্তরা থেকে বড় জমায়েত নিয়ে হাজির হন সাবেক যুবদল নেতা ও উপনির্বাচনে ঢাকা-১৮ আসন থেকে নির্বাচন করা প্রার্থী এস এম জাহাঙ্গীর হোসেন। এর বাইরে উত্তরা থেকে আরো দুটি বড় জমায়েত নিয়ে হাজির হন বিএনপি ও ব্যবসায়ী নেতা এম কফিল উদ্দিন, মোস্তাফিজুর রহমান সেগুন ও হাজী মোস্তফা জামান। তাদের মিছিলেও হাজার হাজার লোকজন স্বতঃস্ফূর্তভাবে সমাবেশে যোগ দিতে দেখা যায়। এছাড়া মহানগর উত্তর থেকে এককভাবে মিছিল নিয়ে যান ছাত্রদল উত্তরের সভাপতি মেহেদী হাসান রুয়েল, যুবদল নেতা শিমুল আহমেদসহ আরো অনেকে।
"